রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

কখনো দেখেছ মাগরিবের চাঁদ?পাথুরে রুক্ষপ্রকৃতিতে খুঁজতে গিয়েছ ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ?চপলতার শিৎকারের আড়ালে খুবলে খেয়েছ মৃত হৃদয়ের অনুভূতি?আঘাত করতে পেরেছ কখনো পৈশাচিক উল্লাসে?যদি পেরে থাকো,এসো,আজ দুদণ্ড মাখব অন্ধকারাবৃত কল্পশোক,তোমার সাথেই।
যানজটমুখর শহরের কোলাহলে বাস তোমার কবি,সীমাহীন ঊদ্ধত্বে যেথা আকাশ ছোঁয় বহুতল,বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে সাময়িকীর পাতায় মুখ লুকায় সম্পর্করা,আন্তরিকতার আবেদনের চেয়ে সেথা যান্ত্রিকতার বাহুল্য,দেখনদারির উচ্ছাস।
আমার এ গণ্ডগ্রাম বড্ড রুক্ষ,তোমাদের ভাষায় বড্ড ব্যাকডেটেট।সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা গ্রামবাংলার শান্ত-সমাহিত রূপ নাই হেথায়,আছে হিংস্র বন্যজন্তুর মত এখানে ওখানে কামড়ে ছিঁড়ে নেওয়ার মত মাইলের পর মাইল পাথরখাদান,প্রতিদিন গাঁইতি নামে তার বুকে,তৈরি হয় গভীর থেকে গভীরতর ক্ষত।সেই ক্ষতয় রক্তপাত নেই,আছে কানের পর্দা ভেদ করে দিগন্তপারে বিধাতার স্বর্ণসিংহাসন নাড়িয়ে দেওয়ার মত প্রবল আর্তনাদ।সেই আর্তনাদ অতৃপ্ত প্রেতাত্মার করুণ স্বরের ন্যায় ধাক্কা খেয়ে ফেরে পাথরঘাটায়,নির্গত হতে ব্যার্থ হয় বুক চিরে,এই দীর্ঘশ্বাস মেশা পাথরেই তৈরি হয় তোমার আপডেটেড ড্রইংরুমের বহুমূল্য মর্মরমূর্তি।তার সুডৌল ভঙ্গিমার পানে অবাক চোখে চেয়ে তুমি হাতে তুলে নাও কলম,লক্ষ করোনা পাথরের চোখেও জল আসে,তারও কান্না পায়।
কবি, তুমি জীবনানন্দ হতে চাও?প্রকৃতির রূপ কলমে চুবিয়ে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে আঁকতে চাও আরেকটি বনলতা সেন?যে হবে সর্বাঙ্গসুন্দরী, স্বয়ংসম্পূর্ণা কোনো বহুমূল্য বইয়ের পৃষ্ঠার ন্যায়?যাকে প্রতিরাতে উলটোবে তুমি পরম যত্নে,মোলায়েম হাত রাখবে তার শরীরী বিভঙ্গে,আর সে শিউরে উঠে মুখ লুকাবে বিদিশার নিশায়?জ্যোৎস্নাময়ী রাতে তোমার দশতলার ফ্লাটের ব্যালকনিতে তোমার কাঁধে মাথা রেখে গাইতে পারবে সুরেলা গলায়,--"আমার ভেতর ও বাহিরে অন্তরে অন্তরে...",তোমার আঙুল তখন তার রেশম চুল,গাল,ঠোঁট,গলা বেয়ে নামবে গভীর থেকে আরো গভীরে,রচিত হবে আরেকটি "মেড ফর ইচ আদার "দম্পতির পরিপূর্ণ প্রেমের গল্প।
আমি তো সেরকম নই,রূপের অর্গলমুক্ত করেছি বহুদিন,কঠোর সূর্যাতপে দেহের স্বর্ণালি রঙ বদলেছে বাদামী ব্রোঞ্জমূর্তিতে,মসৃণ পেলব কমনীয় ত্বক বদলেছে খড়ি ওঠা শক্ত চামড়ায়,তথাকথিত আফ্রোদিতিসূলভ সৌন্দর্য নেই,আছে এক বুনো আরণ্যক জঙ্গম।শরীরী বিভঙ্গে নেই উত্তেজিত করার ক্ষমতা,বরং গাছকোমর করে পরা শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে আছে অপত্যস্নেহ। নই সুকণ্ঠী,আবেগঘন সুরে গাইতে পারিনা রাবীন্দ্রিক গান,বরং চাইলে শোনাতে পারি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা,কোনো নীরব নির্জন দুপুরে।জ্যোৎস্নারাতে কোলে শুইয়ে শোনাতে পারি গীতগোবিন্দের শ্লোক,বর্ণনা করতে পারি কৃষ্ণবিরহীণী রাধার অমোঘ আকুতি,কপালে শুষ্ক হাত বুলিয়ে চোখে নামাতে পারি শান্তির ঘুম।তুমি আমায় ভালোবাসবে কেন?
তোমার সাহিত্যসভা আলোকিত করে মধ্যমণি হতে পারব না আমি,পারব না দুর্মূল্য বিলেতি সুরার পাত্র হাতে লাস্যময়ী হাসিতে তোমায় করতে আহ্বান সুললিত ডিজাইনার পোশাকে,ইংরেজি কথার ঝড়ে কিটস,সেক্সপিয়রের লেখনী শুনিয়ে, নামাতে পারব না ওথেলো,হ্যামলেট তোমার মননপাতায়।তবে পারব,লালনগীতির ছন্দে সন্ধ্যা নামাতে খড়ের চালের কুঁড়েতে,শঙ্খধ্বনিতে নয় কবিরের দোঁহায় করতে পারি মঙ্গলকামনা।শ্যাম্পেনের বহুমূল্য গ্লাসে নয় সস্তা ধেনোর বোতল গলায় ঢেলে ঝগড়া করতে পারি,বর্ষা নামাতে পারি বসন্তরাতে।দুর্মূল্য গোলাপগুচ্ছ নয় ভোরের শিশিরমাখা একমুঠো শিউলি তুলে দিতে পারি হাতে,আমায় তুমি মেনে নেবে কেন?
যোগ্য নই কোনোকালেই,তাই তোমার কবিতায় সাজি না কাব্য হয়ে,রয়ে যাই হয়ে সমাপ্তির আখ্যান,ডাস্টবিনে পড়ে থাকা দলাপাকানো বাতিল কাগজের মত।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours