রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

সঙ্গীতা গৃহবধূ, দুই সন্তানের জননী। স্বামী - সন্তান নিয়ে তার আপাত সুখের সংসার। তার একটাই খারাপ স্বভাব, হুটহাট রেগে ওঠা। ছাপোষা গৃহস্থ সঙ্গীতা পাড়ায় " দজ্জাল মহিলা " হিসাবে কুখ্যাত, স্বামীর ওপর নিত্য চিৎকার নিয়ে প্রতিবেশীরাও সন্ত্রন্ত। দুই সন্তান সর্বদা ভয়ে থাকে, কারণ রেগে যাওয়ার পরে মাকে আর মা বলে মনে হয়না ; রূপকথায় পড়া দত্যিদানো মনে হয়। মুখব্যাদান করে পরিত্রাহি চিৎকার, জিনিসপত্র ভাঙচুর, স্বামী কথা না শুনলে সেই রাগে সন্তানদের উদুম পেটানো.... সবই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সংসারের প্রাত্যহিক জিনিসপত্র কিনতে হিমসিম খেতেন স্বামী প্রতুলবাবু, নতুন কেনা জিনিস অচিরেই ভাঙা পড়ত সঙ্গীতার রাগের বলি হিসাবে। পরিবার থেকে প্রতিবেশী, বারবার বুঝিয়েও কাজ হয়নি কিছুই। নিত্যকার অশান্তিকে বোধহয় ভবিতব্য বলে ভেবে চুপ ছিলেন প্রতুলবাবু, কিন্তু তারপরে যা ঘটল তা স্তম্ভিত করে দিল সকলকে। একদিন সকাল থেকেই ছোট সন্তানটির ওপর সঙ্গীতার চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলেন প্রতিবেশীরা। পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করার জন্য স্কুলফেরত অভুক্ত শিশুটি উত্তমমধ্যম ও খেয়েছিল। বিকেলের দিকে আচমকা পুরো বাড়ি শান্ত হয়ে যায়। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে প্রতুলবাবু দেখতে পান, বিছানায় মুখে বালিশচাপা অবস্থায় শুয়ে ছোট্ট শিশুটি, মৃত! বড়টি জানায়, মা মারধর করায় ভাই কাঁদছিল। মায়ের কান্নাকাটি সহ্য হচ্ছিল না, বারবার চুপ করতে বলছিল; শোনেনি। তাই রাগ হওয়ায় মুখে বালিশচাপা দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে! সঙ্গীতা আপাতত জেল হেপাজতে।

বিভাস রায়চৌধুরী স্কুলশিক্ষক, শহরের অন্যতম নামী স্কুলে শিক্ষকতা করতেন তিনি।  ছাত্রমহলে বেশ কড়া শিক্ষক হিসাবে পরিচিতি ছিল তাঁর। তাঁর একটাই বদরোগ প্রতিবেশী ও আত্মীয়মহলে কুখ্যাত ছিল, তাঁর কথা শুনে না চললে ক্ষেপে উঠতেন বিভাসবাবু। ভয় দেখিয়ে, চিৎকার করে যেভাবেই হোক তাঁর কথা শুনতে বাধ্য করতেন বাকি সকলকে। ধীরে ধীরে তাঁর এই স্বভাবের জন্য তাঁকে সকলেই পরিত্যাগ করে যান, এমনকি স্ত্রী ময়ূরীও। একলা বিভাস খুব সহজেই চরম ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে পড়েন, কাজকর্ম - পড়ানো সব বন্ধ হয়ে যায়। ছোটবেলায় মাকে দেখেছিলেন ভয় দেখিয়ে - রাগ দিয়ে কর্তৃত্ব স্থাপন করতে, নিজে সেরকম করতে গিয়ে শ্যাম ও কূল দুইই খোয়ালেন তিনি।
রাগ বা ক্রোধ, মানুষের দ্বিতীয় ও ধ্বংসাত্মক রিপু। অল্পতেই রেগে ওঠা, অস্বাভাবিক আচরণ করা একজন মানুষকে তার পরিবার ও প্রিয়জন থেকে আজীবনের জন্য দূরে করে দিতে পারে। রাগ আবার আত্মধ্বংসের বিপক্ষে অন্যদের ধ্বংসে মদত দেয়, অর্থাৎ নিজেকে ডিফেন্ড করতে সাহায্য করে। অনেককেই বলতে শুনি,  " রাগ হলে আমার হুঁশ থাকে না, যা নয় তাই করে ফেলি "! এটা কিন্তু মানসিক রোগের পূর্বলক্ষণ। অ্যাঙ্গার ডিজর্ডার আসলে অনেকগুলি মানসিক রোগের মিশ্রণ, যেমন -- ডিপ্রেশন, বাইপোলার ডিজিজ ইত্যাদি। আসলে মানুষ অবচেতনে হলেও বরাবরই কর্তৃত্বপ্রিয়। যেমন করেই হোক সে আশেপাশের মানুষকে দাবিয়ে রাখতে চায়। আর নিজের কথা শোনানোর সহজতম পন্থা হচ্ছে রাগ দ্বারা ভয় দেখানো, চিৎকার - মারধোর। এছাড়াও এরমধ্যে কাজ করে বিরক্তি - হতাশা - অবদমিত আবেগ - কর্তৃত্ব হারিয়ে অবজ্ঞাপ্রাপ্ত হওয়ার ভয় ইত্যাদি। অতিরিক্ত রাগ হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ বৃদ্ধি করে, ফলে হৃদরোগের সম্ভাবনা অনেকখানি বেড়ে যায়।

এই রোগের চিকিৎসা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করা হয়না বললেই চলে। অতিরিক্ত রাগও যে একপ্রকারের মানসিক রোগ, এটাই বিশ্বাস করতে চান না অনেকে। ফলে চিকিৎসা শুরু হতে দেরী হয়ে যায় ও দূর্ঘটনা ঘটে যায়। বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল সেন্টারে " অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট কোর্স" করানো হয়, ইউটিউবেও এই সংক্রান্ত ভিডিও পাওয়া যায়। যে বিষয়ের ওপর রাগ হচ্ছে সেই ব্যক্তি - বস্তু বা স্থান থেকে দূরে সরে আসা, হাতে বরফ ধরে রাখা ( আইসব্যাগ ও মাথায় রাখতে পারেন, বরফ মনকে শান্ত করে), নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম (প্রাণায়াম) ইত্যাদি রাগ কমাতে সাহায্য করে। মনে রাখবেন, রাগ দ্বারা কাউকে সাময়িক ভয়ভীত করে রাখা সম্ভব, আজীবন তার প্রতি কর্তৃত্ব স্থাপন কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। এর দ্বারা পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি হয়, এবং ধীরে ধীরে আপনি সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। অল্প রাগ ভালো, আত্মরক্ষায় সহায়তা করে। কিন্তু অতিরিক্ত রাগ শুধু নিজের নয় বয়ে আনে অপরের ধ্বংস, তাই সাধু সাবধান।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours