কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

একটা মৃত্যু।
অনেক কিছুর জন্ম দেয়।
কিছুটা শোকের। অনেকটা দুঃখের। যেন অসহায় করে দিয়ে যায় সেই মৃত্যু। মাথা থেকে আচমকাই সরে যায়, বহুদিনের এক ছাতা।
আত্মীয় পরিজনের আহা উহু। শেষদেখাটাও আর অনেকেই দেখতে আসে না। সময়ের অভাব। বড্ড ব্যস্ত সবাই। আবার ঠিক ওই সময়টাতেই অনেকের শরীর ভীষন খারাপ হয়ে পড়ে। ফোনাফুনিতেই সামাজিকতা সারা।
যাদের সঙ্গে সকালে উঠলেই দেখা হতো। গুড মর্নিং বিনিময়। নিয়ম করে জেনে নিতো- ভালো আছেন তো? মারা গেলে সেই পড়শিদেরও দেখা মেলে না। সমবেদনা জানানো তো দূরের কথা। গোটা সিস্টেমটাই গেছে পালটে।

একটা মৃত্যুই অনেককিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়।
যুগটা পাল্টেছে। হাত বাড়ালেই সব হাজির।
এক ফোনেই ফ্ল্যাটের দোরগোরায় শববাহী গাড়ি। কাঁচঢাকা। মাথার পাশে সুগন্ধী ধুপকাঠি। সাদা চাদরে ঢাকা শবদেহ। ট্যাকের জোর থাকলে এসি গাড়ি চেপে শবদেহর শেষযাত্রা।
শ্মশানেই দশকর্মের জিনিস। পুরোহিত। সব হাতেগরম আয়োজন। সবশেষে ট্রেতে শুয়ে শবদেহর ইলেকট্রিক ফারনেসে প্রবেশ।

মাঝরাতে 'বলো হরি হরিবোল' কানে এলেই কেমন গায়ে কাঁটা দিতো। আগেকার সেই গা ছমছমে শ্মশানযাত্রার দিন প্রায় শেষ। খাটিয়াতে লাশ শুইয়ে চার কাঁধের ছুটে চলা। অমুক বাবু চলে গেলেন। পেছনে রাস্তাময় ছড়িয়ে গেলেন খই আর কিছু নয়া পয়সা। যে পয়সা বাস্তবে ভিখারিরও কাজে লাগতো না।
এখন শববাহী গাড়ির ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যাওয়া। শহরের রাস্তায় যানজটে ফেঁসে গেলে হুটারের চিৎকার। বাসের সিটে বসে থাকাদের হাত কপালে। মরাকে সম্মান প্রদর্শন নাগরিক শিষ্টাচার। ব্যস্তসমস্ত ট্রাফিক পুলিস। মৃতকে মন্ত্রীর ভিআইপি সম্মান, নাকি উল্টোটা? ভিআইপিকে মৃতের সম্মান? সে যাই হোক ট্রাফিকের তৎপরতায় শববাহী গাড়ির জ্যাম এড়িয়ে ছুটে চলা। পুরনো দিনের 'বলহরি' স্লোগান আজ 'তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম'- এর মতো ক্রমেই বাতিল। শ্মশানযাত্রার সেই বিভৎসতা ক্রমেই কমে আসছে। আধুনিকতার জুতোয় পা গলিয়ে, আমরাও আজ অনেকটাই কেতাদুরস্ত।

একটা মৃত্যু।
জন্ম দেয় আরও অনেক কিছুর।
শিখিয়ে যায় বাঁচতে শেখা। সম্পূর্ণ ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অভ্যাস রপ্ত করা। একা সহায় সম্বলহীন হয়েও বাঁচতে শেখা। যত দিন যায় সরতে থাকে শোকের ছায়া। কালো মেঘ সরে ক্রমেই রবির আলো। তারপর একসময় ঘন নীল ঝলমলে আকাশ।
নিজেই তখন নিজের সঙ্গী।
বৃষ্টির ছোবল আটকাতে মাথায় আর ছাতা লাগে না। মাথা তখন পাকাপোক্ত। বেল পড়লে সেই মাথা আর নাও ফাটতে পারে। বরং বেলটা ফেটে গেলেও আর অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
একটা মৃত্যুই চিনিয়ে দিয়ে যায় আরও অনেক কিছু।
আপনজনের স্বরূপ। সংসারের চরম সত্য।
সম্পর্ক যে আজ কত ঠুনকো, পরিষ্কার হয়ে যায় একটা মানুষ মারা যাওয়াতেই।

একটা মৃত্যু, মুখোশ সরিয়ে দেয় অনেকের।
অনেকে আবার খুশিও হয় অনেকের মৃত্যুর খবর পেলে। সম্পত্তির ভোগদখল এবার তার হাতে। এতদিন অনেককিছুই ফূর্তিফার্তা করা সম্ভব হয়নি। পরের ধনে পোদ্দারি করাতে অসুবিধা ছিলো। এবার মুক্তকচ্ছ। মর্জি মতো ভোগ করো। লোটাও। যা মন চায়, তাই করো।

একটা মৃত্যু কাউকে অমর করে দেয়।
আনমনা স্মৃতিতে। কারও মনে। কারোর কর্মে। মরেও বেঁচে থাকে সেজন।
যখন বেঁচে ছিলো, মানুষটাকে সেভাবে পাওয়া হয়ে ওঠেনি। দুজনেই ব্যস্ত নানান কাজে। কোনদিন হয়তো একটু সময় চুরি করে, মানুষটার কাছে ছুটে যাওয়া। এক পড়ন্ত বিকেলে গায়ে গা লাগিয়ে, কাশীরাম মিত্র ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখা। বাক্যহীন। শব্দহীন সেই মুহূর্তগুলো। সবকথা যেন জমে বরফ। ঝুপ করে আঁধার নামতেই, ঘরে ফেরার তাড়া। রাত আটটার মধ্যে হোস্টেলে না ঢুকলেই হাজার কৈফিয়ত।
সেই মানুষটাই একদিন দুম করে মরে গেল। মড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে রইলো নিজের ওয়ান বিএচকে ফ্ল্যাটে। সাধ করে ফ্ল্যাট কিনে সাজিয়েছিলো। ইচ্ছে ছিলো, বেশকিছু দিন মৌজ করে বাঁচবে। সাধ মিটলো না।

একটা মৃত্যু কাউকে বাঁচিয়ে দিয়ে যায়।
মুক্তি দিয়ে যায় ঘন অন্ধকারের একাকীত্ব থেকে। ঘন বনানীর নিঃস্তব্ধতা থেকে। দীর্ঘ রাতের জেগে থাকার অবসান।
সিগারেটের ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে আসা। রাত হলেই দমকা কাশির উপদ্রব। ক্লান্তির নিঃসঙ্গ দিনযাপন। সবের ইতি।

একটা মৃত্যু কখনও অন্যের জীবন ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
অন্যজন তখন জীবন্মৃত। জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকার শর্তপূরণ করা মানুষের ভিড়, ক্রমেই বাড়ছে শহরে। কোনও কাউন্সেলিংয়েই এই জীবন্মৃতরা আর প্রাণের স্পন্দন ফিরে পায় না।
বুক ধরফর করে। চোখের পাতা পড়ে। প্রাতঃকৃত্য সারে। স্নান করে। লাঞ্চ ডিনার কোনওকিছুই বাদ যায় না। গভীর রাতে দরজা খুলে, জানলার পর্দা সরিয়ে সিগারেটও ফোঁকে।
প্রতি মুহূর্তে জীবনের সঙ্গে মশকরা করে। কোনও শর্ত মেনে তারা বাঁচতে চায় না।

একেকটা মৃত্যু একেবারে একা করে দিয়ে যায়।
অনেকের মধ্যে থেকেও একা।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours