রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

সন্তু স্কুলে মধ্যমমানের ছাত্র। প্রতিবছর একটা মোটামুটি নম্বর নিয়ে পাশ করলেও কিছুতেই ফার্স্ট - সেকেন্ড - থার্ডের মধ্যে আসতে পারে না। ফুটবল খেলতে আর ঘুমোতে বড্ড ভালোবাসে, সুনীল ছেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
মা আরতিদেবীর ইচ্ছা ছেলে স্কুলে অসাধারণ  রেজাল্ট করুক। প্রতিবেশীর ছেলে তথা সন্তুর বন্ধু রাজীবকে দেখিয়ে চলে তাঁর নিত্য অনুযোগ। " রাজীব পরীক্ষায় ভালো নম্বর পায়, তুই কেন পাস না!", " রাজীব তো কই ঘুমের পেছনে এত সময় নষ্ট করেনা যতটা তুই করিস ", " রাজীবকে দেখে সিরিয়াস হতে শেখ, এভাবে চললে মুদীখানাও খুলতে পারবিনা। আমাদের সম্মান কোথায় যাবে " এইসব ছিল নিত্যকার জীবনের চালচিত্র। মারধর - ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা - বাইরের লোকের সামনে ডেকে এনে অপমান, কিছুই বাদ দিতেন আরতিদেবী সন্তুকে মানুষ (?) করার লক্ষে। ধীরে ধীরে সন্তু যেন অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে উঠল। ফুটবল হারিয়ে গেল, কমে গেল ঘুম। সবসময় বকবক করা বদমাস সন্তু কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। অদ্ভুত উদ্বেগে ছটফট করত সারারাত, " এই বুঝি সকালে উঠতে দেরী হয়ে গেল! " চমকে চমকে উঠত অযথাই, খাওয়াদাওয়া কমে গেল। সবসময় সিলেবাস নিয়ে অস্থির থাকত, যা এককালে দুবার পড়লে মুখস্ত হত তাই এখন কুড়িবার পড়লেও মনে থাকে না। একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যেতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখা গেল ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। জিজ্ঞেস করে জানা গেল প্রায় দিন পনের সে টানা ঘুমোয় নি, কারো সঙ্গে মিশতে গেলে তার ভয় করে আজকাল....  " আবার পড়া নিয়ে অপমানিত হতে হবে না তো!" ডাক্তারবাবু পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশু মনস্তাত্ত্বিক এর সাহায্য নিতে নির্দেশ দিলেন পিতামাতাকে। খেলা করে বেড়ানো উচ্ছ্বল সন্তু আজ আর হাসে না, চোখের তারায় খেলা করে জটিল অস্থিরতা ; তার থেরাপি চলছে।

ঐন্দ্রিলা ষোলো বছরের ফুটফুটে কিশোরী। পড়াশুনা ও গানে রীতিমতো দক্ষ। তার একটিই সমস্যা, বেশি মানুষজন সহ্য করতে পারে না সে। তার সামনে দুজন মানুষ আলাদাভাবে নীচুস্বরে কথা বললে তার মনে হয় আলোচনাটা চলছে তাকে নিয়েই! রাস্তায় বেরোলে মনে হয় সবাই তাকিয়ে দেখছে তার দিকে, হাসছে!  আলো বেশি সহ্য হয়না ঐন্দ্রিলার, নিজের ঘরের আয়নাটাও পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখে সে। মা - বাবা কোনোকিছু নিয়ে জোর করতে এলেই চরম ক্ষেপে ওঠে, চিৎকার করে, জিনিসপত্র ছোঁড়ে। একা থাকতেই সে স্বাচ্ছন্দ্য। প্রায়সময়ই বড্ড ক্লান্ত লাগে তাকে, কেমন যেন ঘুম ঘুম ভাব। কিন্তু একবার বিছানায় শুলে ঘুম আসেনা, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে পারে।  একদিন বাবার এক বন্ধু ঐন্দ্রিলার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে সে অস্বীকৃত হয়,  চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে। বাবার সেই বন্ধুই মনোবিদের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দেন। দোনামনা করেও শেষমেশ তার মা বাবা রাজি হন। মনোবিদের কাছে জানা যায় এক আশ্চর্য তথ্য।

শিশুকাল থেকে ঐন্দ্রিলার প্রতিটা কাজে মা টুকতেন, " এটা কোরো না লোকে কি বলবে! " " ওটা কোরো না লোকে ছিঃ ছিঃ করবে "। এই প্রতিটা কাজেই টোকাটুকি ঐন্দ্রিলার মনে সমাজ সম্পর্কে এক প্রবল উদ্বেগের জন্ম দেয়। সে ভাবতে শুরু করে সবাই তাকে দেখছে, তাকে নিয়ে হাসছে - আলোচনা করছে। কারো সামনাসামনি হতে হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করে সে, যদি তার আচরণ নিয়ে সেই লোকটি দশকথা বলে! ঐন্দ্রিলার সোস্যাল লাইফ বা সামাজিক জীবন এরফলে বিপর্যস্ত, আপাতত তার থেরাপি চলছে।
ওপরের এই দুটি ঘটনা আমাদের অনেককিছুই মনে করায়। শিশুকাল থেকে আমাদের অনেকের সাথেই ঘটনাগুলি ঘটেছে।  আমরা অনেকেই বড় হওয়ার সাথে সাথে কোনটি সঠিক আর কোনটি অকারণ বুঝতে শিখেছি, সামলে নিয়েছি। যারা পারেননি বা স্বভাবে অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর তারাই আক্রান্ত হয়েছেন অ্যাংজাইটি ডিজর্ডার বা চরম উদ্বেগজনিত রোগে। বুক ধড়ফড় করা, অত্যাধিক সময়ানুবর্তিতা, অনিদ্রারোগে আক্রান্ত হওয়া, সবসময় অস্থিরতায় ভোগা, হীনমন্যতায় আক্রান্ত হওয়া সবই এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ।

এই রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশী। বেশিরভাগই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অনেকে ঘুমের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অতিরিক্ত উদ্বেগ হৃদযন্ত্রে চাপ তৈরী করে, ফলে পালস রেট আর ব্লাডপ্রেশার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়, সর্বদা একটা বিরক্তি বা হতাশায় ভোগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই রোগের শুরুটা হয় ৮ - ১০ বছর বয়সে, কমবয়সীদের মধ্যে এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বড্ড বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবার অনুঘটক রূপে কাজ করে থাকে।

প্রত্যেক শিশু একে অপরের থেকে ভিন্ন। দয়া করে তাদের মধ্যে তুলনা করে তাদের স্বাভাবিকত্ব নষ্ট করে ফেলবেন না। সকলেই পড়াশুনায় বিদ্যাসাগর হয় না, অসাধারণ রূপের অধিকারীও হয় না অনেকেই। তা বলে তারা ফেলনা নয়, প্রত্যেকের ভেতরেই লুকানো প্রতিভা আছে যা বয়সের সাথে সাথে সমৃদ্ধ হয়। কোনোকিছু নিয়েই অতিরিক্ত উদ্বেগে ভুগবেন না, সময়ের সাথে মানিয়ে নিতে শিখুন। টাইম ম্যানেজমেন্ট স্কিল এক্ষেত্রে কাজে দিতে পারে, দরকারি কাজগুলির একটা রুটিন দিনের শুরুতেই সেরে ফেলুন। আশেপাশের মানুষেরা এমন অযথা উদ্বেগের শিকার হলে মনোবিদের সাহায্য নিন। নিজে সুস্থ থাকুন, অপরকে সুস্থ থাকতে দিন। অপরের সঙ্গে তুলনা টানতে গিয়ে সমস্যার কারণ হয়ে বসবেন না।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours