শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞানচর্চা তখনও মাতৃগর্ভে। অথচ সারা বিশ্বে তখন পরীক্ষানির্ভর আধুনিক বিজ্ঞান অনেকটাই এগিয়ে। বিশেষত পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য, বিজ্ঞানীদের জন্য রয়েছে অসংখ্য বড় বড় নামকরা বিখ্যাত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাগার। কেবলমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশে নেই কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান, নেই বিজ্ঞান শিক্ষার তেমন ভালো কোনো ব্যবস্থা। আর এই যে নেই, অথবা এই যে অভাব তা বোধহয় সব চাইতে বেশি অনুভব করেছিলেন একজন বাঙালী চিকিৎসাবিদ। ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁর নাম।

বেকনীয় বিজ্ঞানদর্শনের অন্যতম অনুসারী ছিলেন ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। তিনি বুঝেছিলেন, বিজ্ঞান বস্তুটি হাতেকলমে করে দেখবার বিষয় ; বিজ্ঞানচর্চা, ধর্মচর্চা অথবা পুরাণ-উপনিষদ চর্চার মতো কেবলমাত্র চর্বিতচর্বণ নয়। জ্ঞনভাণ্ডারে নব নব তথ্য সংযোজন করতে না প‍ারলে ; প্রতিনিয়ত তত্ত্বকে বাস্তবে প্রতিফলিত করতে না পারলে বিজ্ঞানচর্চার ধারা শুকিয়ে যায়, যেমনটি ভারতবর্ষে গিয়েছিল। মহেন্দ্রলালের মতে হিন্দু দার্শনিক চিন্তাধারা বলে যা প্রচারিত তার অধিকাংশ হল, "যাবতীয় বিষয়ে স্থুল, হজম না-হওয়া কতকগুলো ভিত্তিহীন মতামতের পিণ্ড।" এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হল আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চা। মহেন্দ্রলাল দেখেছিলেন ১৮৫৭ সালে দেশে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পরেও ছাত্ররা বিজ্ঞানটা হাতেকলমে শিখতে পারছে না। এর জন্য তিনি কারণ ঠাউরান - সুযোগের অভাব, উপায়ের অভাব এবং উৎসাহদানের অভাব। হাতেকলমে তালিম দেওয়ার জন্য তিনি ইংল্যান্ডের রয়াল ইনস্টিটিউশন ও ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দা অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্সের আদলে এক নুতন ধাঁচের বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করবার কথা ভাবেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে এর মাধ্যমে একদল ভারতীয় বিজ্ঞানীর সৃষ্টি হবে, যাঁরা  জাতীয় পুনর্গঠনে নিজেদের উৎসর্গ করবেন। সকল প্রকার কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের মাধ্যমে লড়াই করবেন। উন্নত, আধুনিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ উপহার দেবেন পুরো মানবজাতিকে। এর জন্য প্রয়োজন ছিল তখনকার দিনে কম করে হলেও একলাখ টাকা। ১৮৬৯ সালে তিনি কাজ আরম্ভ করেন।
১২৭৯ বঙ্গাব্দের 'বঙ্গদর্শন'এ ভাদ্র সংখ্যায় 'ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা' শীর্ষক প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যগুলি নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানপত্রের ধারাগুলি উক্ত প্রবন্ধে উদ্ধৃত হয়েছে। ৪ নং এবং ৫ নং ধার‍ায় বলা হয়েছিল, "ভারতবর্ষীয়দিগকে আহ্বান করিয়া বিজ্ঞান অনুশীলন বিষয়ে প্রোৎসাহিত এবং সক্ষম করা এই সভার প্রধান উদ্দেশ্য আর ভারতবর্ষ সম্পর্কীয় যে সকল বিষয় লুপ্তপ্রায় হইয়াছে, তাহা রক্ষা করা (মনোরম ও জ্ঞানদায়ক প্রাচীন গ্রন্থসকল মুদ্রিত ও প্রচারিত করা) সভার আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্য।" "সভা স্থাপন করিবার জন্য একটি গৃহ, কতকগুলি বিজ্ঞানবিষয়ক পুস্তক ও যন্ত্র এবং কতকগুলি উপযুক্ত ও অনুরক্ত ব্যক্তি বিশেষের আবশ্যক। অতএব এই প্রস্তাব হইয়াছে যে কিছু ভূমি ক্রয় করা ও তাহার উপর একটি আবশ্যকানুরূপ গৃহ নির্ম্মাণ করা, বিজ্ঞানবিষয়ক পুস্তক ও যন্ত্র ক্রয় করা এবং যাঁহারা এক্ষণে বিজ্ঞানুশীলন করিতেছেন, কিংবা যাঁহারা এক্ষণে বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়াছেন, অথচ বিজ্ঞানশাস্ত্র অধ্যয়নে একান্ত অভিলাষী, কিন্তু উপায়াভাবে সে অভিলাষ পূর্ণ করিতে পারিতেছেন না, এরূপ ব্যক্তিদিগকে বিজ্ঞানচর্চ্চা করিতে আহ্বান করা হইবে।" মহেন্দ্রলালের এই আবেদনের ছয়মাস পরে দেখা যায় মাত্র সাড়ে তেরো হাজার টাকা ফান্ডে জমা পড়েছে। বিদ্যাসাগর নিজে এক হাজার টাকা দেওয়া ছাড়াও মহারাজ কালীকৃষ্ণের থেকে পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করে দেন। অক্ষয়কুমার তাঁর উইলে একটা বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। তবে ঠাকুরবাড়ির দেবেন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথের এই বিষয় উৎসাহ ছিল বলে জানা যায় নি। সম্ভবত মহেন্দ্রলালের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিরোধী চিন্তাধারা তাঁদেরকে বিরক্ত করে তুলেছিল। ওই একই প্রবন্ধে আক্ষেপ করে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, "এই অনুষ্ঠানপত্র আজ আড়াই বৎসর হইল প্রচারিত হইয়াছে, এই আড়াই বৎসরে বঙ্গসমাজ চল্লিশ সহস্র টাকা স্বাক্ষর করিয়াছেন। মহেন্দ্র বাবু লিখিয়াছেন যে, এই তালিকাখানি একটি আশ্চর্য্য দলিল। ইহাতে যেমন কতকগুলি নাম থাকাতে স্পষ্টিকৃত হইয়াছে, তেমনি কতকগুলি নাম না থাকাতে উজ্জ্বলীকৃত হইয়াছে। তিনি আর কিছু বলিতে ইচ্ছা করেন না।"

কেবল তাই নয়, শিক্ষিত বাঙালী বিদ্বজ্জনেদের অধিকাংশই বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহ তো দেখানই নি, বরং বিরোধিতাই করেছেন। কলকাতার একদল খ্যাতনাম লোক প্রস্তাবিত এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগলেন। ইয়ংবেঙ্গল-খ্যাত রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, ভারতীয়দের এখন উচিত ইতিমধ্যেই যে সব আবিষ্কার হয়ে গেছে সেগুলোকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করা, নুতন আবিস্কারের কথা পরে ভাবলেও চলবে। ইন্ডিয়া লীগের সদস্য শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেন, এই প্রতিষ্ঠান একটা অপ্রয়োজনীয় জিনিস, একটা বিলাসদ্রব্য মাত্র। লেফটেন্যান্ট গভর্নর রিচার্ড টেম্পল বলেছিলেন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বদলে যদি একটি কারিগরী স্কুল করা হয় তাহলে তাঁরা অনেক টাকা দিতে রাজি। এই টেম্পল হলেন সেই গোষ্ঠীর লোক যাঁরা মনে করেন যে নিছক কতকগুলি ব্যবহারিক সুযোগসুবিধা অর্থাৎ টেকনোলজিই হল বিজ্ঞান চর্চার একমাত্র উপযোগিতা। বিজ্ঞানের মননশীল দিক এবং মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্ক মানসিকতা গড়ে তুলবার দিকগুলি নিয়ে এঁদের মাথাব্যথা থাকে না। তাই টেম্পল চেয়েছিলেন ডঃ সরকারের ওই প্রতিষ্ঠানে তাত্ত্বিক গবেষণার পরিবর্তে স্রেফ কারিগরী প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক যাতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনটি সিদ্ধ হতে পারে। মজার কথা, টেম্পল এই কথা বলা মাত্রই বঙ্গ বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ ত‍াঁর পোঁ ধরলেন। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যাসাগর ছাড়াও মহেন্দ্রলালের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কট্টর বেকনপন্থী সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের রেক্টর এবং বিজ্ঞানের অধ্যাপক জেসুইট ফাদার ইউজিন লাফোঁ। তিনি জোরালো ভাষায় বলেন, ব্রিটিশ শাসক ও তাদের অনুগত ইন্ডিয়া লীগের উদ্দেশ্য হল ভারতীয়দের একটি মিস্তিরিদের জাতিতে পর্যবসিত করা, যাতে কোনোদিনই তারা ইউরোপীয়দের তত্ত্বাবধান ছাড়া চলতে না পারে। পক্ষান্তরে ডঃ সরকার চাইছেন তাঁর দেশবাসীকে এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এই অসম্মানজনক বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিতে। আশীষ লাহিড়ী যথার্থই বলেছেন, "আধুনিক বিজ্ঞানে স্বয়ংভরতা অর্জনের এই দুরপ্রসারী জাতীয়তাবাদী পরিপ্রেক্ষিতটা খুবই উল্লেখযোগ্য। বস্তুত ঐখানেই মহেন্দ্রলালের অন্যান্যতা। সেকিউলার জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানকে সচেতনভাবে মেলাতে চেয়েছিলেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি বিদ্যাসাগর-অক্ষয়কুমার পথেরই পথিক।"

তবে একরোখা মহেন্দ্রলাল কারুর কাছে নতি স্বীকার করলেন না। হাতে যেটুকু টাকা সংগ্রহ হয়েছিল তাই নিয়েই মহেন্দ্রলাল ১৮৭৬ সালের ১৫ই জানুয়ারি, মতান্তরে ২৯শে জুলাই কলকাতার ২১০ নম্বর বৌবাজার স্ট্রিটে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন তাঁর স্বপ্নের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অফ সায়েন্স। একটি উঁচু মানের ল্যাবরেটরি ও লাইব্রেরি গড়ে উঠল বটে তবে পর্যাপ্ত টাকার অভাবে উপযুক্ত অধ্যাপক নিয়োগ করা গেল না, প্রথম পঁচিশ বছর বড় আকারের কোনও গবেষণা কার্যক্রমও নেওয়া গেল না। তবে যত কষ্ট করেই হোক অত্যন্ত দীন দশায় হলেও তাঁর কালটিভেশন অফ সায়েন্স তাঁর মনমতেই চলতে থাকল। ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ডঃ সরকারের বলেছিলেন, "I am impressed more than ever with the necessity of science cultivation by my countrymen not simply for their improvement, but as I have been saying from the very begining, for their very generation ; or I would not have sacrificed a life endeavouring to awaken them to that necessity."

এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য একটি বলিষ্ঠ পরিচালক সমিতি গঠিত হয়। এই সমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, দ্বারিকানাথ মিত্র প্রমুখ। এছাড়া নিয়মিত পরামর্শ দান করে চলতেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। অর্থের অভাবে প্রথমদিকে সক্রিয় গবেষণার বদলে কালটিভেশনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল একদল শিক্ষক তৈরী করা, যাঁরা বৈজ্ঞানিক বিষয় অধ্যাপনা করতে পারবেন। তাই এর কাজকর্ম সীমাবদ্ধ ছিল মুলত বক্তৃতাদান ও আলোচনাসভার মধ্যেই। ঠিক এইসময়ে মাঠে নামলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বদেশীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠানের পাশে দাঁড়াবার পরিবর্তে তিনি তিক্ত সমালোচনায় বিদ্ধ করে তুললেন কালটিভেশন অফ সায়েন্সকে।

(চলবে)

তথ্যসূত্র :
অন্য কোনো সাধনার ফল, আশীষ লাহিড়ী, পাভলভ ইনস্টিটিউট
বঙ্কিম রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ
রবীন্দ্রনাথ : মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান, আশীষ লাহিড়ী, অবভাস
বিজ্ঞানে বাঙালী, অনিল চন্দ্র ঘোষ, প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরী
রবীন্দ্র রচনাবলী দ্বাদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী প্রকাশনী
রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours