শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ :

বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা নাসির উদ্দীন শাহ্।  তিনি বাংলাদেশেও খুব জনপ্রিয়।  আমিও তার অভিনয়ের ভক্ত। যেমন আমি শাহরুখ খান সহ বলিউডের অনেক অভিনেতাকে পছন্দ করে থাকি। সিনেমায়,তো বটেই;  টিভি সিরিয়ালে মীর্জা গালিব চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নাসির উদ্দিন শাহ অমর হয়ে থাকবেন তাতে সন্দেহ নেই। তিনি নায়ক খল নায়ক সব চরিত্রেই সমান তালে অভিনয় করে চলেছেন। তার আরো অনেক যোগ্যতা রয়েছে তার মধ্যে একটি হলো,  ইংরেজি ভাষায় ভাষায় উপর তার অসাধারণ দখল।   আবৃত্তিকার হিসেবে পরিচয় না দিলেও তিনি দারুন আবৃত্তি করে থাকেন।

 তিনি এবার এমন কিছু বলেছেন যা  নিয়ে সারা ভারতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। এমন নয় যে তিনি বিতর্কিত হতে বা বিখ্যাত  হতে এমনটা করেছেন৷ এ অভিযোগটা তার বেলায় অন্তত খাটে না। তিনি আগে থেকেই বিখ্যাত। তিনি বলেছেন ৭০ বছর পর বুঝতে পারলেন মুসলমান হিসেবে তিনি ভারতে নিরাপদ নন। এ কথা বলাতে  কেবল অভিনেতা নয়, মুসলমান হিসেবে ঢাকাতেও তিনি আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ঢাকা, ভারত বিরোধীতায় লাহোর থেকে কোন অংশে পিছিয়ে নেই। ঢাকার অধিকাংশ  মানুষ ভারত বিরোধী এটা নতুন কিছু নয়।  নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর আর একটু বেড়েছে। এর মানে এই নয় যে, অন্য দল  যখন ভারত শাসন করে  তখন ঢাকা, ভারত পেয়ারী হয়ে উঠে! বরং ভারত তোষণ করার জন্য আওয়ামী লীগকে বরবারই নিন্দা করেছে পাকিস্তানপন্থী দল ও ব্যাক্তিবর্গ। আজো তা করে। এমন কি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকেও , পাকিস্তান পন্থীরা রাশিয়ার দালাল বললেও;  ভারত তোষণের দায়েও অভিযুক্ত করে।  যদিও আওয়ামী লীগ ও  কমিউনিস্টদের মধ্যেও কট্টর ভারত বিরোধী কিছু মানুষ আছে। কিন্তু বাংলাদেশের পাকিস্তান পন্থীরা তা,আমলে নিতে চায় না। 

যাই হোক  বিতর্কটা সম্ভবত "৭০ বছর পর"  বলাতে সৃষ্ট হয়েছে। প্রশ্নটা উঠতেই পারে, কেন না, ৭০ বছর কেউ নিরাপদ থাকলো৷ সম্মান খ্যাতি,অর্থ, পুরস্কার সব পেলেন , তা ভোগ উপভোগ করলেন  আর শেষে এসে জানলেন তিনি অনিরাপদ! অনেকটা সেই কৌতুকের মত, "  দিদি আমার স্বামী আমায় ভালোবাসে না"  যদিও অভিযোগকারী সাত বাচ্চার মা হয়ে গেছেন। তার এই বক্তব্য সব মহলে গ্রহনযোগ্য হবে না। যাদের বৌ ও স্বামীর বিরোধে পারিবারিক শালিশ করার অভিজ্ঞতা আছে তারা আমার কথা বুঝতে পেরেছেন।  নাসির উদ্দিন শাহ তার জীবনের শেষ সময়ে এসে মনে করছেন ভারত মুসলমানদের জন্য বসবাসের উপযোগী নয়। এটা ঘোর বজেপি ও ভারত বিরোধী ব্যাক্তি ছাড়া কেউ মানবে না।
ভারতীয় ক্রিকেট ক্যাপ্ট্যান  আজাহার উদ্দীন কে ক্রিকেট বোর্ড শাস্তি দিলে, তখনও কেউ কেউ বলেছিলেন মুসলমান বলে তাকে তাড়ানো হলো। অথচ আমরা কিছু দিন আগে জানলাম, পাকিস্তানী হিন্দু ক্রিকেটারকে পাকিস্তানের মুসলিম ক্রিকেটারদের সাথে খেতে পর্যন্ত দেয়া হয় না। আর একজন পাকিস্তানি  ক্রিকেটার তো শেষে ধর্মান্তরিত হয়ে মুলমান হয়ে গেলেন ( পড়ুন হতে বাধ্য করা হলো)। আমরা কোন দিন শুনিনি ভারতে মুসলিম খেলোয়াড় বলে কাউকে হিন্দুদের সাথে খেতে দেয়া হয়নি। অথবা কোন মুসলিম খেলোয়ার ভারতে ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু হয়ে গেছেন। নাসিরউদ্দিন শাহের অভিযোগ সত্য হলে অর্থাৎ মুসলিমদের জন্য ভারত বসবাসের অনুপযোগী হলে দু একজন মুসলিম পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশে চলে আসার কথা। বরং উল্টো শোনা যায় বাংলাদেশ থেকে কেবল হিন্দুরাই ভারতে চলে যায় না, মুসলিমরাও চলে গেছে।  বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুর কমে যাওয়ার হার দেখলেও তা স্পষ্ট বুঝা যায়।  মুকবুল ফিদা হোসেন ব্যাতিত কোন মুসলিম জীবনের ভয়ে  ভারত ছেড়েছেন বলে শোনা যায়নি। তিনি এখন কাতারে থাকেন, ভারত সরকারও তাকে দেশে আাসার আমন্ত্রণ করেছে। তবে তিনি আর ফিরেননি। তিনি হিন্দু দেবীর নগ্ন ছবি একেঁছিলেন। তার জেলও হয়নি কল্লাও যায়নি। ঢাকা বা লাহোরের কোন সংখ্যালঘু  চিত্রশিল্পী এর বিপরীত কিছু করলে তো এক নিমেশেষেই জীবন চলে যেতো৷ এমন কি ভারতে কেউ মকবুল ফিদা হোসেনের নিজের ধর্ম সম্পর্কিত এমন ছবির একাংশও যদি আঁকতো তার জীবন থাকতো কি না সন্দেহ। তসলিমা নাসরিনকে কোলকাতাতেই থাকতে দেয়া হয়নি বামপন্থী শাসকদের উপস্থিতিতে। কেরালায় তার গায়ে হাত তোলা হয়েছিলো লেখালেখির দায়ে। আর তসলিমা নিজ দেশ থেকে বহিস্কৃত।  তার নামে মামলা ও সাজা হয়ে আছে। অভিনেতা নাসির উদ্দিন শাহের অভিযোগ সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক মার প্যাচের উর্ধে উঠেনি। বরং মুসলমাদের জন্য ভারত বসবাসের উপযোগী নয়, তা দাবি করলে তার প্রতি আরো দুটো প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া যায়, তিনি কি তবে এখন মুসলিম নন? নাকি ভারতের বাইরে অবস্থান করছেন? আপনি   সেকুলার গনতান্ত্রিক ভারত নগরিক হিসেবে সরকারের যে কোন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার অধিকার  রাখেন। যা,আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম সংখাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র পাবেন না।
আরেক জনপ্রিয় বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খান। তিনি আমেরিকার বিমান বন্দরে কেবল মুসলিম হওয়ার  কারনে করা তল্লাশির মুখোমুখি হন। তখন তিনি ব্যাপক আলোচিত হন। এ বিষয় নিয়ে মুভিই তৈরী করে ফেলেন "মাই নেইম ইজ খান, আইম নট আ টেররিষ্ট"।  যা তার সুপারহিট মুভির একটি।
তবে এবার আবার তিনি আলোচিত অনেকটা ঠিক উল্টো বিষয়। তিনি এবার এমন বক্তব্য দিয়েছেন যা আলোচিত সমালোচিত হচ্ছে ভারতে তো বটেই, ঢাকা লাহোর সহ সারা পৃথিবীতে। শাহরুখ খান বলেছেন তিযেন যেন নি মুসলিম, তার স্ত্রী হিন্দু এবং তার সন্তানদের কোন ধর্ম নেই। তারা ভারতীয়। শুনেছি, তিনি এও বলেছেন আমাদের পরিবারের কোন ধর্ম নেই। এ যেন মৌচাকে ঢিল দিলেন!

 তার এই বক্তব্য আমার ফেসবুকের টাইম লাইনে শেয়ার করার প্রেক্ষিতে আমার ফেসবুক বন্ধুরা আমার সমালোচনা করেছেন প্রকাশ্যেই। কেউ ইনবক্সে এবং ফোনে অনেকটা খেদ নিয়েয়েই বলেছেন, আমি কেন শাহরুখ খানের এমন  ধর্ম বিরোধী বয়ান প্রচার করছি! এমন কি আমার পরিবারের লোকজনও কঠোর সমালোচনা করেছে শাহরুখ খানের বক্তব্যের। ফেসবুকে শেয়ার করার জন্য আমার নিন্দাতো  করেছে। এতেই বুঝা যায়, এই বক্তব্য দেয়ার পর শাহরুখ খানের অবস্থা কি হতে পারে। ঢাকার অনেকেই তো তার সিনেমা বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও এরা আবার দীপিকা পাডুকনোর ছবি বয়কট করায় বিজেপির কঠোর সমালোচনা করেছিলো! স্ববিরোধীতা সম্ভবত এ উপমহাদেশের মজ্জাগত একটি রোগ। 
ভারতের কোন হিন্দুধর্মাবলম্বী বলিউড অভিনেতা যদি বলতেন, "আমাদের কোন ধর্ম  নেই" এ নিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কখনোই এতটা হৈচৈ বাধাতো না। এ বিষয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তুলনামূলক অনেক সহিষ্ণু। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বেলায় যা দেখা যায় না। ভারতের প্রতিবেশী মুসলিম দেশে  কোন মুসলমান এখন এমন  কথা বললে খুব বিপদে পরে যেতো। আর  মধ্যপ্রাচ্যে বললে, তো জেল অথবা ফাঁসি হতো।

লেখক কবি,গীতিকার, কাহীনিকার বামপন্থী জাবেদ আক্তার অনেক আগেই নিজেকে ধর্মহীন বলে প্রকাশ্যে ঘোাষনা করেছেন।  বাবরি মসজিদ  বিতর্ক নিয়ে করা এক  প্রশ্নে, প্রকাশ্যে এমনও বলেছেন যে, পৃথিবীতে কোন মসজিদ মন্দির গীর্জা না থাকলে তিনি খুশি।  অর্থাৎ জাবেদ আক্তার ধর্মমুক্ত পৃথিবী কামনা করেন। জাবেদ আক্তার এমনটা বলেছেন, তা ভারতেরই অনেকে জানেন না।  ঢাকার মানুষ তা আরো কম জানেন। সম্ভবত এ জন্য তাকে নিয়ে বিতর্ক কম।।
তবে সন্দেহ নেই নাসিরুদ্দিন শাহ,  ভারত ও বিজেপির সমালোচনা করে আরো বেশি জনপ্রিয় হবেন। সে তুলনায় শাহরুখ খান হয়তো পিছিয়ে পরবেন। এটা অবশ্য আমার অনুমান মাত্র, ভুলও হতে পারে। কেন না দীপিকা পাডুকোন, চকলেট  হিরো কনহাইয়ার বিজেপি বিরোধী  মিছিলে যোগ দেয়াতেও তার  "ছাপাক" ছবি ফ্লপ করেছে।

তবে শাহরুখ খান এমন সময়োপযোগী সাহসী কথা বলায় তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রতিও যে  জীবনের  হুমকি আসতে পারে; তা সহজেই অনুমেয়। ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এপিজে আবুল কালামের মৃত দেহ সৎকারের সময়ও খুব কম মুসলিমই উপস্থিত ছিলেন। কারন মনে করা হয়, ভারতীয় কট্টর মুসলিমরা মনে করে তিনি  বিজেপির প্রেসিডেন্ট ছিলেন!

সত্য এই যে, ধর্মান্ধতা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে দেয় না। মানুষকে, মানুষ হিসেবে দেখার জন্য প্রয়োজন অসাম্প্রদায়িক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা। যা এ উপমহাদেশের শাসকেরা দিতে চান না। এ উপমহাদেশের পরিবারগুলোতেই মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা অনুপস্থিত।  আর যখন কোন পরিবার মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা থেকে তার শিশুদের বঞ্চিত রাখবে, সে সমাজ ও রাষ্ট্র মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক হতে পারে না।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours