রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

মালবিকা কলেজপড়ুয়া ঝকঝকে তরুণী। বড্ড শান্তস্বভাবা ও পড়াশুনায় ভালো হওয়ার জন্য শিক্ষক - শিক্ষিকাদের বড্ড প্রিয়। আবার বন্ধুদেরও নোটস দিতে শরনাপন্ন হতে হয় মালবিকার।
বেশ রোদছায়া মেখে আপাতদৃষ্টিতে ভালো কাটছিল দিনগুলি৷ সমস্যা শুরু হল তখন, যখন মালবিকার প্রেমিক অঞ্জন তাকে ছেড়ে অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়াল। কলেজের করিডরে অঞ্জনকে ধরে অনুনয় বিনয়, কান্নাকাটি, আত্মহত্যার হুমকি দিয়েও যখন কাজ হল না ; কলেজের লাইব্রেরীতে একদিন সে ভয়ংকরভাবে আঘাত করে বসল  অঞ্জনের বর্তমান প্রেমিকাকে। যথারীতি পুলিশ এল, মালবিকার বাবা তাঁর প্রতিপত্তি ও টাকার বলে অনেক কষ্টে মেয়ের জামিন করিয়ে আনলেন বটে ; কিন্তু সেদিনের পর থেকে একটু একটু করে বদলে গেল মালবিকা। অসম্ভব চুপচাপ হয়ে গেল, বাড়ি থেকে বেরোত না, বন্ধ হল কলেজ। একদিন আচমকাই নিজে কাঁচি দিয়ে এবড়োখেবড়ো করে কেটে ফেলল সাধের লম্বা চুলগুলো, হাত পায়ে বয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগল ব্লেডের দগদগে আঁচড়। স্লিপিং পিলস, নিকোটিন আর মাদকের খপ্পরে পড়ে তলিয়ে গেল ডিপ্রেশনের অতল গহ্বরে। বাড়ির লোক শাসন করে নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছিলেন পরিস্থিতি। ফল হল সম্পূর্ণ বিপরীত। শান্ত মালবিকা হটাৎ ক্ষেপে উঠল। জিনিস ভাঙচুর, অস্রাব্য গালিগালাজ অনবরত মুড সুইং এর ফলে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ল সে। যতদিনে মা - বাবা পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে মনোবিদের সাহায্য নিলেন, ততদিনে মালবিকা অন্তত ছয়বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে গুরুতর জখম হয়েছে। এখন চিকিৎসা ও কাউন্সিলিং চলছে তার। শিশুকাল থেকে বাবা - মার ঝগড়া ও অসুস্থ সম্পর্ক দেখে নিরাপত্তাহীনতার মাঝে বেড়ে ওঠা মালবিকা নিজের প্রেমে প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারেনি। চরম কষ্ট পেয়ে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। তার থেকেই আক্রান্ত হয় বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারে।

কর্পোরেট সেক্টরে উঁচু পদে কর্মরত সুনন্দ, বার দুই বেস্ট এমপ্লয়ি অ্যাওয়ার্ড জয়ী। অফিসে বড়ো ভালো ছেলে বলে পরিচিত সুনন্দ নববিবাহিতা স্ত্রী রাকাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। অফিসে থাকাকালীন বার দশেক ফোন, সবসময় সাথে নিয়ে ঘোরা, চব্বিশ ঘন্টা অতিরিক্ত খেয়াল রাখার প্রবনতাকে মেনে নিতে পারেনি রাকা। নিজের জন্য পারসোনাল স্পেস চেয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সকলের কাছে আদর্শ স্বামীর মুখের ওপর " এত ন্যাকামো সহ্য হয়না " বলে চলে গিয়েছিল বাপের বাড়ি। তিনদিন পরে বাড়ির দরজা ভেঙে সুনন্দর পচাগলা ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়, শরীরের চামড়ায় জ্বলজ্বল করছিল সিগারেটপোড়ার দাগ। জানা যায় মৃত্যুর দুদিন আগে চাকরি ছেড়েছিল সে, সবাইকে জানিয়েছিল স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে বাইরে। পারফেক্ট এমপ্লয়ি মৃত্যুর এতটাই পারফেক্ট পরিকল্পনা করেছিল যে পচা গন্ধ বের হওয়ার আগে পর্যন্ত টের পাননি প্রতিবেশীরাও!
বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার বা সংক্ষেপে বিপিডি। আজ ভারতের প্রায় দশকোটি মানুষ এই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। নিজের অতিরিক্ত আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, চুড়ান্ত হতাশায় ভোগা, কাউকে নিজের মনের কথা খুলে বলতে না পারা, অবদমিত ডিপ্রেশন ডেকে আনে এই রোগকে। এর জিনগত ব্যাপ্তি তেমন খুঁজে পাওয়া না গেলেও বলা হয় যেসব পরিবারে আগে এই রোগের ইতিহাস আছে তাদের পরবর্তী পুরুষের মধ্যেও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবনতা লক্ষ করা যায়। সেরাটোনিন হরমোন ক্ষরণের তারতম্যের ফলেও এর প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যায়, তবে সবচেয়ে বেশি যেটা দায়ী তা হল অতিরিক্ত ডিপ্রেশন ও আবেগপ্রবনতা।

এই রোগে আক্রান্তরা চরম আবেগী ও নরম স্বভাবের হয়ে থাকে৷ সম্পর্কে জটিলতা ও প্রিয় মানুষের ছেড়ে যাওয়া এরা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। নিজেকে এর জন্য দায়ী করে নিজেকে ঘেন্না করতে শুরু করে, অসম্ভব হতাশায় ভোগে, মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, ধীরে ধীরে ডিপ্রেশন ব্ল্যাকহোলের মত গ্রাস করে তার সর্বস্ব সত্ত্বাকে৷ এই রোগে আক্তান্তের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা মারাত্মক বেশি, এছাড়া সেল্ফ হার্ম বা নিজেকে আঘাত করা, সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একপ্রকার বন্দী করে ফেলা, আচমকা ক্ষেপে ওঠা, অপরকে আঘাত করে ফেলা অপরাধে জড়িয়ে পড়া, রাগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারা ও চরম মুড সুইং এ ভোগা এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ।

নিজের প্রিয়জনের মধ্যে এইসব লক্ষন দেখা দিলে অবশ্যই শীঘ্র মনোবিদের সাহায্য নিন, কাউন্সিলিং করান৷ প্রিয়জনের পাশে থাকুন, বিরক্ত হয়ে ছেড়ে যাবেন না । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শৈশবের নিরাপত্তাহীনতা, যৌন অত্যাচার এই রোগকে ডেকে আনে ; তাই আপনার সহচর্য রোগীকে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তুলতে পারে। এতে সুস্থ হওয়ার চান্স বাকিদের তুলনায় বেশি,  একটু ভালোবাসা, সহনশীলতা এদের কাছে সঞ্জীবনীর কাজ করে। দিনে অন্তত দুইবার মেডিটেশনে বসুন, অতিরিক্ত আবেগ - রাগ নিয়ন্ত্রণে আসবে৷ সাফল্য যদি মেনে নিতে পারেন ফেলিওরকেও মানতে শিখুন, রাতের শেষে দিন অবশ্যই আসে। সবার আগে নিজেকে ভালোবাসুন, " আমিও পারি " আপ্তবাক্যটা মাথায় ছেপে নিন। সবাই সবার জন্য পারফেক্ট হয়না, তাই যে যেতে চাইছে তাকে যেতে দিন ; নিজের ওপর ফোকাস করুন। সকলের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলুন, হাসিমজা করুন, বই পড়ুন, গার্ডেনিং করুন। নিজেকে নিয়ে খুশি থাকুন, দেখবেন এ রোগ আপনাকে ছুঁতে পারবে না। জীবন একটাই, তাই সেটাকে প্রাণখুলে বাঁচুন, আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। এমন রোগীর পাশে থাকুন, একটু যত্ন করুন। আপনার সহচর্য ও মনোবিদের ওষুধ ও থেরাপি তাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলবে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours