শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, উত্তরপ্রদেশ:

মহেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর ১৩১২ বঙ্গাব্দে 'বিজ্ঞানসভা' শীর্ষক রচনায় রবীন্দ্রনাথ আবার সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতি আক্রমণ আরম্ভ করলেন, "বিজ্ঞানচর্চাসম্বন্ধে দেশের এমন দুরবস্থা অথচ এই বিদ্যাদুর্ভিক্ষের মাঝখানে বিজ্ঞানসভা তাঁহার পরিপুষ্ট ভাণ্ডারটি লইয়া দিব্য সুস্থভাবে বসিয়া আছেন।" রবীন্দ্রনাথের সমস্যাটা কি বিজ্ঞানসভার 'পরিপুষ্ট ভাণ্ডার'টি নিয়ে? বোধহয় তা নয়। বিজ্ঞানসভার কাছে রবীন্দ্রনাথের দুটি প্রত্যাশা - (১) "যদি জগদীশ ও প্রফুল্লচন্দ্রের শিক্ষাধীনে দেশের কয়েকটি অধ্যবসায়ী ছাত্রকে মানুষ করিয়া তুলিবার ভার বিজ্ঞানসভা গ্রহণ করেন, তবে সভা এবং দেশ উভয়েই ধন্য হইবেন।" এবং (২) "স্বদেশে বিজ্ঞান প্রচার করিবার দ্বিতীয় সদুপায়, স্বদেশের ভাষায় বিজ্ঞান প্রচার করা। যতদিন পর্যন্ত না বাংলাভাষায় বিজ্ঞানের বই বাহির হইতে থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটির মধ্যে বিজ্ঞানের শিকড় প্রবেশ করিতে পারিবে না।" এই দুটি কাজ বিজ্ঞানসববা করছে না বলে রবীন্দ্রনাথের অভিযোগ। আর সেজন্য তাঁর বক্তব্য, "বিজ্ঞানসভার মতো কর্মশূন্য সভা আমাদের জাতির পক্ষে লজ্জার বিষয়। ইহা আমাদের জাতির পক্ষে নিত্য কুদৃষ্টান্ত ও নিরুৎসাহের কারণ।"

মহেন্দ্রলাল কিন্তু স্পষ্টভাবেই বিজ্ঞানসভার উদ্দেশ্যটি ব্যক্ত করেছিলেন। এখন প্রশ্ন হল, বিজ্ঞানসভা কি আদৌ কর্মশূন্য ছিল? বোধহয় রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির ভ্রান্ততা প্রমাণের জন্যেই চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামনের পদার্পণ ঘটেছিল কলকাতার এই প্রতিষ্ঠানে ১৯০৭ সালে। শিক্ষকতার অবসরে তিনি এখানে নিরলস গবেষণা চালিয়ে যেতেন। এখানে গবেষণা করেই ১৯২৮ সালে তিনি 'রামন এফেক্ট' আবিষ্কার করলেন যা তাঁকে নোবেল পুরস্কার এনে দিল। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠানের নিকট নিজের চিরকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রামন বলেছিলেন, "It was the late Dr. Mahendralal Sarkar, who, by founding Indian Association for the cultivation of Science, made it possible for the scientific aspirations of my early years to continue burning brightly."  রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার এর থেকে বড় জবাব বোধহয় আর হয় না।

এখানে আর একটা ব্যাপার অনুধাবনযোগ্য। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয় কখন হয়? আশীষ লাহিড়ী এই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, উৎপাদনশিল্পের কাছে হার্ড সায়েন্স আগে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে, তারপর বিজ্ঞান জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়। বিজ্ঞানে উন্নত সব দেশেই তাই হয়েছে। সমাজের মধ্যে বিজ্ঞানের চাহিদা তৈরী না হলে বিজ্ঞান কোনোকালে কোনোদেশেই জনপ্রিয় হয় নি। "অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথের মতে, অ্যাসোসিয়েশন যে কাজ করবার জন্য গঠিত হয় নি, সেই কাজটাই তার সাফল্যের একমাত্র মানদণ্ড !"
যাইহোক, যে কথা বলছিলাম। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত রামন এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। এরপর একে একে কালটিভেশনের সঙ্গে জুড়তে থাকেন বহু প্রথিতযশা বিজ্ঞানী। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা পদ চালু করা হলে প্রথম অধিকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্যারিমোহন মুখোপাধ্যায়। তার পর পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন চিকিৎসক নীলরতন সরকার, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আরেক বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান তত্ত্বের জনক। এছাড়া ১৯২৮ সালে আরেক বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এই প্রতিষ্ঠানে এলেন। তখন এখানে তৎকালীন প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের সাথে পরিচিত হন যার মধ্যে ছিলেন মেঘনাদ সাহা, শ্রীনিবাস কৃষ্ণান প্রমুখ। এখানে এসেই তিনি নক্ষত্রের অভ্যন্তরীন ঘটনাবলী এবং জীবনচক্র নিয়ে তিনি চিন্তা করতে শুরু করেন এবং জীবনের প্রথম গবেষণামূলক প্রবন্ধটি লেখেন। এই গবেষণাপত্রের নাম ছিল 'Thermodynamics of the Compton Effect with Reference to the Interior of the Stars'। এই গবেষণাপত্রটি পরবর্তী বছর তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগেসের বার্ষিক অধিবেশনে পাঠ করেছিলেন। ১৯২৮ সালেই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আর্নল্ড সমারফেল্ড ভারত ভ্রমণে এসে আইএসিএস-এ বক্তৃতা দেন।

১৯৪৬ সালে মেঘনাদ সাহা এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রশংসনীয় কিছু উদ্যোগ নেন। তিনি একটি সক্রিয় গবেষণা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে মূলত এক্স রশ্মি, আলোকবিজ্ঞান, চুম্বকত্ব এবং রমন ক্রিয়া সংক্রান্ত মৌলিক গবেষণা পরিচালিত হতো।পরবর্তীকালে যাদবপুরে প্রতিষ্ঠানের আরেকটি প্রাঙ্গণ প্রতিষ্ঠা করা হয় যেখানে শিক্ষাগত গবেষণা ও শিল্প কারখানা স্থাপনের উপযোগী জ্ঞানের সমন্বয় ঘটানো হয়। পরবর্তীতে আইএসিএস-এর মূল গবেষণাগার বৌবাজার স্ট্রিট থেকে সরিয়ে যাদবপুরের বর্তমান অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, ঔপনিবেশিক শাসনকালে যে কোনও গঠনমূলক কাজ করতে গেলেই ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় কিছু না কিছু আপোষ করতেই হত। এটা রামমোহনকে করতে হয়েছিল, বিদ্যাসাগরকেও করতে হয়েছিল, এমনকি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার সময় রবীন্দ্রনাথকেও করতে হয়েছিল। এগুলো যুগের সীমাবদ্ধতা। এমনকি আজ ২০২০ সালের স্বাধীন ভারতে কিছু গঠনমুলক কাজ করতে গেলে হয়তো আপনাকেও করতে হবে। তবু সেই পরিপ্রেক্ষিতেও ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ব্রিটিশ শাসকদের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পুর্ণ দেশীয় সহায়তায় এতবড় প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছিলেন। মহেন্দ্রলাল কোনও বৈজ্ঞানিক আবিস্কর্তা নয়, কোনও মৌলিক গবেষণায় তাঁর যশ অর্জিত হয় নি। কিন্তু এদেশে বিজ্ঞান চর্চার আদি গুরু বলে তিনি চিরকাল সকল বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের নমস্য থাকবেন। কালটিভেশন অফ সায়েন্স কিভাবে অর্থ সংগ্রহ করেছিল, ব্রিটিশ শাসনযন্ত্রের প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েও প্রবল অর্থসংকটে পড়েও ডঃ সরকার কিভাবে জাতীয় বিজ্ঞানচর্চার দীপটি টিমটিম করে হলেও সযত্নে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন, এ তথ্য তো রবীন্দ্রনাথের অজানা থাকবার কথা নয়। "তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানসভার অনেক টাকা ও স্থাবর সম্পত্তি নিয়ে, বিশেষ করে রাজপুরুষদের অকৃপণ দাক্ষিণ্য নিয়ে, বার বার তাঁর বক্রোক্তি আমাদের অস্বস্তি জাগায়।" তাই প্রশ্ন জাগে, রবীন্দ্রনাথের মতো স্বদেশপ্রেমিক মানুষ কেন মহেন্দ্রলালের এত বড় কর্মপ্রয়াস সম্পর্কে আর একটু বিবেচনাপরায়ণ হলেন না?

এ বিষয়ে আমার একটু অন্য থিয়োরী আছে। রবীন্দ্রনাথ নাস্তিকদের ঠিক পছন্দ করতেন না। আমরা দেখতে পাই, ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা তত্ত্ববোধিনীকে জনপ্রিয় করবার জন্য বিশাল অবদান রাখা সত্ত্বেও অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ চরম নির্লিপ্ত। অক্ষয়কুমারের মতো ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকারও কিন্তু ঘোষিত নাস্তিক ছিলেন !

(সমাপ্ত)

তথ্যসূত্র :
অন্য কোনো সাধনার ফল, আশীষ লাহিড়ী, পাভলভ ইনস্টিটিউট
বঙ্কিম রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ
রবীন্দ্রনাথ : মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান, আশীষ লাহিড়ী, অবভাস
বিজ্ঞানে বাঙালী, অনিল চন্দ্র ঘোষ, প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরী
রবীন্দ্র রচনাবলী দ্বাদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী প্রকাশন
রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours