নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেট, অস্ট্রেলিয়া:

পুরুষ শাসিত সমাজ বলে বাংলায় একটা কথা চালু আছে । নারী স্বাধীনতা প্রায় যে কোন লেখায় আলোচনায় বিতর্কে এসে পড়ে এই তিন শব্দের সমন্বয় । এবং শব্দ অর্থও ইংরেজিতে 'মেল ডমিনেটেড সোসাইটি' বলতে যা বুঝায় তার মধ্যে বৃহত্তর সমাজে নানা কাজ কর্মের ক্ষেত্রে পুরুষের সংখ্যা সমষ্টির ইঙ্গিত যতোটা আছে, শাসনের ইঙ্গিত ততটা নাই । সেটা আসলে 'পুরুষ শাসিত সমাজ' কথায় স্পষ্ট।
আমি ঠিক জানি না নারীর স্বাধীনতা অর্জনের পথে অন্তরায় হিসেবে পুরুষকেই চিহ্নিত করার জন্য কে প্রথম এই তিনটি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন । আর এই পুরুষকে প্রতিপক্ষ খাড়া করার প্রচেষ্টা অন্তত আমাদের দেশে কতটা ফলবতী হয়েছে তাও ঠিক জানি না । তবে নারীদের এই জেহাদে মূল সমস্যাটা বুঝতে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে অনেক ।অন্যদিকে সমাজ পরিবর্তনের মূল ধারার সঙ্গে পুরুষ শাসিত সমাজ যে নারী স্বাধীনতার অন্তরায়, এই ধারণাটি ঠিক মিশ খায়নি।
আমার জানা মতে অনেকেই, বিশেষত সমাজ সেবায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত এবং বিভিন্ন সামাজিক স্তরের মানুষের সেই স্তরে অবস্থানের ধরণ সম্পর্কে অভিজ্ঞ অনেক মহিলারাও পুরুষ শাসিত সমাজ গোছের কথাবার্তাকে নিছক শ্লোগান, ফ্যাশনেবল এবং 'আরবানজাগরণ' যেটাকে শহুরে সংলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের ধারণা এটা মূলত সামাজিক সমস্যা ,যে সমস্যার কেন্দ্রে পরাধীন হিসেবে নারীরা যেমন আছেন, তেমনি আছেন পুরুষরাও । যে সমাজে সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ও আধিপত্য ধনীকে আরও ধনী করে রাখে দরিদ্রকে ঠেলে দেয় আফ্র বেশী দরিদ্রের দিকে, একটি শ্রেণীর শিক্ষা সংস্কৃতি অর্থবল ইত্যাদি প্রবল শক্তিশালী হয়ে অন্য শ্রেণিকে করে রাখে কোণঠাসা, এই বৈষম্যের সেই সমাজই অনুন্নত ও বঞ্চিতদের মধ্যে সৃষ্টি করে যায় এমন কিছু আচার ব্যবহার ও মনোভাব যা প্রায় বাধ্যতামূলকভাবে সেই সব শ্রেনীর মধ্যেও আনে নারী পুরুষে বিভেদ । যার ফলে অনেক সময়ে শিকার হতে হয় নারীদের।
আমার মনে হয় -সমাজ থেকে মূল বৈষম্যগুলি দূর হলে নারীও পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক বৈষম্যের মনোভাব ও পরিবর্তন আসতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে নারীর পরাধীনতার কারণগুলি অন্তর্হিত হবে আস্তে আস্তে।
পরস্পর  বিরোধী যে দুটি মত নিয়ে যা বললাম তা নিয়ে যদি কেউ  ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করে ,যে আমার যুক্তি কোনদিকে, তবে আমি দ্বিতীয়ার্ধে সায় দেব বিলক্ষণ । আমি বিশ্বাস করি যে শহরে শিক্ষিত ও অর্থনৈতিক ভাবে সফল নারীদের একাংশ নারী স্বাধীনতাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেন যে ব্যাখ্যার সঙ্গে অনুন্নত অঞ্চলের অশিক্ষিত ও অর্থনৈতিক ভাবে পরাধীন নারী সমাজের পরাধীনতার সম্পর্ক খুবই দুরের। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর পরাধীনতার সার্বিক এবং শ্রেনীগত এই পরাধীনতায় পুরুষরাও আক্রান্ত।
আমি এও বিশ্বাস করি যে সাধারণ ভাবে পুরুষরা নারী বিদ্বেষী নন এবং নারীকে প্রকৃত অর্থে পরাধীন করে রাখার তার এমন কোন সৌভাগ্য বৃদ্ধি হয় না যাতে সে নারীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করাটাকে তার অধিকার বলে মেনে নেবে । যদি অন্যরকম হতো তাহলে আমাদের সমাজে মা ,স্ত্রী, বোন, মেয়ে যে শ্রদ্ধা প্রেম বা স্নেহ এমনকি প্রশ্রয়ও পান, সেটা নিশ্চয় পেতেন না। অশিক্ষিত এবং বংশানুক্রমিক ভাবে সংস্কার, লোকাচার ও অন্ধ বিশ্বাসে আচ্ছন্ন পুরুষদের কথা আলাদা । কিন্তু শিক্ষিত পুরুষদের মধ্যে যদি কেউ নারী স্বাধীনতাকে পুরুষের স্বাভাবিক অধিকারের পরিপন্থী বলে মনে করেন তা হলে ধরে নিতে হবে তিনি সুস্থ মস্তিষ্ক ও মানসিকতার মানুষ নন। এই কথার জের টেনে বলতে পারি বিকৃত মনা পুরুষদের মতোই শিক্ষিত অবস্থাপন্ন সমাজেই আছেন এমন অনেক নারী , যারা নারীর স্বাধীনতার বিশ্বাস করা দুরে থাক , অকারণ নারী বিগ্রহে সক্রিয় ভূমিকা নেন । শহর আর গ্রামে বধু নির্যাতন ও হত্যার দৃষ্টান্ত প্রায় গোচরে আসে । সে গুলোর চক্রান্তের কেন্দ্রে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শ্বাশুড়ী বা নন্দকে। এটা কেন হয় তবে ? এ গুলোর মনস্তাত্বিক ব্যখ্যাও চোখে পড়ে । পরের মেয়ে আর ঘরের মেয়ের দ্বন্দ্ব , ছেলে বা ভাইয়ের উপরে অধিকার হারানোর ভয় , পণ যৌতুক নিয়ে সনাতন লোভ ইত্যাদি নিয়ে ব্যাখ্যা - নিতান্তই কুষ্ঠের গায়ে ব্যান্ডেজের মত । নারী ও পুরুষের " সমানাধিকার " নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে তখন আমাদের ভাবা উচিত সমগ্রভাবে সকলের জন্য সামাজিক সমানাধিকার অর্জিত না হলে আলাদা ভাবে নারী স্বাধীনতার প্রশ্ন ওঠে না। আর এই সমানাধিকার দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র শক্তি পৌরুষত্ব অর্জন করলে শিক্ষা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও যেসব সাম্য আসবে তাতে শুধু পুরুষই লাভবান হবেন না, হবেন নারীও। আমাদের মনে রাখা দরকার এসব প্রেক্ষিতে "স্বাধীনতা," "অধিকার" ইত্যাদি শব্দ যতটা প্রয়োজনীয় এই মুহুর্তে ততটাই ভুল ব্যাখ্যায় অস্বচ্ছতায় ভারাক্রান্ত । ব্যক্তিগত ধারণা ও মূল্যবোধ দ্বারা এগুলো প্রায় এমন অর্থ পায় যে সামাজিক সমগ্রতায় তা হয়ে পড়ে অর্থহীন। নারীমুক্তি নারী স্বাধীনতা নিয়ে পশ্চিমের দেশ গুলিতেও আন্দোলন আলোড়ন চলছে দিনের পর দিন , কোথাও কোথাও তার চূড়ান্ত রূপ দেখা দিয়েছে পুরুষ - বিদ্বেষ এবং স্বাধীনতা অর্জনের নামে এক ধরণের ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতায় । বর্তমানে আমাদের দেশের "বাদী" সম্প্রদায়ের বাড়াবাড়ি দৃষ্টান্ত দেখে হয়ত নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী জারমেন গ্রীয়ারও ভ্রু কুঁচকে বলবেন তিনি এমনটি চাননি । পুরুষ নির্ভরতা থেকে মুক্তি ও পুরুষের সমানাধিকার দাবির অর্থ এই নয় যে নারী পুরুষকে শুধুই প্রতিপক্ষ ভাববেন । তাই নারী আন্দোলনকারীদের বলতে ইচ্ছা করে, অধিকার অর্জন করতে গিয়ে এমন কিছু উদ্ভট কাজকর্মে লিপ্ত হবেন না যা তাঁকে সুতরাং সামাজিক কাঠামোকে করে দেবে অবিন্যস্ত। আমারও ধারণা পুরুষের মত হয়ে ওঠায় পুরুষ যা যা করে এবং চরিত্রগত ভাবে যতটা বেপরোয়া হয়ে চলতে পারে , সে গুলির অনুকরণে স্বাধীন নারীর মুক্তি নেই । তাঁর মুক্তি বিরোধীতায় নয় বরং নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টিতে , যার দ্বারা পরিবর্তিত হবে পুরুষেরও মূল্যবোধ ,বিশেষত তার ভ্রান্তিগুলি । অনেকে বলেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই নাকি নারী স্বাধীনতার শেষ কথা। এটা আংশিক সত্যে । কারণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীকে স্বনির্ভর করে তুললেও এই স্বনির্ভরতা তার মানসিক ও শাররীক আকাঙ্খা গুলোকে পূরণ করতে পারে না । সে জন্য কেবল মাত্র পুরুষকেই তার প্রয়োজন । একই কারণে পুরুষেরও প্রয়োজন নারীকে । এই পরস্পর নির্ভরতার মধ্য দিয়েই তৈরী হতে পারে নারী পুরুষের স্বাধীন কিন্তু সম্ভ্রমময় সম্পর্ক , সে সম্পর্ক শুধুই গাহস্থ্য ও শাররীক প্রয়োজনে সীমাবদ্ধ নয় । সে সম্পর্ক বুদ্ধি ও হৃদয় বিনিময়ের , মুখোমুখি বসবারও।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours