ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:
শোভারানী ভেঙে পড়ল কান্নায়! চোখে আঁচল চাপা দিলেন তারাসুন্দরী! আর হটী কান্নায় লুটিয়েও পড়ল না, মুর্চ্ছিতাও হ'ল না! দেওয়ালে ঠেস দিয়ে শূন্য দৃষ্টি মেলে বসে রইল! যেন পাথরের প্রতিমা!
একে একে সবাই বেরিয়ে গেলেন! এখন শোক সন্তপ্তদের অশ্রুপাতে পরিবেশ শান্ত হতে দেওয়ায় রেওয়াজ! তারপর করতে হবে অন্তিম সংস্কারের আয়োজন!
রূপেন্দ্রকে অন্তিম যাত্রায় ফুল চন্দনে সাজিয়ে দিলেন শোভারানী আর তারাসুন্দরী! হটী এখনো দেওয়ালে ঠেস দিয়ে নিশ্চল বসে আছে!সে নির্বাক, নিস্পন্দ!ইতি মধ্যে সন্ধ্যা নেমেছে!
নন্দ খুড়ো এই শোকবহ পরিবেশে তাঁর কুটিল চাল চাললেন!সকলের উদ্দেশ্যে বললেন," রূপেনের শববাহী পাবে কোথায়? ওর তো প্রায়চ্চিত্ত হয় নাই সোঁয়াই গাঁয়ের বামুনরা তো ওর শববহন করবে না!"
প্রতিবাদ করলেন,তারাপ্রসন্ন," এটা কি বলছো? মৃত্যুতীর্থে যে পৌঁছে গেছে তার আবার জাত কি?"
নন্দ কুমীরের কান্না কেঁদে চাদরে মুখ ঢেকে বললেন," কি করব ভায়া! বলতে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে! কিন্তু শাস্ত্রের এটাই বিধান জাতিচ্যুতের কেউ শশ্মানযাত্রী হতে পারবে না!"
প্রতিবাদ করে জীবন বলল," আমাদের বিধান দিতে হবে না! আমরা দুভাই ওদের বহন করে নিয়ে যেতে পারব!"
আবার তির্যক মন্তব্য করলেন নন্দ খুড়ো," তা দুজন হলে তো খাটিয়ায় নিয়ে যেতে পারবি না! লেপ,কাঁথা আর তালাই মুড়ি দিয়ে বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে হবে! তা বাবা শিবনাথ জাত দিতে রাজী আছো তো?"
চিৎকার করে শিবনাথ বলে ওঠে ,"আজ্ঞে হ্যাঁ ,বাবা মশাইও রাজী হবেন! আমরা একুনে তিনজন! আপনি আমাদের গোটা পরিবারকে ' একঘরে করে দিন!"
নন্দ বলেন," বটে!! তা চতুর্থ বাহকটি কে?"
ভীড়ের মধ্য থেকে আওয়াজ আসে " আমি কাঁধ লাগাবে বাবু মশা, আমি সন্ন্যাসী আছে! আমার কুন জাত নাই !"
নিদারুন দুঃসংবাদটি পেয়ে বৃদ্ধ একমুঠিবাবা চলে এসেছেন!
জীবন বলে ওঠে," আপনাদের সমাজ আমাদের একঘরে করলেও আমাদের কিছু আসে যায় না! কিন্তু মনে রাখবেন, 'আরোগ্য নিরেতনে এখনো কিছু রোগী মরতে বাকী আছে ! সমাজপতি হিসাবে তাদের দ্বায়িত্ব আপনার !আমি কাল থেকে পীরপুরে যাবো!এ গাঁয়ের কারও চিকিৎসা করবো না !"
নন্দখুড়ো গুম হয়ে রইলেন!
সমাজপতি মশায় বললেন," এতো ভারী অন্যায় কথা জীবন!....
বাধা দিয়ে জীবন বলে,"এ আলোচনা এখন থাক শিরোমনি জ্যাঠা!আগে পঞ্চায়েত আমাদের একঘরে করুক! আজ শ্মশানে শেষ কৃত্যটা সেরে আসি!
নন্দ বলেন," তা কোন চিতায় দাহ করবে?"
জীবন বলে," কোন চিতায় মানে?"
"তুমি গাঁয়ের ছেলে জানো না , গ্রামে তিনটি শ্মশান আছে? বামুন,কায়েত আর অছ্যুৎদের! মৃতের শরীরে তো ডোমের রক্ত মিশে আছে!মৃত্যুর পূর্বে সে নিজেই স্বীকার করে গেছে!
এতক্ষনে উঠে দাঁড়ায় হটী সদ্য পিতৃহারা একরত্তি মেয়েটা! করজোড়ে সমাজপতিদের জানালে," আপনারা এবার আসুন! আমার পিতার মৃতদেহ অচ্ছ্যুৎ-দের শ্মশানেই দাহ হবে !
" আমাদের তাড়িয়ে দিচ্ছ হটী?" বললেন তারাপ্রসন্ন!
" না জ্যাঠা মশাই, কিন্তু এই ভিটে তো জাতিচ্যুতের ! তাই এবার আমাকে রেহাই দিন!"
নন্দ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন! তারাপ্রসন্ন তাঁকে ধমকে থামিয়ে বললেন,"মামনি সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে!"
নতমস্তকে সমাজপতিরা বিদায় নিলেন! তারাপ্রসন্ন স্হান ত্যাগ না করে হটীকে বললেন,"মামনি,আমি শ্মশানযাত্রী হতে চাই তোর আপত্তি আছে?
এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে তার জ্যাঠামনিকে জড়িয়ে ধরল!
গ্রামের শেষ প্রান্তে শ্মশানঘাট!লোকে লোকারন্য! সারা গ্রাম ভেঁঙে পড়েছে তাদের অতি প্রিয় এক বগ্গা ঠাকুরকে শেষ বিদায় জানাতে! সমাজপতিদের মধ্যে একমাত্র জমিদার তারাপ্রসন্ন!
পরলোকগত রূপেন্দ্রর একমাত্র কন্যার শেষ ইচ্ছানুসারে মৃতদেহ বহন করে এনেছে অচ্ছ্যুৎরাই! তারাই তো ওঁর প্রকৃত শ্মশান বন্ধু হওয়ার অধিকারী !তাদের সেবাই করে গেছেন সারা জীবন ! তাঁর ধমনীতেও আটকে আছে ডোমের রক্ত! তাঁর দেহে ব্রাক্ষ্মন - অব্রাক্ষ্মনের জমাট বাঁধা রক্ত!
হটী পিতার নিষ্ঠার সাথে পিতার শেষকৃত্য করল!রাত এক প্রহর মুখাগ্নী করল ,চোখে জন নেই, কর্তব্যে অবিচল! চিতায় অগ্নি স্পর্শে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল! অচ্ছুৎদের শ্মশানে! পরিসমাপ্তি ঘটল একটি স্বর্নময় অধ্যায়ের!
(চলবে)
শোভারানী ভেঙে পড়ল কান্নায়! চোখে আঁচল চাপা দিলেন তারাসুন্দরী! আর হটী কান্নায় লুটিয়েও পড়ল না, মুর্চ্ছিতাও হ'ল না! দেওয়ালে ঠেস দিয়ে শূন্য দৃষ্টি মেলে বসে রইল! যেন পাথরের প্রতিমা!
একে একে সবাই বেরিয়ে গেলেন! এখন শোক সন্তপ্তদের অশ্রুপাতে পরিবেশ শান্ত হতে দেওয়ায় রেওয়াজ! তারপর করতে হবে অন্তিম সংস্কারের আয়োজন!
রূপেন্দ্রকে অন্তিম যাত্রায় ফুল চন্দনে সাজিয়ে দিলেন শোভারানী আর তারাসুন্দরী! হটী এখনো দেওয়ালে ঠেস দিয়ে নিশ্চল বসে আছে!সে নির্বাক, নিস্পন্দ!ইতি মধ্যে সন্ধ্যা নেমেছে!
নন্দ খুড়ো এই শোকবহ পরিবেশে তাঁর কুটিল চাল চাললেন!সকলের উদ্দেশ্যে বললেন," রূপেনের শববাহী পাবে কোথায়? ওর তো প্রায়চ্চিত্ত হয় নাই সোঁয়াই গাঁয়ের বামুনরা তো ওর শববহন করবে না!"
প্রতিবাদ করলেন,তারাপ্রসন্ন," এটা কি বলছো? মৃত্যুতীর্থে যে পৌঁছে গেছে তার আবার জাত কি?"
নন্দ কুমীরের কান্না কেঁদে চাদরে মুখ ঢেকে বললেন," কি করব ভায়া! বলতে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে! কিন্তু শাস্ত্রের এটাই বিধান জাতিচ্যুতের কেউ শশ্মানযাত্রী হতে পারবে না!"
প্রতিবাদ করে জীবন বলল," আমাদের বিধান দিতে হবে না! আমরা দুভাই ওদের বহন করে নিয়ে যেতে পারব!"
আবার তির্যক মন্তব্য করলেন নন্দ খুড়ো," তা দুজন হলে তো খাটিয়ায় নিয়ে যেতে পারবি না! লেপ,কাঁথা আর তালাই মুড়ি দিয়ে বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে হবে! তা বাবা শিবনাথ জাত দিতে রাজী আছো তো?"
চিৎকার করে শিবনাথ বলে ওঠে ,"আজ্ঞে হ্যাঁ ,বাবা মশাইও রাজী হবেন! আমরা একুনে তিনজন! আপনি আমাদের গোটা পরিবারকে ' একঘরে করে দিন!"
নন্দ বলেন," বটে!! তা চতুর্থ বাহকটি কে?"
ভীড়ের মধ্য থেকে আওয়াজ আসে " আমি কাঁধ লাগাবে বাবু মশা, আমি সন্ন্যাসী আছে! আমার কুন জাত নাই !"
নিদারুন দুঃসংবাদটি পেয়ে বৃদ্ধ একমুঠিবাবা চলে এসেছেন!
জীবন বলে ওঠে," আপনাদের সমাজ আমাদের একঘরে করলেও আমাদের কিছু আসে যায় না! কিন্তু মনে রাখবেন, 'আরোগ্য নিরেতনে এখনো কিছু রোগী মরতে বাকী আছে ! সমাজপতি হিসাবে তাদের দ্বায়িত্ব আপনার !আমি কাল থেকে পীরপুরে যাবো!এ গাঁয়ের কারও চিকিৎসা করবো না !"
নন্দখুড়ো গুম হয়ে রইলেন!
সমাজপতি মশায় বললেন," এতো ভারী অন্যায় কথা জীবন!....
বাধা দিয়ে জীবন বলে,"এ আলোচনা এখন থাক শিরোমনি জ্যাঠা!আগে পঞ্চায়েত আমাদের একঘরে করুক! আজ শ্মশানে শেষ কৃত্যটা সেরে আসি!
নন্দ বলেন," তা কোন চিতায় দাহ করবে?"
জীবন বলে," কোন চিতায় মানে?"
"তুমি গাঁয়ের ছেলে জানো না , গ্রামে তিনটি শ্মশান আছে? বামুন,কায়েত আর অছ্যুৎদের! মৃতের শরীরে তো ডোমের রক্ত মিশে আছে!মৃত্যুর পূর্বে সে নিজেই স্বীকার করে গেছে!
এতক্ষনে উঠে দাঁড়ায় হটী সদ্য পিতৃহারা একরত্তি মেয়েটা! করজোড়ে সমাজপতিদের জানালে," আপনারা এবার আসুন! আমার পিতার মৃতদেহ অচ্ছ্যুৎ-দের শ্মশানেই দাহ হবে !
" আমাদের তাড়িয়ে দিচ্ছ হটী?" বললেন তারাপ্রসন্ন!
" না জ্যাঠা মশাই, কিন্তু এই ভিটে তো জাতিচ্যুতের ! তাই এবার আমাকে রেহাই দিন!"
নন্দ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন! তারাপ্রসন্ন তাঁকে ধমকে থামিয়ে বললেন,"মামনি সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে!"
নতমস্তকে সমাজপতিরা বিদায় নিলেন! তারাপ্রসন্ন স্হান ত্যাগ না করে হটীকে বললেন,"মামনি,আমি শ্মশানযাত্রী হতে চাই তোর আপত্তি আছে?
এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে তার জ্যাঠামনিকে জড়িয়ে ধরল!
গ্রামের শেষ প্রান্তে শ্মশানঘাট!লোকে লোকারন্য! সারা গ্রাম ভেঁঙে পড়েছে তাদের অতি প্রিয় এক বগ্গা ঠাকুরকে শেষ বিদায় জানাতে! সমাজপতিদের মধ্যে একমাত্র জমিদার তারাপ্রসন্ন!
পরলোকগত রূপেন্দ্রর একমাত্র কন্যার শেষ ইচ্ছানুসারে মৃতদেহ বহন করে এনেছে অচ্ছ্যুৎরাই! তারাই তো ওঁর প্রকৃত শ্মশান বন্ধু হওয়ার অধিকারী !তাদের সেবাই করে গেছেন সারা জীবন ! তাঁর ধমনীতেও আটকে আছে ডোমের রক্ত! তাঁর দেহে ব্রাক্ষ্মন - অব্রাক্ষ্মনের জমাট বাঁধা রক্ত!
হটী পিতার নিষ্ঠার সাথে পিতার শেষকৃত্য করল!রাত এক প্রহর মুখাগ্নী করল ,চোখে জন নেই, কর্তব্যে অবিচল! চিতায় অগ্নি স্পর্শে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল! অচ্ছুৎদের শ্মশানে! পরিসমাপ্তি ঘটল একটি স্বর্নময় অধ্যায়ের!
(চলবে)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours