কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

মোদির কি ধর্মতলায় শপিং করতে যাওয়ার কথা ছিলো নাকি?
যতদূর জানি, শনিবার ওঁর গন্তব্য ছিলো রাজভবন। তাহলে ধর্মতলা অবরোধ কেন? অবরোধ কারণ ওটাই ছিলো, নিজেদের বাহুবল জাহির করার সহজতম রাস্তা। যাদবপুরের ছেলেপুলে যখন, বিদ্যাবুদ্ধিতে ওঁদের সেরা বলে না এমন স্পর্ধা কার? বস, নাম হি কাফি হ্যায়! তবে ওঁরা অন্যের বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে হামেশাই প্রশ্ন তোলেন। আর প্রতিবাদের ভাষা বলতে যা আমদানি করা হয়েছে,  তা উল্লেখ করা অসম্ভব। ট্রোল, টিটকিরি, সফট খিস্তির ছাড়পত্রও পকেটে গোঁজা। কেন?
ওই যে ওনারা ছাত্র।

তা এই ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের ছানাবেলা থেকেই দেখে এসছেন, পাবলিকের রাস্তা আটকালে কোন বিপদের ভয় থাকে না। জানা ছিলো, ধর্মতলা অবাধ করতে রাজ্য পুলিস তাঁদের পিটিয়ে হটাবে না। ওঁদের গায়ে হাত তখনই পড়বে, যখন ওঁরা শাসকদলের পেছনে লাগবেন। তবে তার আগেও প্রশাসকরা দশবার ভাববেন। ভ্রু কোঁচকাবেন। টাকে হাত বুলিয়ে, পকেট থেকে এই ঠান্ডায় নাকের সিকনি মোঁছা রুমালটা বার করবেন। তা দিয়ে চশমাটা ভালভাবে মুছে নেবেন। তারপর ফের ভাবতে বসবেন।
এত চাপ কিসের প্রশাসনের? পড়ুয়াদের পিঠে ঘা পড়লেই পুলিসের, সরকারের সাতগুষ্ঠির পিন্ডি চটকানো শুরু। স্টুডেন্ট সলিডারিটির ঢোল পেটানো রাজ্যময়। চাই কী গোটা ব্যাপার আরও ব্যাপক রূপ ধরতে পারে, ঠিক যেমনটা দেখা গেছিলো জামিয়াকাণ্ডে। তারপরেই মোমবাতি বাবুবিবিদের মিছিল। মানবাধিকার। কেন?
ওই যে ওঁরা দেশের ভবিষ্যত। ছাত্রছাত্রী।

পড়ুয়াদের গায়ে হাত পড়লো কী না পড়লো, রে রে করে তেড়ে আসবেন পড়ুয়াদের রাজনৈতিক অভিভাবক ওরফে শিক্ষাগুরুরা। রাজনীতি করতে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও কম যান না। রাজনীতি বললে ভুল হবে। বলা ভালো দলবাজি। রাজনীতি তো বিষয়মাত্র। দলবাজি মানে নির্দিষ্ট একটি দলের খাতায় নাম লেখানো। সেই দলটার হয়ে গলা ফাটানো। আর সেখানেই মুশকিলের শুরু। শনি রবিবার ধর্মতলার জবরদখল নিয়েছিল বাম কংগ্রেস ছাত্র সংগঠন। পুলিস তাদের জবরদস্তি সরিয়ে দিতে চাইলেই রোষের মুখে পড়ে যেত শাসকদল। মুখ্যমন্ত্রীর গায়ে আরও একবার সীলমোহর দেগে দেওয়া হতো- মোদিজি দিদিজি সেটিং।
ময়দানে সরাসরি নেমে পড়তেন রাজনীতির কারবারীরা।
উদ্দেশ্য, ছাত্রস্বার্থ রক্ষা করা।

প্রতিবাদী পড়ুয়ারা জানতেন, মোদি ধর্মতলায় শপিং করতে যাবেন না। যাবেন রাজভবনে। কিন্তু সেই রাস্তা আটকাতে গেলেই বিপদ ছিল অনিবার্য। বড়জোর খানিক হম্বিতম্বি করা যেতে পারতো। আর তাঁরা তা করেছেনও। বাড়াবাড়ি করলেই রাজ্য পুলিসও সম্ভবত ছেড়ে কথা কইতো না। মেরে বেন্দাবন দেখিয়ে দিত মোদির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সুরক্ষাকর্মীরা।
অগত্যা চলো ধর্মতলা। ঝি পিটিয়ে বউকে শিক্ষা দেওয়া যেতেই পারে।
সেরা পড়ুয়াদের সেরা বুদ্ধি বলে কথা।
মোদি সরকারের নাগরিক বিলের প্রতিবাদ করাই কি একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শনিবার বারবেলায়?
তৃণমূল ছাত্র সংগঠন তো সেদিন রানি রাসমণি রোডে ধরনা মঞ্চ তৈরি করেই ছিল। বাম কংগ্রেস ছাত্র সংগঠন তো সেদিন ওই এক মঞ্চে সামিল হয়ে বিক্ষোভ দেখাতেই পারতো। একজোট ছাত্র সংগঠনের চেহারাটা মোদিকে দেখাতে পারলে মন্দ হতো কি?
কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কারণ সব বিরোধিতার নেপথ্যেই কাজ করে এক অন্য অঙ্ক। নিজের দল বা জোটের একক ক্ষমতা জাহির করে, এক ঢিলে দুই পাখি মারার যাবতীয় চেষ্টা। বিজেপির পাশাপাশি তৃণমূলকেও ক্ষমতা দেখানো। আর ঠিক এ কারণেই বিজেপিবিরোধী শিবিরের হাল শতছিন্ন।
তবে প্রশ্ন আরও একটা। বিক্ষোভের পেছনে কাঠিনাড়া দলগুলি ঠিক কী চাইছিলো? নাগরিক আইনের প্রতিবাদ করা নাকি, বিজেপির বিরোধিতা করা?

দিল্লিতে জেএনইউ হলে, বাঙালির গর্ব যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। দুই প্রতিষ্ঠানের মিলও অনেক। প্রতিভা তৈরির কারখানা। আর দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বামপন্থী, অতি বামপন্থীদের দাপাদাপি। শনি রবিবার কলকাতায় মোদিবিরোধী বিক্ষোভকে তুঙ্গে ওঠাতে আউটসোর্সিংও করা হয়েছিলো। ধর্মতলার বিক্ষোভ মহোৎসবে জুটেছিলো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও।
নরেন্দ্র মোদি ওই বিক্ষোভের ভয়েই আকাশ আর জলপথে সফর করে নিজ দায়িত্ব সেরেছেন। আত্মতৃপ্তির বিশাল ঢেকুর তুলে সোশ্যাল মেডিয়ায় এমনটাই পোস্ট করতে দেখা গেছিলো কিছু উৎসাহী পড়ুয়াকে। শুরু হয়েছিলো 'মোদি গো ব্যাক' দিয়ে। পরে তার সঙ্গে জুড়ে গেছিল 'মমতা গো ব্যাক'।
পড়ুয়াবাবুদের সাধ্যে কুলোলে সেদিন সেরেফ এক ধাক্কায় প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, দু'জনকেই কুর্সি থেকে ঠেলে ফেলে দিতেন। তারপর সেই শূন্য আসনে টুক করে বসে পড়তেন বাম এবং কংগ্রেস নেতারা। রাজ্যবাসীর খারিজ করা দুই দল। তাই এখন বলভরসা এই নবীন কচিকাচারাই। এই ছাত্রছাত্রীদের উসকে দিতেই, হাতে বেপরোয়ার ছাড়পত্র। পুলিসের শাসন মানবেন না তাঁরা। তাঁরা যেন সব শাসনের উর্ধ্বে।
কারণ, ওই যে বললাম, তাঁরা রাজ্যের সেরা পড়ুয়াদের দল।

ছাত্রদের কলকাঠি নাড়ছেন নেতারা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির ফতোয়াতেই তা স্পষ্ট।
কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের নাম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় করা হলে সেই ফলক উপড়ে ফেলবে তাদের যুব ছাত্র সংগঠন। ভবিষ্যদ্বাণী করে দিয়েছেন সোমেনবাবু। এককালের হেভিওয়েট। তিনি নিজের দলটাকেই ধরে রাখতে পারলেন না। আবার এখন তিনিই তাঁর দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের গতিপথ ঠিক করছেন। মোদ্দা কথা, আজ ছাত্র রাজনীতির লাগাম দলের নেতার হাতে।
সোমেনবাবুকেও একটা প্রশ্ন করি, রাস্তার নাম যখন হোচি মিন সরণী, লেনিন সরণী, তখনতো মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন। ওই নেতারা আমাদের দেশের কোন মহত কাজটা সম্পাদন করেছিলেন?
ছাত্রদরদী সোমেন মিত্রের বয়স হয়েছে। পাক ধরেছে চুলে। স্মৃতিও যেন সূর্যাস্তের আলোর মতো। ক্রমেই ফিকে হয়ে আসে। ষাট সত্তর দশকের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। পড়ুয়াদের পিঠে নক্সাল নামের সীলমোহর দেগে ঠিক কতজনকে খুন করা হয়েছিল, আজও সেই অঙ্ক কষা হয়নি। আজ তাহলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিস ঢুকলে এত বড়গলায় কথা কেন কংগ্রেসের?
আসলে গোটাটাই রাজনীতির ঘোলাজলে মাছ ধরার চেষ্টা। ছাত্রদের হয়ে গলা ফাঁটানো।
কারণ সোমেনবাবু জানেন, কী অফুরন্ত প্রাণশক্তি এই ছাত্রছাত্রীদের।

সোজা কথায়, নির্ভেজাল স্বতন্ত্র ছাত্র রাজনীতি আজ ইতিহাসের পাতায়। এক একটা শিক্ষাক্ষেত্র এক এক দলের আখড়া। কোনও রাখঢাক নেই আর। ছাত্র সংগঠনে এখন সরাসরি রাজনৈতিক সীলমোহর। তবু তাঁদের রাজনৈতিক কর্মী বলা যাবে না।
কারণ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় তাঁরা ছাত্র।

রাজনৈতিক কর্মী এই ছাত্ররাই আবার সাধারণ ছাত্রের সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে চাইছেন। অভিযোগ উঠেছে এমনটাই। নামমাত্র খরচ- খরচায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে নিভৃতাবাস, খাওয়া- দাওয়া। কোন নৈতিকতায়? সেই কবে থেকেই তো কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলো রাজনীতির আখড়া। সেই আখড়ায় পুলিসের ঢুকতে বাধা থাকবে কেন? পুলিস এত অস্পৃশ্য কোন যুক্তিতে? আপদে বিপদে নাগরিকের প্রথম ভরসা তো পুলিস।
কিন্তু মজা ওখানেই। ওঁরা তো নাগরিক না। ওঁরা ছাত্র।

সবমিলিয়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে,  তাতে শাসকদল, বিরোধীদের চাপে পুলিসবাবাজিরা আজ স্যান্ডউইচ। আর ঠিক এই অবস্থার ফায়দা লুটছেন রাজনৈতিক দলের খাতায় নামলেখানো পড়ুয়ারা।
তাঁদের স্পর্ধা এখন আকাশছোঁয়া। শনিবার রাতে তাঁরা বচসায় জড়িয়ে পড়লেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও। কত অনায়াসে যাদবপুরের পড়ুয়ারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রেখেছিলেন এক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে। দ্বিধা বোধ করেননি রাজ্যপালের পথ আটকাতেও। তাঁরা জানতেন, রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী, রাজ্যপালের মধ্যেকার সম্পর্কটা সাপে নেউলের। আর ঠিক এই সমীকরণের মুনাফা লুটতে চেয়েছিলেন বিক্ষোভকারীরা। পুলিসের ভয় নেই। অতএব, ওই দু'জনকে নিয়ে যা খুশি করা চলে। বিপদের ভয় নেই।
মাথার ওপরে ছাতাধরার লোকতো আছেই। ওঁরা ছাত্র।

আর যেখানে বিপদ আছে সেখান থেকে সহস্র হস্ত দূরে, বাদ্যি সঙ্গীত- সহ বিপ্লবোৎসবে মাতা। শনিবার, রবিবার ঠিক যেমনটা দেখা গেছিল ধর্মতলায়। শহরের ভরকেন্দ্র ছিনতাই করে তাঁরা যেন গোটা সমাজ, প্রশাসনের দিকে এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মেরেছিলেন।
- "আমরা ছাত্রের পরিচয়ে বাধাহীন দাপাবো। সোশ্যাল মেডিয়ায় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর নামে প্রাণভরে খিস্তিখেউড় করবো। যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ, আমরা পাবলিককে নাস্তানাবুদ করবো। মুন্ডপাত করবো পুলিসের। দেখি কোন বাপের বেটা কী করতে পারে?"
এতকিছুর পরেও ছাত্রছাত্রীদের গায়ে পুলিস হাত দিতে পারবে না। একেকটি পড়ুয়া যেন একেকটি দেবশিশু।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours