শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, উত্তরপ্রদেশ:
১৮৭৬ সালে রবীন্দ্রনাথের পনেরো বছর বয়সে, ভারতীয়দের প্রথম বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কালটিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৮ সালে, অর্থাৎ বাইশ বছর পর, প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সভার সভাপতি তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর ম্যাকেঞ্জির সামনে মহেন্দ্রলাল বিজ্ঞানের প্রতি এদেশের মানুষের আকর্ষণ কম বলে দেশবাসীর উদাসীনতাকে প্রবল সমালোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "অল্পকাল হইল বাংলাদেশের তৎসাময়িক শাসনকর্তা ম্যাকেঞ্জিসাহেবকে সভাপতির আসনে বসাইয়া মান্যবর শ্রীযুক্ত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার মহাশয় তাঁহার স্বপ্রতিষ্ঠিত সায়ান্স অ্যাসোসিয়েশনের দুরবস্থা উপলক্ষে নিজের সম্বন্ধে করুণা, স্বদেশ সম্বন্ধে আক্ষেপ, এবং স্বদেশীয়দের প্রতি আক্রোশ প্রকাশ করিয়াছেন।" এর প্রতিক্রিয়ায় ১৩০৫ বঙ্গাব্দে 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত 'প্রসঙ্গকথা ১' শীর্ষক রচনায় সাঁইত্রিশ বছর বয়সি রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত জ্বালাময়ী ভাষায় পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ মহেন্দ্রলালকে আক্রমণ করে বলেন, "তাঁহার সমস্ত বক্তৃতার মধ্যে একটা নালিশের সুর ছিল। বাদী ছিলেন তিনি, প্রতিবাদী ছিল তাঁহার অবশিষ্ট স্বজাতিবর্গ এবং জজ ও জুরি ছিল ম্যাকেঞ্জিপ্রমুখ রাজপুরুষগণ।" কালটিভেশন অফ সায়েন্সের যে নিজস্ব ভবন আছে, অর্থসম্বল আছে তার প্রতি শ্লেষ করে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য, "ডাক্তার সরকারকে জিজ্ঞাসা করি, আজ পর্যন্ত সমস্ত বঙ্গদেশে এমন কয়টা অনুষ্ঠান আছে যে নিজের ঘর-দুয়ার ফাঁদতে পারিয়াছে, বহুব্যয়সাধ্য আসবাব সংগ্রহ করিয়াছে, যাহার স্থায়ী অর্থের সংস্থান হইয়াছে, এবং যাহার সভাপতি দেশের ছোটলাট বড়লাট সাহেবকে সম্মুখে বসাইয়া নিজের মহৎ ত্যাগস্বীকার ঘোষণাপূর্বক অশ্রুপাত করিবার দুর্লভ ঐ অবসর পাইয়াছে।" মহেন্দ্রলাল যে বিজ্ঞান প্রসারের জন্য অনেক কিছু করেছেন তা ব্যাঙ্গার্থে স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ আরও বললেন, "কিন্তু অনেক করিয়াছেন বলিয়া বিলাপ না করিয়া তাঁহাকে যে আরো অনেক করিতে হয় নাই সেজন্য কৃতজ্ঞতা অনুভব করা উচিত ছিল। বিজ্ঞানপ্রচারের উৎসাহে কোনো মহাপুরুষ জেলে গিয়াছেন, কোনো মহাপুরুষকে অগ্নিতে দগ্ধ হইতে হইয়াছে। বড়োলোক হইয়া বড়ো কাজ করিতে গেলে এরূপ অসুবিধা হইয়া থাকে।"
বুঝতে পারা কঠিন যে সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অভিযোগের অভিমুখটা ঠিক কি? - নিজস্ব ভবন তৈরী করা? নাকি মহেন্দ্রলালকে অগ্নিতে দগ্ধ হতে হয় নি, তাই? কোনটি? বঙ্গদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নতির জন্য নিজে এক পয়সাও খরচা না করা রবীন্দ্রনাথের এই অহেতুক উষ্মা ও বক্রোক্তির মানে কি? মহেন্দ্রলালের নাস্তিক মনোভাবই এই প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী নয় তো?
বিজ্ঞানসভা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের শ্লেষের এখানেই শেষ নয়। বিজ্ঞানসভার নিজস্ব ভবন ও মুল্যবান যন্ত্রপাতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ পুনরায় ব্যঙ্গাত্মক হলেন, "আজ প্রায় সিকি শতাব্দিকাল বাংলাদেশে বিজ্ঞানের জন্য একখানা পাকা বাড়ি, কতকগুলি আসবাব এবং কিঞ্চিৎ অর্থ আছে বলিয়াই যে বিজ্ঞান আপনা-আপনি গোকুলে বাড়িয়া উঠিতে থাকিবে এমন কোনো কথা নাই। আরো আসবাব এবং আরো টাকা থাকিলেই যে বিজ্ঞান আরো ফুলিয়া উঠিবে এমনও কোনো বৈজ্ঞানিক নিয়ম দেখা যায় না।" এবং, "এখানে সায়ান্স অ্যাসোসিয়েশন নামক একটি কল জুড়িয়া দিলেই যে বিজ্ঞান একদমে বাঁশি বাজাইয়া রেলগাড়ির মতো ছুটিতে থাকিবে, অত্যন্ত অন্ধ অনুরাগীও এরূপ দুরাশা পোষণ করিতে পারে না।"
অবশ্য এইসব কটুক্তিতে অসীম মনোবলের অধিকারী ডঃ সরকার মোটেই বিচলিত হন নি। তিনি বলেছিলেন, "দেশে বিজ্ঞান আলোচনা মোটেই আরম্ভ হয় নাই। এ অবস্থায় আমাদের প্রধান কর্তব্য, দেশে বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি গঠনে সাহায্য করা। তবেই আমরা দেখিতে পাইব, আমাদের উদ্ভাবনী শক্তি জাগ্রত হইয়াছে এবং শিল্প-বাণিজ্যাদি নানা ক্ষেত্রে উহার প্রয়োগ চলিতেছে। কিন্তু সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন হইতে কতকগুলি কারিগর তৈরী করাই আমাদের লক্ষ্য নয়। বিজ্ঞানের নব নব জ্ঞানবিভবে জাতীয় মনীষাকে সম্বুদ্ধ করিয়া তোলাই ইহার প্রধানতম উদ্দেশ্য।"
মজার কথা হল, রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো পাতার একটি গ্রন্থ রচনা করে ফেললেও 'প্রসঙ্গকথা ১' প্রবন্ধে সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের বক্রোক্তিগুলি সম্পর্কে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নীরব রবীন্দ্রভক্ত দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ! গোটা বইতে বিজ্ঞানসভা সম্বন্ধে তিনি মাত্র একটি বাক্য লিখেছেন, "এই 'বিজ্ঞানসভা'র উন্নতি কিভাবে করা যায় একসময় সে-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধ রচনা করেন।" এখন দেখা যাক, কি সেই প্রবন্ধ এবং তাতে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কি লিখেছেন। (চলবে)
তথ্যসূত্র :
অন্য কোনো সাধনার ফল, আশীষ লাহিড়ী, পাভলভ ইনস্টিটিউট
বঙ্কিম রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ
রবীন্দ্রনাথ : মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান, আশীষ লাহিড়ী, অবভাস
বিজ্ঞানে বাঙালী, অনিল চন্দ্র ঘোষ, প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরী
রবীন্দ্র রচনাবলী দ্বাদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী প্রকাশনী
রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স
১৮৭৬ সালে রবীন্দ্রনাথের পনেরো বছর বয়সে, ভারতীয়দের প্রথম বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কালটিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৮ সালে, অর্থাৎ বাইশ বছর পর, প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সভার সভাপতি তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর ম্যাকেঞ্জির সামনে মহেন্দ্রলাল বিজ্ঞানের প্রতি এদেশের মানুষের আকর্ষণ কম বলে দেশবাসীর উদাসীনতাকে প্রবল সমালোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "অল্পকাল হইল বাংলাদেশের তৎসাময়িক শাসনকর্তা ম্যাকেঞ্জিসাহেবকে সভাপতির আসনে বসাইয়া মান্যবর শ্রীযুক্ত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার মহাশয় তাঁহার স্বপ্রতিষ্ঠিত সায়ান্স অ্যাসোসিয়েশনের দুরবস্থা উপলক্ষে নিজের সম্বন্ধে করুণা, স্বদেশ সম্বন্ধে আক্ষেপ, এবং স্বদেশীয়দের প্রতি আক্রোশ প্রকাশ করিয়াছেন।" এর প্রতিক্রিয়ায় ১৩০৫ বঙ্গাব্দে 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত 'প্রসঙ্গকথা ১' শীর্ষক রচনায় সাঁইত্রিশ বছর বয়সি রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত জ্বালাময়ী ভাষায় পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ মহেন্দ্রলালকে আক্রমণ করে বলেন, "তাঁহার সমস্ত বক্তৃতার মধ্যে একটা নালিশের সুর ছিল। বাদী ছিলেন তিনি, প্রতিবাদী ছিল তাঁহার অবশিষ্ট স্বজাতিবর্গ এবং জজ ও জুরি ছিল ম্যাকেঞ্জিপ্রমুখ রাজপুরুষগণ।" কালটিভেশন অফ সায়েন্সের যে নিজস্ব ভবন আছে, অর্থসম্বল আছে তার প্রতি শ্লেষ করে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য, "ডাক্তার সরকারকে জিজ্ঞাসা করি, আজ পর্যন্ত সমস্ত বঙ্গদেশে এমন কয়টা অনুষ্ঠান আছে যে নিজের ঘর-দুয়ার ফাঁদতে পারিয়াছে, বহুব্যয়সাধ্য আসবাব সংগ্রহ করিয়াছে, যাহার স্থায়ী অর্থের সংস্থান হইয়াছে, এবং যাহার সভাপতি দেশের ছোটলাট বড়লাট সাহেবকে সম্মুখে বসাইয়া নিজের মহৎ ত্যাগস্বীকার ঘোষণাপূর্বক অশ্রুপাত করিবার দুর্লভ ঐ অবসর পাইয়াছে।" মহেন্দ্রলাল যে বিজ্ঞান প্রসারের জন্য অনেক কিছু করেছেন তা ব্যাঙ্গার্থে স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ আরও বললেন, "কিন্তু অনেক করিয়াছেন বলিয়া বিলাপ না করিয়া তাঁহাকে যে আরো অনেক করিতে হয় নাই সেজন্য কৃতজ্ঞতা অনুভব করা উচিত ছিল। বিজ্ঞানপ্রচারের উৎসাহে কোনো মহাপুরুষ জেলে গিয়াছেন, কোনো মহাপুরুষকে অগ্নিতে দগ্ধ হইতে হইয়াছে। বড়োলোক হইয়া বড়ো কাজ করিতে গেলে এরূপ অসুবিধা হইয়া থাকে।"
বুঝতে পারা কঠিন যে সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অভিযোগের অভিমুখটা ঠিক কি? - নিজস্ব ভবন তৈরী করা? নাকি মহেন্দ্রলালকে অগ্নিতে দগ্ধ হতে হয় নি, তাই? কোনটি? বঙ্গদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নতির জন্য নিজে এক পয়সাও খরচা না করা রবীন্দ্রনাথের এই অহেতুক উষ্মা ও বক্রোক্তির মানে কি? মহেন্দ্রলালের নাস্তিক মনোভাবই এই প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী নয় তো?
বিজ্ঞানসভা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের শ্লেষের এখানেই শেষ নয়। বিজ্ঞানসভার নিজস্ব ভবন ও মুল্যবান যন্ত্রপাতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ পুনরায় ব্যঙ্গাত্মক হলেন, "আজ প্রায় সিকি শতাব্দিকাল বাংলাদেশে বিজ্ঞানের জন্য একখানা পাকা বাড়ি, কতকগুলি আসবাব এবং কিঞ্চিৎ অর্থ আছে বলিয়াই যে বিজ্ঞান আপনা-আপনি গোকুলে বাড়িয়া উঠিতে থাকিবে এমন কোনো কথা নাই। আরো আসবাব এবং আরো টাকা থাকিলেই যে বিজ্ঞান আরো ফুলিয়া উঠিবে এমনও কোনো বৈজ্ঞানিক নিয়ম দেখা যায় না।" এবং, "এখানে সায়ান্স অ্যাসোসিয়েশন নামক একটি কল জুড়িয়া দিলেই যে বিজ্ঞান একদমে বাঁশি বাজাইয়া রেলগাড়ির মতো ছুটিতে থাকিবে, অত্যন্ত অন্ধ অনুরাগীও এরূপ দুরাশা পোষণ করিতে পারে না।"
অবশ্য এইসব কটুক্তিতে অসীম মনোবলের অধিকারী ডঃ সরকার মোটেই বিচলিত হন নি। তিনি বলেছিলেন, "দেশে বিজ্ঞান আলোচনা মোটেই আরম্ভ হয় নাই। এ অবস্থায় আমাদের প্রধান কর্তব্য, দেশে বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি গঠনে সাহায্য করা। তবেই আমরা দেখিতে পাইব, আমাদের উদ্ভাবনী শক্তি জাগ্রত হইয়াছে এবং শিল্প-বাণিজ্যাদি নানা ক্ষেত্রে উহার প্রয়োগ চলিতেছে। কিন্তু সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন হইতে কতকগুলি কারিগর তৈরী করাই আমাদের লক্ষ্য নয়। বিজ্ঞানের নব নব জ্ঞানবিভবে জাতীয় মনীষাকে সম্বুদ্ধ করিয়া তোলাই ইহার প্রধানতম উদ্দেশ্য।"
মজার কথা হল, রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো পাতার একটি গ্রন্থ রচনা করে ফেললেও 'প্রসঙ্গকথা ১' প্রবন্ধে সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের বক্রোক্তিগুলি সম্পর্কে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নীরব রবীন্দ্রভক্ত দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ! গোটা বইতে বিজ্ঞানসভা সম্বন্ধে তিনি মাত্র একটি বাক্য লিখেছেন, "এই 'বিজ্ঞানসভা'র উন্নতি কিভাবে করা যায় একসময় সে-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধ রচনা করেন।" এখন দেখা যাক, কি সেই প্রবন্ধ এবং তাতে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কি লিখেছেন। (চলবে)
তথ্যসূত্র :
অন্য কোনো সাধনার ফল, আশীষ লাহিড়ী, পাভলভ ইনস্টিটিউট
বঙ্কিম রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ
রবীন্দ্রনাথ : মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান, আশীষ লাহিড়ী, অবভাস
বিজ্ঞানে বাঙালী, অনিল চন্দ্র ঘোষ, প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরী
রবীন্দ্র রচনাবলী দ্বাদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী প্রকাশনী
রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স
Post A Comment:
0 comments so far,add yours