কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা: 

স্পর্ধা জরুরি।
শিখতে হয় স্বপ্ন দেখাও।
তার জন্য অবধারিত ভাবেই, বেশ খানিকটা হিম্মত লাগে। আর লাগে জেদ।
তবে তারচেয়েও জরুরি এক আবেগপ্রবণ মন। যে মেঘ, আকাশের সীমানা ছাড়ানোর ক্ষমতা রাখে। তবে স্বপ্ন দেখায় এতটুকু ভুলভাল হলেই কিন্তু ডাহা বিপদ।
ফুটুর ডুম!
জীবনাদর্শই নাকি সুপ্ত থাকে স্বপনে।
তবে এসব ছাপিয়ে অন্য আর এক ধরনের স্বপ্নও থাকে। সেই স্বপ্ন শেখানো হয় কানমোলে।

"বেলুন......."
আমার কথাই বলি।
সেই ছেলেবেলার দিন থেকেই একটা স্বপ্ন তাড়া করে বেড়াতো আমায়। আর তা ননস্টপ গোত্তা মারত মনের ভেতর। বিশেষ করে উৎসব পার্বনের দিনগুলিতে। গলায় মাছের কাঁটা ফোটার মতো। অনবরত খচখচ খোঁচানো।

বড় বিচিত্র সেই স্বপ্ন!
বেলুনওয়ালা হবো।
বাঁশের কঞ্চির তৈরি 'T'। আর সেই 'টি'য়ে বাঁধা কমপক্ষে এক ডজন গ্যাস বেলুন। নানা রঙের। তারা সবাই বাতাসে 'দে দোল দে দোল'। দু-একটা সুতো ছিঁড়ে পালাতোও। তা যাক ক্ষতি নেই। গ্যাসবেলুনকে বেঁধে রাখা বড় কঠিন।
হাতছুট গ্যাসবেলুনের উড়ে পালানোর 'বডি ল্যাঙ্গোয়েজ'টা খেয়াল করেছেন কখনও? তারমধ্যে বেশ একটা রাশভারি ব্যাপার থাকে। গজগামিনী। সেই হাতছুট গগনবিহারী বেলুন আকাশে হারিয়ে যাওয়ার আগে যেন বলতো- আয় দেখি, তোর কত হিম্মত। আমায় ছুঁয়ে দেখা।

"রথের মেলা......."
আমি দাঁড়িয়ে সেই 'T' হাতে।
বেশ অনেক খোকাখুকি আসছে। তারা ভিড় জমিয়ে আমার থেকে বেলুন কিনছে। তখন ওই বেলুনওয়ালাই যেন 'বিগ বি'। তাকে ঘিরে অসংখ্য ফ্যান ফলোয়ার্স। হইচই। সবাই তার কাছে পৌঁছতে চায়। বেলুন চাই গ্যাসবেলুন।
সেই বেলুনওয়ালা হওয়ার শখ মিটলো না।
কে আমায় বেলুন বিক্রিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল আজও বুঝে উঠতে পারিনি। আমার সেই ছেলেবেলায়, আজকের মতো হাটেবাটে রাস্তাঘাটে অনুপ্রেরণার সাপ্লাই ছিলো না। মাথার ঘিলুতে কে তখন কলকাঠি নাড়তো, ষাটবছর পরেও তা বুঝতে পারিনি।
অথবা এরকমও হতে পারে, ওই গ্যাসবেলুনই উসকে দিয়েছিলো আমাকে। বেলুনের উড়ে যাওয়ার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে ছিলো আমার সাধের স্বপ্ন।
আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখতাম।
আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন।

"উড়ান......."
প্রথাগত দশটা পাঁচটার চাকরি পছন্দ ছিল না।
ছকে বাঁধা জীবন কভভি নেহি! সেই কলেজে পড়ার সময়েই ঠিক করে ফেলেছিলাম। তবে ততদিনে বেলুনওয়ালা হওয়ার স্বপ্নটাও গিয়েছে চলে।
এবার স্বপ্ন দেখলাম বেলুন না, নিজেই উড়ব আকাশে।

স্বপ্ন দেখাও কান ধরে শেখানো হয়, বলছিলাম না!
তা বাড়ি থেকে শেখানো হল, স্বপ্ন মানেই জয়েন্ট এন্ট্রান্স। স্বপ্ন মানেই যাদবপুর, শিবপুর, নিদেনপক্ষে জলপাইগুড়ি, দুর্গাপুর। সে যুগে হাতেগোনা এই চারটে এঞ্জিনিয়ারিং কলেজই ছিল রাজ্যে।

কিন্তু আমার স্বপ্ন তো আকাশে ওড়ার।
কিভাবে উড়ব? পথ বলে দেওয়ার কেউ ছিল না। একদিন খবরের কাগজে চোখ পড়ল এনডিএ'র এক বিজ্ঞাপনে।
ফর্ম আনালাম। এয়ার ফোর্সে যাব। যুদ্ধবিমান নিয়ে আকাশ ফালাফালা করে উড়ব। ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। ম্যাগাজিন বইপত্র ঘেটে সব খবরাখবর নেওয়া হয়ে গেল। এদিকে ফর্মে গার্ডিয়ানের সই দরকার। বাবা অনেক আগেই পটল তুলেছিলো। অগত্যা গার্ডিয়ানের জায়গায় কাকুর সাইন দরকার।

"স্বপ্নপতন......."
বংশের সবেধন নীলমনি আমি।
তখন আমি সবে স্কুল যেতে শুরু করেছি। একদিন আচমকাই স্কুলছুটির অনেক আগে আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। বাড়িতে জোর কান্নাকাটি। কে যেন বললো, আমার বাবা অ্যাক্সিডেন্টে মরে গেছে।
বাবা ডানপিটে টাইপ মানুষ ছিল শুনেছি। শুনেছি, কারণ বাবার সঙ্গে তেমন দেখা-সাক্ষাত হয়নি। মানুষ হয়েছি দাদু, ঠাকুমার কাছে। বাবা ছুটিছাটাতে এলে চোখের দেখা দেখতাম। ব্যাস ওই পর্যন্তই। তাই বাবার জন্য সেরকম কোনও আবেগ কাজ করলো না।
মা থাকত বাবার কাছেই। ঠাকুমাকেই মা বলে ডাকতাম। বাবা মারা যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই দাদুর গল্পও শেষ।

আমার সঙ্গে বলে বাবার স্বভাবের দারুণ মিল ছিল। বেশ ডানপিটে গোছের আর কী! আড্ডাবাজি, মারামারি ধরাধরি। শেষটাও বাবার মতো না হয়, তাই সবাই একটু চাপে থাকত। তা সেই দুধভাত খেয়ে বড় হওয়া ছেলে 'মিগ'- এর ককপিটে বসবে, এটা কারুর কাছে ভাবাও ছিল দুঃস্বপ্ন।

ওড়াউড়ির গল্প ওখানেই শেষ। গ্যাস বেলুনের পরিণতির মতোই চুপসে বাস্তবের মাটিতে নেমে এলাম আমি।

"স্বাধীনতা......."
বুঝলাম স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতাও নেই। স্বপ্ন দেখতে হলে তা দেখতে হবে গার্ডিয়ান, কাকুকে জিজ্ঞেস করেই।
অতএব, "হে বীর চির উন্নত মম শির।"
মনে-মনে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসলাম। তবে তখনকার মতো ভোগে গেলো আমার স্বপ্ন দেখা।
আকাশে আর ওড়া হলো না।
না হতে পারলাম বেলুনওয়ালা, না পাইলট।

"আবার স্বপ্ন......."
কিছুদিন পরেই ফের ঢেঁকুর উঠল স্বপ্নের।
তবে অম্লগন্ধময়।
যৌবন ফের স্বপ্ন দেখা শেখালো।
আগের মতোই ফের স্বপ্নে ভাসা। তবে এবারে বদলে গেল স্বপ্নগুলো।
মধ্যবিত্ত পেডিগ্রির স্বপ্ন। জীবন থেকে শেখা। তাতে আকাশে ওড়াওড়ির গপ্প ছিলো না। ছিলো না কোনও ঝুঁকি। আপদ বিপদের বালাই ষাট। নিরীহ বাঙালির মতোই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর আয়োজন।
ছবি আঁকার অভ্যাস ছিলোই। ঠিক করলাম এবার আকাশের ছবি আঁকবো। লাল আকাশ, নীল আকাশ, ধূসর আকাশ। তারমধ্যেই খুঁজে নেব, একেবারে আমার নিজের একমুঠো আকাশ।

কিন্তু এবারও সংঘাত। এবারের সংঘাত আমার মডিফায়েড স্বপ্নের সঙ্গে আমাকে শেখানো স্বপ্নের। এনট্রান্স এঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেনি হাতুড়ির সঙ্গে, স্বপ্নের রং তুলি ক্যানভাসের সরাসরি সংঘাত।
"এও কুরুক্ষেত্র......"
সে এক শীতযুদ্ধ।
লড়ে গেলাম সূতপুত্র কর্ণের মতো। কিছুতেই আমার রথের চাকাকে মাটিতে গেড়ে বসতে দেওয়া যাবে না। নেমে পড়লাম কুরুক্ষেত্রে। আমার বর্ম, ঢাল তরোয়াল ওই গোবেচারা ক্যানভাস, রং তুলি। লড়াই চললো দাঁতে দাঁত চেপে। সেও এক মিনি কুরুক্ষেত্র।
"বাপকা বেটা সিপাহি কা ঘোড়া
কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া!"
অবশেষে জিত। জিতে গেলাম লড়াইয়ে। নামকরা ইংরেজি কাগজের ম্যাগাজিনে ছাপা হতে লাগলো আমার ছবি। আর ছবির তলায় ছাপার হরফে ছোট্ট করে আমার নাম।
সেই নাম দেখে বাড়ির লোকজন খুব খুশি হলো এমনটা মোটেই নয়। বরং তাঁদের আফশোষটা থেকেই গেল- ছেলেটার পড়াশোনা হলো না।
তারপর বহু কাগজ, পত্রপত্রিকায় চুটিয়ে কাজ। আঁকার পাশাপাশি চললো লেখা। ছবির এক্সিবিশন।
অনেক আকাশ আঁকলাম। মেঘে ঢাকা অতিকায় আকাশ। হালকা পেঁজাতুলোর মতো নরম হালকা মেঘবুকে আকাশ। মেঘমুক্তির ঝলমলে আকাশ। আকাশ আর আকাশ।

জিতিয়ে দিলাম অমার যৌবনের স্বপ্নকে। সেই স্বপ্নসফলের আনন্দে অবশ্য কেউ কোনদিন ভাগিদার হয়নি। তবুও জেদি আমি।
বাস্তবের হিসেব নিকেষের কাছে স্বপ্নকে মাথা নোয়াতে দিইনি।
এটাই হয়ত জীবন থেকে শেখা।
এটাই হয়ত জীবনাদর্শ।

"প্লেনের সুরধ্বনি......."
আজও প্লেনের শব্দ শুনলেই দাঁড়িয়ে পড়ি। বুকের অতলে সেই শব্দ বাজে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকি আকাশপানে। যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, বাতাস কেটে প্লেনের এগিয়ে যাওয়ার গর্জন আমায় টেনে বের করবেই। থাকি কলকাতার মতো এক জনারণ্যে। অরণ্যবাসী ভেবেই শহুরেরা আমার দিকে তাকায়।
"বুড়োটা প্লেন দেখছে নাকি?
প্লেনে চড়ার সাধ ছিলো হয়ত! আজও মেটেনি।"

একেই বোধহয় বলে জীবনবৃত্ত! ছেলেবেলার সেই স্বপ্ন ফিরে এলো জীবনের শেষ ইনিংসে। স্বপ্নকুসুম। আকাশকল্পনা।

মাথার ওপর দিয়ে প্লেন উড়ে যেতে দেখলেই আজও ঠোঁট মুচকি হাসে। কেউ জানে না, প্রতিটা উড়ে যাওয়া প্লেনের সঙ্গে আমিও উড়ে যাই। ঠায় তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে। আমি স্বপ্ন দেখি। মানুষ আমায় দেখে।
একেকসময় মনে হয়, প্লেন আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। এই আছে এই নেই। খোঁজ খোঁজ। দরজার কোণে, চকির তলায়, ঝোপের আড়ালে। নেই, সে নেই। স্বপ্ন স্বপ্নারা চিরদিনই এরকম লুকিয়ে বেড়ায়। সহজে ধরা দেয় না।
তারপর সহসাই চোখের সামনে সে। মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে মেঘনাদের মতো। বাণবিদ্ধ করে আমার পরিণত আবেগকে। ফের উড়ে যায় দিগ-দিগন্তে। প্লেনটা ছোট হতে হতে একসময় উধাও হয় দিগন্তরেখায়। তারপরেই চোখ নেমে আসে আকাশপথের থেকে।
প্রিয়জনকে শেষবেলার ট্রেনে বিদায় জানাতে আসা মানুষটার মতো। ট্রেন যতক্ষন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, তার ওপর থেকে দৃষ্টি সরে না। ট্রেন ছাড়লে সেই প্রিয়জন চোখের আঙিনার বাইরে। তবু তাকিয়ে থাকা। যতক্ষণ ট্রেনের পেছনের গার্ড কামরার লাল আলো অন্ধকারে না মিলিয়ে যায়।

"চোরপুলিস খেলা......."
ছেলেবেলার সেই চোরপুলিস খেলা মনে আছে তো?
সেই 'টুকি' বলে আওয়াজ দিয়েই, গা-ঢাকা দেওয়া। প্লেনের ঘড়ঘড় আওয়াজ কানে আসে, কিন্তু চোখ তার নাগাল পায় না। একসময় আওয়াজ মিলিয়ে যায়। মন তখন ভীষন তেতো। হেরে যাই স্বপ্নের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায়।
আমারও বেলাশেষ। ক্রিকেট ময়দানের নাইট ওয়াচম্যানের মতো। ব্যাট চালাই। আজকাল ব্যাটেবলে হয় না ঠিকঠাক। আর হবেই বা কেন? দেখতে দেখতে ষাটে পৌঁছেছি। শেষ ইনিংসের খেলা খেলছি। তবু আজও সেই পুরনো স্বপ্ন ছেড়ে যায়নি। মধ্যে বেশ দমে গেছিলো। হয়ত যৌবনের দাপটে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাপটে জল ঢালা হয়ে গেছে। গুটিগুটি ফিরে এসেছে সেই প্রাচীন স্বপ্ন।
আজও আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি আনমনে। দশ বাই দশের এক আকাশ পেলেও চলে যেত। একটা সুন্দর ফুলের বাগান করতাম। ছেলেবেলার সেই আকাশে ওড়ার স্বপ্ন, আজও অধরাই থেকে গেল।
আমার নিজের একমুঠো আকাশ খুঁজে পেলাম না।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours