রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

নাদিরা মধ্যবয়স্কা, তুখোড় সংসারী। শাশুড়ি, স্বামী, দুই সন্তান নিয়ে তার ভরা ঘর, কিন্তু শান্তিবিহীন। প্রতিরাতে মদ্যপ স্বামীর মার, শাশুড়ির নিত্য পরিবার তুলে গঞ্জনা, সন্তানদের অবজ্ঞা - তুচ্ছতাচ্ছিল্য ; সব বয়েই কেটে চলেছিল তার দিন। নাদিরার একটি সমস্যা ছিল, ছোট থেকেই সে বড্ড শান্ত। কখনো মুখ খুলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেনি সে, ছিনিয়ে নিতে পারেনি নিজের অধিকার। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে আর ভাগ্যকে দোষারোপ করে কোনোক্রমে কেটে যাচ্ছিল সময়েরা। একদিন  আচমকাই তাল কাটল তাতে।

মৃদুভাষী শান্ত নাদিরা হটাৎ ক্ষেপে উঠল। হাতের কাছে যা পেল তাই ছুঁড়ে মারল স্বামী - শাশুড়িকে তাক করে, সাথে অশ্রাব্য গালাগালির বন্যা। বাচ্চাদের ধরে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিল সে, তারপর টেবিলে বসে পায়ের ওপর পা তুলে সাহেবী চালে সেরে ফেলল খাওয়া।
চোখ কপালে উঠল সকলের, শান্ত - সব্বার খাওয়ার পরে খুদকুড়ো খেয়ে কোনোক্রমে বেঁচে থাকা মেয়েটার হল কি!  নিশ্চয় ভুতে ধরেছে!  অতএব ওঝা - গুনিন সব বুলাও!

শুরু হল তাবিজ - কবচ - ঝাঁটার মার - শুকনোলঙ্কা পোড়া। গুনিন নিদান দিলেন, বেয়াড়া জিন ধরেছে তাকে; ছাড়াবার জন্য মহৌষধি লাগবে। পরিবারের কাছ থেকে মোটা টাকা বাগিয়ে নিয়ে শুরু হল চিকিৎসার নামে গরম লোহার রডের ছ্যাঁকা! কেউ নাদিরার আর্তচিৎকার শুনে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি, যদি তাদেরও জিন ধরে!  সব ওষুধের প্রয়োগ শেষে যখন ক্লান্ত গুনিন জিন গায়েব বলে প্রস্থান করলেন, গিয়ে দেখা গেল অজ্ঞান নাদিরার ক্ষতবিক্ষত চামড়ায় জমে চাপ চাপ রক্ত, পোড়া দাগ ; সামনের দাঁতগুলি ভাঙা।

মধ্যবিত্ত রমেনবাবু কারো সাতেপাঁচে থাকেন না, বড্ড সাধারণ তাঁর প্রতিটি আচার আচরণ। পাড়ার ছেলেপিলেরা ক্ষ্যাপায় " ম্যাদামারা বা*কাকু " বলে, স্ত্রী লিপ্ত পরকিয়ায়।
এই আপাত শান্ত ভিজে ন্যাতার মত রমেনবাবু সন্ধ্যা হলে কেমন বদলে যান। দাপুটে কর্তা হয়ে ওঠেন, খালাসিটোলায় যান। তার ভেতর তখন এক অন্য মানুষ জেগে ওঠে, নিজেকে ডক মাফিয়া রাম বলে পরিচয় দ্যান। পোষা রক্ষিতা ফুলু থাকে খিদিরপুরে, যমের মত ভয় পায় তাঁকে। নিজের বউকে তখন চিনতে পারেন না রমেন, সে মানেমানে তাঁর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলে। একরাতে মিথ্যেমিথ্যে এনকাউন্টার লেগেছে বলে ফুলুর আস্তানা থেকে বেরোন তিনি, পরেরদিন দুপুরে ডকের কাছে পাওয়া যায় তাঁর লাশ, হার্টফেল করেছিলেন অতিরিক্ত ভয় পেয়ে।

অনেকদিন আগে একখানি গান খুব প্রিয় ছিল, " তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন জানো না...."! মানুষের মন, বড্ড জটিলে ; স্মৃতিগর্ভে নিত্য নতুন ঘটনাক্রমের আনাগোনা৷ কোনো জায়গা দেখে আচমকা মনে পড়া " এখানে তো আগে এসেছি...!" অথবা কোনো অচেনা মানুষকে দেখে মনে পড়া " অতি পুরাতন মিত্র", সবই মনের গহীনে শুরু হওয়া এক অদ্ভুত খেলার প্রতিক্রিয়া।

ওপরের ঘটনাদুটি গল্প মনে হলেও সত্যি। অন্তত আজও গ্রামবাংলার ঘর থেকে শোনা যায় " ভুতে ধরেছে...." চিৎকার।  প্যারাসাইকোলজিস্টরা একে " অ্যান্টি হিউম্যান অ্যাটাক " বা গদা বাংলায় অন্য স্পিরিটের আক্রমণ বলে থাকলেও মনোবিদদের ভাষায় এটিই " মালটিপল পারসোন্যালিটি ডিজঅর্ডার"।
হিন্দী ভুলভুলাইয়া সিনেমাটি দেখেছিলেন? একজন শান্ত গৃহবধূ নতুন জায়গায় থাকতে এসে একজন নৃত্যশিল্পী মঞ্জুলিকার গল্প শুনে অবচেতনে হয়ে উঠেছিলেন স্বয়ং মঞ্জুলিকা। গড়গড় করে বাংলা বলতে শুরু করেছিলেন, যা তিনি কখনো শেখেননি হয়ে উঠেছিলেন সেই নৃত্য পারঙ্গমা। সকলে ভুতে ধরেছে ভাবলেও মনোবিদ অক্ষয়কুমার যখন অনুসন্ধান করেন তখন জানতে পারেন শৈশব থেকে লুকিয়ে রাখা চাপা ক্রোধ, হতাশা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে অন্য রূপ ধরে। এটাই চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় " ডিসোসিয়েটিভ পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার "।

এক মানুষের ভেতর যখন এক বা একাধিক ব্যক্তিত্ব সুপ্ত অবস্থায় অবস্থান করে তাকে বলা হয় " মালটিপল পারসোনালিটি ডিসর্ডার"।  প্রতিটা মানুষের ভেতরেই সুপ্ত হিসাবে থাকে অজস্র অপ্রাপ্তি, অভিযোগ, হতাশা, লুকোনো থাকে ঘৃণা। এই বোধ যখন প্রকৃত মানুষটির ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে উঠে আসে অন্যরূপে তখন তাইই " ভুতে ধরা " বলে গন্য হয়। আদপে এটি একটি মানসিক রোগ। এর বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন নাম, যেমন -- মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজর্ডার, বাইপোলার ডিজিজ, কনভার্সন ডিসর্ডার,  পিটিএসডি ইত্যাদি।
এই রোগী নিজেকে আচমকাই নিজেকে অন্য মানুষ ভাবতে শুরু করেন, তাঁদের মত আচরণ করেন, প্রচণ্ড হিংস্র হয়ে ওঠেন। নিজেকে অথবা অপরকে আঘাত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। পরিবারের সহমর্মিতা ও কিছু ওষুধ দ্বারা এঁরা নিজেরাই সেরে উঠে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। তবে " ভুতে ধরেছে " বলে ওঝা - গুনিন ডেকে ঝাড়ফুঁক - তুকতাক ইত্যাদিতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বিপর্যস্ত রোগী আরো ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেকে আঘাত করে বসেন, ফলে তাঁর মৃত্যুও হতে পারে। এমন রোগীর মধ্যে আত্মহত্যা ও উদ্বেগজনিত হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বড্ড বেশি৷ আজ গোটা বিশ্বের প্রায় দুই শতাংশ মানুষ এই রোগের শিকার।

সাধারণত অপূর্ণ আশা, হতাশা, ডিপ্রেশন, চেপে রাখা কষ্ট এই রোগ বয়ে আনে। যারা বেশি অন্তর্মুখী হন, তাঁদের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি৷, কারণ তাঁরা নিজের মনের কথা কারো সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনায় সক্ষম নন।
তাই মানুষের সঙ্গে মনের ভাব বিনিময় করুন, হতাশা পুষে রাখবেন না। কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে বিপন্ন বা অন্যায়ের শিকার মনে হলে প্রতিবাদ করুন, মনের ভেতর পুষে রেখে গুমরে মরবেন না। কোনো মানুষ আচমকা অন্য মানুষের মত ব্যবহার করলে তাকে ভুতে ধরেছে বলে কুসংস্কারের বলি হবেন না, শীঘ্র মনোবিদের সাহায্য নিন। সঠিক কাউন্সিলিং ও ওষুধ দ্বারা এই রোগ নিরাময় সম্ভব। সুস্থ বাঁচুন সুস্থ বাঁচতে দিন, অযথা নিজ প্রভুত্ব কায়েমের অভিপ্রায়ে অন্য মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবেন না।।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours