নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেট, অস্ট্রেলিয়া:

প্রেমে মিলন বিরহ ...
জগতে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের স্বরূপে খুঁজে পাওয়া যায় সমস্ত হৃদয়ের অনুভূতি এক। 
আসুন পড়ি ....
কৃষ্ণ প্রেমে রাধা কেমন ব্যকুল আর রাধা প্রেমে কৃষ্ণ। 
“কেন বলে প্রেমের মরা জলে ডোবে না “
বৈষ্ণবেরা প্রেমের জগতে মৃত্যু স্বীকার করেন না। অনেক পদেই দেখা যায়, দশম দশায় রাধা কৃষ্ণের সঙ্গসুখ কামনা করছেন আসন্ন মৃত্যু, তখনও সখীদের বলছেন মরিলে আমাকে তমাল ডালে বাঁধিয়া রাখিও (তমালের বর্ণ কৃষ্ণের বর্ণের মত), শ্যামলতা দিয়া বাঁধিও (নামের মিল-হেতু), “আমি হরি-লালসে পরাণ তেজব, তায়ে পাওব আন জনমে”—এইরূপ নানা পদেই দেখা যায়, মৃত্যুর পরও তার প্রাণ কৃষ্ণসঙ্গের ইচ্ছা ত্যাগ করছে  না; মৃত্যুর পর “আমার এ মৃতদেহ তার চরণেতে দিও ডালি”—এই প্রেম পরমানন্দময়, রাধার মৃত্যুও তাঁকে আনন্দপথের যাত্রীস্বরূপ চিত্রিত করছে। আর একটি মাথুরের পদে রাধা বলছেন -আমার গলায় হার নিকুঞ্জে রইল , তিনি ফিরে আসলে যেন একবার মালা নিজের গলায় পরেন। বড় সাধ করে নিজের হাতে মালতী ফুলের চারা পুঁতেছিলাম কিন্তু যখন ফুল ফুটবার সময় হবে -তখন আর আমি থাকবো না; তোমরা আমার হয়ে মালতী ফুলের মালা গেঁথে তার গলায় পরায় দিও।” কৃষ্ণকে সেবা করার ইচ্ছা ও সঙ্গলিপ্সা মৃত্যু-পথযাত্রীর অন্তিম-দশাকেও আনন্দের পুষ্পে পুষ্পাকীর্ণ করছে । এই সকল পদে রাধা মৃতা ও মৃতপ্রায় নহেন,—অমৃতের অধিকারিণী।

কহিও কানুরে সই,   কহিও কানুরে,
পিয়া যেন একবার আইসে ব্রজপুরে।
নিকুঞ্জে রহিল এই  হিয়ার হেম-ছায়,
পিয়া যেন গলায় পরয়ে একবার।
রোপিনু মল্লিকা, নিজ করে,
গাঁথিয়া ফুলের মালা পরাইও তারে।
তরু-ডালে রইল  মোর সাধের শারী-শুকে,
মোর কথা পিয়া যেন শোনে তাদের মুখে।
এই বনে রহিলি তোরা যতেক সজনী,
আমার দুখের দুখী জীবন-সঙ্গিনী।
শ্রীদাম, সুদাম আদি যত তার সখা,
তা সবার সাখে তাঁর হবে পুনঃ দেখা।
দুখিনী আছয়ে  তার মাতা যশোমতী
উঠিতে বসিতে তার নাহিক শকতি।
পিয়া যেন তারে আসি দেয় দরশন,
কহিও কানুর পায় এই নিবেদন।
শুনিয়া ব্যাকুল দুতী চলে মধুপুরে,
  কি কহিবে শেখর বচন নাহি স্ফুরে।”

কানুর সঙ্গে মিলিত হবার আশা মরণান্তেও তিনি ছাড়েন নাই। মরণের পরেও এই দেহ দিয়ে তাঁর সেবা করবেন - এটা তাঁর কামনা।

“তাঁর অরুণ পদ যে-পথে হাটিয়া 
যাইবে, আমার অঙ্গ যেন সেই পথের মাটী হইয়া থাকে। “

“যে-সরোবরে তিনি নিতি নিতি স্নান করেন, আমি যেন তাহার সলিল হইয়া তদঙ্গ স্পর্শ লাভ করি। “যে ব্যজনী তাঁহার অঙ্গে বাতাস দেয়, আমি যেন সেই ব্যজনী-সঞ্চালিত মৃদু বায়ু হইয়া তাহার সেবা করি। “যে-মুকুরে তিনি তাঁহার মুখ দেখেন, আমি যেন সেই মুকুরের দীপ্তি হইয়া থাকি। “যেখানে যেখানে তাঁহার মূর্ত্তি শ্যামল মেঘের মত উদিত হইবে, আমার অঙ্গ যেন সেখানে সেখানে সেই মেঘাবলম্বী আকাশে পরিণত হয়।”
অর্থাৎ রাধার দেহের পঞ্চ উপাদান—
ক্ষিত্যপতেজমরুদ্ব্যোমে—যেন মৃত্যুর পরেও সেবকের মত তাঁহাকে ভজনা করে!
কি অসম্ভব শ্রদ্ধা আর নিবেদনের আবেদন । নিজেকে দেয়া মানে উপুড় করে দেয়া ...নিংড়ে দেয়া । দেয়াতেও যে সুখ ,সে অমোঘ সুখের বর্ণনা পাই এই পদ গুলো পড়লে । তখনি বলতে মন চায় রাধে রাধে । 

দশরথির একটা বৈষ্ণব গান - 
“দুর্গে কর এ দীনের উপায়,
 যেন পায়ে স্থান পায়।
আমার এ দেহ পঞ্চত্ব কালে, তব প্রিয় পঞ্চ স্থলে
আমার পঞ্চভূত যেন মিশায়।
শ্রীমন্দিরে অন্তর-আকাশ যেন মিশায়, এ মৃত্তিকা যায় যেন তব মৃত্তিকায়,
মা মোর পবন তব চামর ব্যজনে যেন যায়,
হোমাগ্নিতে মম অগ্নি যেন মিশায়।
আমার জল যেন যায় পদ্মজলে, যেন তবে যায় বিমলে,
দাশরথীর জীবন-মরণ দায়।”

কিন্তু দাশরথী জীবন-মরণ—এই দুই হতে মুক্তি চেয়েছেন বৈষ্ণব যে আনন্দময় পুরুষবরের আনন্দের স্বাদ পেয়েছেন সেই পুরুষের সঙ্গ তিনি চিরন্তন কালের জন্য কামনা করেন। শাক্ত কিন্তু—‘“যথা জলের বিম্ব জলে বিলয়’ সেই ভাবে আপনাকে ফুরাইয়া ফেলিয়া নিষ্কৃতি প্রার্থনা করেন” 
আহা! 
প্রেমের মাঝে ভক্তি 
সেই প্রেমে কি করে পাবে মানুষ মুক্তি ! এই প্রেম নয় কলুস আমরা বুঝি না , আসলে যাকে প্রেম বলি সেকি শুধুই নিজের করে রাখা খোয়ারে , নাকি হম্বি তোম্বিতে বাঁধা ! কতটা যত্ন থাকে আর কতটা থাকে সাধারণ করে রূপ সাধা!
বংশীবদন লিখেছেন —“না যাইও না যাইনা রাই বৈস তরুমূলে, অসিতে পেয়েছ ব্যথা চরণ-কমলে” 
সেই চরণ-কমলে একটা কুশাঙ্কুর ফুটলে তা কৃষ্ণের প্রাণে শেলের মত বিঁধে।

“সিনান দুপুর সময়ে জানি
তপত পথেতে ঢালে সে পানি’’

 দ্বিপ্রহরে যমুনার সিকতাময় পুলিন রোদে তাতিয়া উঠে, রাধা কি করে সেই উত্তপ্ত বালুকার পথে হেঁটে স্নান করবে ! এজন্য কৃষ্ণ আগে থেকে কলসী কলসী জল ঢেলে সেই পথ শীতল করে  রাখেন। রাধার প্রসাদী তাম্বুল পাওয়ার  আশায় তিনি পথে হাত পেতে থাকেন,।

‘‘লাজে হাম যদি মন্দিরে যাই,
পদচিহ্ন তলে লুটে কানাই।
প্রতি পদচিহ্ন চুম্বয়ে কান,
তা দেখি আকুল ব্যাকুল পরাণ।’’
পথে কৃষ্ণের অশিষ্টতা দেখে যদি রাধা লজ্জা পেয়ে গৃহে প্রবেশ করেন, তবে কৃষ্ণ সেই পদ-চিহ্নের উপর লুটাইয়া পড়েন এবং প্রতিটি পদ চিহ্ন চুম্বন করেন। এটা দেখে  রাধার প্রাণ আকুলি ব্যাকুলি করিতে থাকে।

এমন আকুতি এমন সমর্পণ এমন বিলীন হওয়া প্রেম আহা যেন সক্কলের আরাধ্য। 
অমন প্রেমিক কি হয় , প্রেম প্রেম ভাব যতো তত কৃষ্ণ হৃদয় নেই জগতে। 
ঘাটে রাধা স্নান করলে নাকি অপর দিকের ঘাটে কৃষ্ণের স্নান করা দুই হাত বাড়াইয়া রাধার স্পর্শ-করা জলের জন্য প্রতীক্ষা করা, তাঁর ছায়ার সঙ্গে নিজের ছায়া মিলানের  জন্য ঘোরা-ফেরা, তাঁর  অঙ্গের স্পর্শে যে-কাপড় পবিত্র হয়ে আছে, সেই বস্ত্রের সঙ্গে নিজের পরিধেয়ের একটু ছোঁয়াছুয়ি হওয়ার অপূর্ব্ব সুখের জন্য এক-রজকের কাছে কাপড় দেওয়া, কোন খানে রাধার নামের একটি অক্ষর পেলে দুর্ল্লভ সামগ্রীর মতো সেটিকে গ্রহণ করা, যে-দিন রাধার অঙ্গস্পৃষ্ট হাওয়া যে-দিকে বয়ে যায়, সে-দিন সেই বাতাসের স্পর্শ-সুখের জন্য সারাদিন সেই-দিকে থাকা, ইত্যাদি প্রচেষ্টা পূর্ব্বরাগের প্রমত্ত অবস্থাসূচক। 

রায়শেখর বলেছেন —“দেখা সাক্ষাৎ নাই, কথা-বার্ত্তার সুযোগ নাই, তথাপি কত প্রকারে যে কৃষ্ণ তাঁহার মনের আগ্রহ ব্যক্ত করেন, কবি তাহার কয়েকটি মাত্র অবস্থার কথা বলিলেন।
 প্রেম এখানে শুধু কবিত্বের উৎস নহে, উহা দিনরাত্রের তপস্যা “
রাধে কৃষ্ণ! 
(তথ্যসূত্র : নেট ঘাটাঘাটি করে আর বৈষ্ণব সাহিত্য থেকে।)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours