জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:


তর্কের খাতিরে যদি বলাও যায় যে এই রকম অপরাধে অপরাধীদের এনকাউন্টারে খুন করাই আইন।বেশ। তবে প্রশ্ন উঠবে যে এই চারজনই যে ঐ অপরাধ করেছে সেটি জানা গেল কীভাবে? এটি কি অপরাধীদের আদালতে স্বীকারোক্তি? সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত?প্রত্যক্ষদর্শী আছে?

আজ্ঞে,কোনটিই নয়।শুধুমাত্র পুলিশ বলছে।তার মানে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে পুলিশ সত্যি কথা বলছে।কোন পুলিশ?যে পুলিশ প্রথমে ধর্ষণের অভিযোগই নিতে চায়নি। যে পুলিশের গাফিলতি বা ইন্ধনে অসংখ্য ধর্ষিতা বিচার পান না।যে পুলিশ সতত অভিযোগের কাঠগড়ায়।এনকাউন্টারের আগে পর্যন্ত যে পুলিশ ছিল উত্তেজিত জনতার চোখে ভিলেন।এনকাউন্টারের ম্যাজিকে রাতারাতি জিরো থেকে হিরো হয়ে যাওয়া পুলিশের কথা সকলে বিশ্বাস করছেন আর মনে করছেন ঐ চারজনই নিকেশ হল। নাকি আসলে ধর্ষণের প্রমাণগুলি নিকেশ হল?

ভালো করে ভেবে দেখুন তো একবার।
অভিযুক্তদের পক্ষে কোনও আইনজীবী না দাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হল।চাউর করা হল যে এত ঘৃণ্য অপরাধীদের পক্ষে কেউ দাড়াবেন না। তার মানে, অভিযুক্ত বিচারের আগেই অপরাধী হয়ে গেল প্রত্যেকের আইনি সহায়তা পাবার অধিকার আছে। কোন আইনজীবী থাকবেন না মানে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাজানো প্রমাণ তুলে ধরলেও আইনি যুক্তিতে সেগুলি মোকাবিলা করার কেউ থাকবে না।এরপর মাঝরাতে কোন সাক্ষী ভিডিও ফুটেজ ছাড়া সবার অলক্ষ্যে ঘটনার পুনর্নিমানের গল্প। চারজন রোগা পাতলা অভিযুক্ত। তাদের হাতে হ্যন্ডকাফ কোমরে দড়ি থাকার কথা। সঙ্গে প্রচুর পুলিশ। তাদের সবার হাত ফস্কে চোখে ধুলো দিয়ে কোমর বা কাধের আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পেশাদার বন্দুকবাজের মতো পুলিশকে এক হাতে গুলি আরেক হাতে ইট ছুড়তে পালানোর চেষ্টা।আর সেই পরিস্থিতিতে নিরুপায় পুলিশের এনকাউন্টার। গুলি দেহের নিন্মাঙ্গে লাগার কথা। অথচ সব গুলি লাগল উর্ধাঙ্গে যাতে মৃত্যু নিশ্চিত হয়। রাতের অন্ধকারেও নিখুঁত লক্ষ্যভেদ। একজনও আহত নয়, সকলেই নিহত। অর্থাৎ মারাত্মক জখম অবস্থায় হাসপাতালেও কাউকে ভর্তি করা গেল না। তার মানে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেবার অবস্থাতেও কাউকে রাখা হয়নি। কোন ঝুকি নেয়নি পুলিশ।

পরিকল্পিত চিত্রনাট্য। তবে অসংখ্য ফাঁক। ফাঁক কোথায় বরং বড়ো বড়ো ফাটল।

যারা একটি নির্মম ঘৃণ্য অপরাধের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আবেগের বশে এই এনকাউন্টার সমর্থন করছেন,তারা একটু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো যে ঐ চারজনই যে অপরাধী সে বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ নিশ্চিত। না, বলতে পারবেন না। তারা তাদের বিশ্বাস তৈরি করেছেন ঐ পুলিশের ভরসায়। হ্যা, অভিযুক্তরা অপরাধী হতেও পারে। কিন্তু হতেও পারে আবার নাও হতে পারে এমন চারজনকে খুন করা হল।দেশবাসীকে ধোকা দেওয়া হল যাতে কারা অপরাধী সে কথা কেউ কখনোই জানতে না পারে। কিন্তু যে বা যেসব পুলিশ অফিসার ওদের খুন করলেন, তারা যে খুন করেছেন ও প্রকারান্তরে ধর্ষণের তদন্ত প্রক্রিয়াকে এনকাউন্টারে লোপাট করেছেন সেটি অনেকটাই স্পষ্ট। অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতের অধীনে পুরো ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন।

ঘটনার গতি প্রকৃতি দেখে কেস ধামাচাপা দিয়ে কাউকে আড়াল করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। চারজন নিরপরাধ (অভিযোগ প্রমাণের আগে অভিযুক্ত নিরপরাধ) ব্যক্তিকে খুনের বিচারও ধর্ষণের বিচারের মতোই ফাষ্ট ট্রাক কোর্টে হওয়া উচিত।
আমাদের দেশে প্রতি আধঘন্টায় একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণ করে খুনও বিরল নয়। আজ পর্যন্ত শুধুমাত্র ধনঞ্জয়ের ফাঁসির কথা শুনেছি।হাই প্রোফাইল ধর্ষিতাদের কাহিনী মিডিয়ায় চর্চিত হয়। গরিব গুর্বো মেয়েরা ধর্ষিতা হলে সে সব খবর হয় না। বিপরীতে হাই প্রোফাইল ধর্ষকরা শাস্তি পায় না। তারা পুলিশ আইনজীবী ম্যানেজ করতে পারে। গরিব গুর্বো ধর্ষকদের সে উপায় নেই। তাদের জন্য বিচার ফাঁসি বা এনকাউন্টার। কখনো তারা হাই প্রোফাইল অপরাধীর ড্যামিও যাদের যখন তখন তুলে এনে চার্জ দিয়ে দেওয়া যায়।

আইনে বলে যে একজন অপরাধী সাজা না পাক কিন্তু একজন নিরপরাধ যেন কোনভাবেই সাজা না পান। সশস্ত্র অবস্থায় জনমত ও রাষ্ট্রের কৃপাধন্য যে সব এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট পুলিশ বীরপুঙ্গবরা চারটি নিরস্ত্র রোগাপাতলা খালাসিকে গুলিতে ঝাঝরা করে দেশজুড়ে 'মসিহা'র সম্মান পাচ্ছেন, নিত্যানন্দ-রামরহিম-আসারামদের গায়ের লোম ছিড়তে পারলেও তাদের এলেম বুঝবো। তারা কচু গাছ কেটে বীর, বট গাছে গম্ভীর।

এই লেখা পড়ে কেউ ভাবনেন না যে আমি ধর্ষকদের হয়ে সাফাই গাইছি। প্রতিটি মানুষের জন্মস্থানকে যারা অপবিত্র করে তাদের হয়ে সাফাই গাওয়া স্বপ্নেরও অতীত। এই অপরাধ নির্মূল হোক, এইই প্রার্থনা। আর সেটি হতে পারে কঠোর আইন, চেতনা ও সুশিক্ষার দ্বারা। বাবা-মা-পরিবেশ আগামী দিনে তেমনই সুসন্তান গড়ে তুলুন যারা মাতৃজাতিকে যথাযথ সম্মান দেবে।ঠাকুরমা-দিদিমা-পিসিমা-মাসিমা-জেঠিমা-কাকিমা বা মা-স্ত্রী-প্রেমিকা-দিদি-বোন-কন্যা-নাতনি বা সর্বোপরি বন্ধু হিসাবে পুরুষের হাতে হাত ধরে রাখা নারী যেন পারস্পরিক মর্যাদা ও নির্ভরতায় পরস্পর পরস্পরের হতে পারে। আজকের এই অশান্ত পরিবেশের মধ্যে দাড়িয়ে এটিই কাঙ্ক্ষিত। একজন নারীই একজন পুরুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। সে বন্ধুত্ব চিরন্তন হোক। (ক্রমশ)



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours