সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর, হুগলি:

অশ্বঘোষ – খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকের একজন মহাকবি ও মহান যুক্তিবাদী শাস্ত্রবিদকে আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই একজন বিদগ্ধ বৌদ্ধধর্ম প্রচারক হিসাবে । বিখ্যাত কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের সময়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয় । বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী চরিত্রটি একধারে যেমন ছিলেন প্রচারক, দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ তেমনি অন্যদিকে ছিলেন মহাযানী গবেষক, কবি ও নাট্যকার ।
অশ্বঘোষ জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ ছিলেন । কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিব্বত ও চীনে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য তিনি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন । বিশ্বখ্যাত ‘বুদ্ধচরিত’ তাঁর প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা । অশ্বঘোষের আরও দুই বহুল পরিচিত গ্রন্থ সৌন্দরানন্দ ও সারিপুত্রপ্রকরণ বৌদ্ধধর্মের প্রচারমূলক রচনা । তিনি বৌদ্ধধর্মের ‘অষ্টাঙ্গ মার্গ’-এর অনুগামী ছিলেন । তাঁর রচনাগুলিতে হীনযানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকাশ পেয়েছে । বৌদ্ধধর্ম ছাড়াও অশ্বঘোষ অন্য দর্শন সম্পর্কিত বিষয় যেমন – প্রাচীনতর সাংখ্যযোগ অধ্যাত্মবিদ্যায় নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন । তাঁর লেখা ও কর্মপদ্ধতিগুলিকে বিশ্লেষণ করলে এটা অনুমান করা যায় তিনি হীনযান মতাবলম্বী হলেও বৌদ্ধধর্মের মহাযান ধারার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতি ক্রমে ক্রমে অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। অশ্বঘোষ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কর্মপ্রক্রিয়ার প্রতি নিষ্ঠাবান থাকলেও তিনি এই ধর্মের একজন উৎসাহী প্রচারক ছিলেন।
অশ্বঘোষ ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু প্রারম্ভে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের তীব্র বিরোধী ছিলেন । কিন্তু হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের মূল্যবোধ নিয়ে এক পন্ডিতের সাথে বিতর্কে তিনি বৌদ্ধধর্মের নীতি ও আদর্শকে মেনে নেন এবং পূর্বের বিরোধী এই বৌদ্ধ ধর্মের শিষ্য হন। কণিষ্কের সময় চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলনে মহাযান বৌদ্ধ সম্পর্কে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্যের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক অশ্বঘোষ জন্মেছিলেন (সম্ভবত ৮০ খ্রীঃ-১৫০ খ্রীঃ) প্রাচীন ভারতের সরযূ নদীর তীরে অবস্থিত সাকেত নগরে (বর্তমানে অযোধ্যা) । তাঁর মায়ের নাম সুবর্ণাক্ষী । পিতা ছিলেন একজন সচ্ছল কুলীন ব্রাহ্মণ । তবে ঐতিহাসিক লামা তারানাথের বর্ণনা থেকে জানা যায় তিনি ছিলেন সংঘগুহ্য নামক এক ধনী ব্রাহ্মনের পুত্র।
অশ্বঘোষ ধর্মান্তরিত হয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করে সাকাতের বলাকারাম বিহারের প্রধান পুরোহিত শ্রীমৎ ধর্মসেন মহাস্থবিরের কাছে গিয়ে উপসম্পদা গ্রহণ করেন । তাঁর কাকা ভিক্ষু শুভগুপ্তকে দেখে তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন । তিনি পাটলিপুত্রে চলে আসেন উচ্চতর বৌদ্ধদর্শনের জ্ঞান লাভের জন্য । অশ্বঘোষ মহাযান বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃত ভাষা দুটিতেই অসামান্য পারদর্শী ছিলেন । পাটলিপুত্র থেকে শিক্ষালাভ শেষে তিনি কুষাণ সাম্রাজ্যে চলে আসেন । তাঁর  পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, অসীম জ্ঞান এবং কবিত্ব শক্তির কারণে কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক তাঁকে রাজকবি পদে অভিষিক্ত করেন ।
সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র অনুযায়ী তাঁর রচিত ‘বুদ্ধচরিত’ আদপে এক মহাকাব্য । বলা হয় মহাকবি কালিদাস-এর লেখার উপর এই মহাকাব্যের প্রভাব ছিল । সংস্কৃত ভাষায় বুদ্ধচরিত-এর ১৭ সর্গ পাওয়া গেলেও চীনা ও তিব্বতী  অনুবাদে-এর ২৮টি সর্গ-এর দেখা মেলে । সংস্কৃতে মূল গ্রন্থটিতে বুদ্ধের প্রথম জীবন হতে ধর্মপ্রচারের আরম্ভ কাহিনী পর্যন্ত বিবৃত আছে । আবার চীনা-তিব্বতী অনুবাদে গৌতম বুদ্ধের বোধিলাভের কাহিনী পর্যন্ত উল্লেখ আছে । তাঁর দ্বিতীয় বহুল প্রচারিত কাব্যগ্রন্থ ‘সৌন্দরান্দ’-এ বুদ্ধের জীবনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার সমবায়ে রচিত । আর ‘সারিপুত্রপ্রকরণ’ একটি সংস্কৃত ভাষায় লেখা নাটক । এছাড়াও অশ্বঘোষের নামে ‘ব্জ্রসূচী’ ও ‘সূত্রালঙ্কার’ নামে দুটি গ্রন্থ আছে, তবে সেদুটি স্বয়ং অশ্বঘোষের লেখা কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক আছে । অশ্বঘোষ যখন মূলত একজন কবি হিসাবে বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্বের বিষয়গুলিকে দর্শনচিন্তায় প্রকাশ করেছিলেন তখনই বোঝা যায় তাঁর মৌলিকতা ও বিপুল কাব্যিক ক্ষমতার নিদর্শনকে । তিনি নীতিবোধে অটল থাকলেও তাঁর কাব্যের মাধ্যমে মধুর, কোমল শিল্পানুভূতিগুলি প্রকাশ পেয়েছে। বৌদ্ধধর্মতত্ত্বের মত গদ্যময় দার্শনিক বিষয়গুলিকে এমন সুললিত, মর্মস্পর্শী ও মহীয়ান কাব্যিক ভাষার আড়ালে পরিবেশন করেছেন যে তাতে তাঁর ভাব প্রকাশের সূক্ষ্ম শিল্পরুচির পরিচয় পাওয়া যায়।
অশ্বঘোষ আমৃত্যু পর্যন্ত্য তথাগতের বাণী প্রচারে জীবন উৎসর্গ করেন । বৌদ্ধ হিসাবে তিনি প্রথমে সর্বাস্তিবাদী ছিলেন । তাঁর বিশেষ মতবাদ মৈত্রী, করুণা ও বুদ্ধভক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যা প্রধানত মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়। তিনি কেবল একজন বৌদ্ধ দার্শনিক ছিলেন না, সঙ্গীত শাস্ত্রেও তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। ধারণা করা হয় ১৫০ খ্রীস্টাব্দে পেশোয়ারে তাঁর মৃত্যু হয়।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours