দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

মরণ!
বৃদ্ধস্য প্রেমলীলা বলে কথা।
-- সুযোগ বুঝে বুড়ির পিছনে ঘুর ঘুর করলে, ষাঠের দশকের এই ডায়ালোগ ছিল প্রত্যাশিত। মরণ!  কিন্তু এখন?
বীরজুর গলায়-- বুড্ডা হোগা তেরা বাপ!
কে যেন বলেছিল আসল প্রেম তো পৌঢ়ত্ব অতিক্রম করেই!
সোজা কথায় বৃদ্ধ বয়সেই!
বাগবানের মত বুড়ো বুড়ি পরস্পরকে একটু কাছে পেতে চায়। বুড়োর বিরক্তিকর কাসির আওয়াজ শুনলে বুড়ি বোঝে, বুড়োটা এসেছে। আসলে বুড়ো গেছিল ভেসলিনের একটা ছোট কৌটো  আনতে, কোদালের মতো বুড়ির ফাটা পায়ে একটু বুলিয়ে দেবে বলে! তাই তো, বাঁশির মতো নাকে ঝিঙে ফুলের মতো টুপা নাকছাবিটা ঘোরাতে ঘোরাতে  ভালোবাসায় রাঙা হয়ে বলেছিল -- মরণ!

এই বুড়ো বয়সের প্রেম চকিত চাহনি নয় ঠিকই, তবে বাতাস আর জীবনবায়ুর মতো। জোরে জোরে বইলে, অসহনীয়। আবার না থাকলে প্রাণ বায়ু বেরিয়ে যায়।

তাই বুড়ো বুড়ির গোপন খুনসুটি--
আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে --
কিছুই কি নেই বাকি?'
নাতি নাতনীরা বড় হয়েছে। তাই চোখ পাকিয়ে বুড়ি বলে-- আস্তে খোকারা শুনতে পাবে। তার পর পানের ডিব্বা থেকে মিঠেপাতি একটা পান বুড়োর হাতে দিয়ে, নিজে মুখের এক পাশে ঠুসে একরাশ লজ্জা লতিকার হাসি নিয়ে বললে,
'রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে' ।

আজ বুড়ির গ্রীবা ভেঙে পড়েছে। পরনে লাল বা কালো রেশমের শাড়ি কোনটাই নয়। লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে মুখটা খুব মিষ্টি, পাকা আম্রপালির মত। যেন হাসিতে, যেকোন মুহুর্তে টুপ করে খসে পড়তে পারে! বুড়ো অস্ফুট স্বরে মনে মনে বলে--

"আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন
আজ ঐ চোখে সাগরের নীল
আমি তাই কি গান গাই কি
বুঝি মনে মনে হয়ে গেল মিল"।

এই বাতের ব্যথার ওষুধটা খেয়েছো? -- বুড়ি ঘাড় নাড়ে।
তুমি প্রেসারের ওষুধ খেয়েছো? -- দেখেছো? না মনে করালে খাবে না। তারপর চিৎপটাং -  বলেই বুড়ি নকল রাগ নিয়ে তাকালো বুড়োর দিকে। --- বেশ ভালোই তো হবে, তোমার... বুড়ো বলার আগেই জবাব দিলো-- আমি পারবো না, আমি বলে নিজেই... তোমার জন্য তো শান্তিতে মরতে পারি না। তারপর কে আগে মরবে, এই নিয়ে চলে ঝগড়া। --ওই শুরু হলো, অমর প্রেম বলে বৌমা  উনার তেনাকে ইশারা করেন!

সপ্তপদী কবেই শেষ হয়েছে, তাদের, সেটা এই বয়স জানে। তবুও বললাম যে, আসল ভালোবাসা শুরু শেষ থেকেই। তাই কে আগে মরবে, এই ঝগড়া মনে করিয়ে দেয়--
"এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত তুমি বলত?"

প্রেমের বয়স লাগে না। তাই কাব্য করে বলতে ইচ্ছে হয়-- 
"আবার সেজে এস, চলো ফিরে যাই আবার,

বৃদ্ধ হলেই বা, এখনও তো জীবনের ঘ্রাণ পাই,

অনুভূতি যত যাক শুষে, ফেলে আসা দিনগুলি কে ভুলতে পারে বল ?

চামড়া ভাঁজের নীচে শক্তিহীন দৈন্যতা ধরে রাখা, ইচ্ছেগুলির নবীনতা হারায়নি এখনও !"

জীবনের রেল কামরায়, এই বয়সে দেখাটা হঠাৎ নয়। অনন্ত কালের!
তাই বুড়ো বুড়ির গল্প সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের "যেতে যেতে"-র মতো। তবে শুনুন সেই গল্প--

তারপর সেই রাজকন্যা
একদিন এই আজকের বুড়োর আঙুলে আঙুল জড়িয়েছিল।’
সে  তাকে আস্তে আস্তে বলেছিল:

“তুমি আশা,
তুমি আমার জীবন।”

শুনে এই বুড়ি  যেন বলেছিল:
“এতদিন তোমার জন্যেই
আমি হাঁ করে বসে আছি।”

বুড়োধাড়ীরা আগ্রহে উঠে ব’সে
জিগ্যেস করবে: ‘তারপর?’

ব্যাপারটা তাদের মাথায় যাতে ঢোকে
তার জন্যে
ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার হয়ে
মিলিয়ে যেতে যেতে বুড়ো বলল-

‘তারপর? কী বলব-
     সেই রাক্ষুসীই তাকে খেলো।’
--- তখন প্রথমে বুড়ো হাসলেও, বুড়ো, বুড়ি, আর তাদের বড় নাতি নাতনীরা সবাই মিলে গুটোপুটি!! এমন যেন হয়! 

বুড়ো বুড়ি বসে বসে ভাবে--

"রোজ কত কী ঘটে যাহা-তাহা --
এমন কেন সত্যি হয় না, আহা।"

হাজার হলেও সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে...
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours