জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:


"নির্বিচার হত্যা"

সংবাদে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এনকাউন্টারে অভিযুক্তদের মৃত্যুর খবর ভয়ংকর। যদিও সত্যাসত্য জানি না এবং সেটি সন্দেহের উর্ধে নয়।

এখন প্রশ্ন হল এই রকম অপরাধে অভিযুক্তরা পালায় কীভাবে? কে দায়ী? নাকি সাজানো? অপরাধ প্রমাণে অপদার্থতা ঢাকতে প্রয়াস? রাতারাতি আবেগের স্রোতে ভেসে নায়ক হবার চেষ্টা? পুলিশি কর্মদক্ষতার প্রমাণ? বিতর্ক ধামাচাপা দিয়ে পক্ষে হাওয়া ঘোরাবার উদ্যোগ? এইসব 'অপ্রীতিকর' প্রশ্ন পালে হাওয়া পাবে না কারণ প্রতিকূলে 'প্রীতিকর' ঝড় বইছে।

কিন্তু 'অভিযুক্ত' কেন, 'অপরাধী'দেরও এভাবে মারা যায় না। এই প্রবণতা চরম বর্বর ও স্বৈরতান্ত্রিক।

প্রথমত, মিডিয়া বা পুলিশ দাবি করলেই হবে না, আদালতে দোষ প্রমাণিত হতে হবে। এমন ঘৃণ্য অপরাধে দোষী প্রমাণিত হলে বর্তমান আইন অনুযায়ী ফাঁসিও হতে পারে। কোনও অসুবিধা নেই।

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রশক্তি, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক Welfare State বিনা বিচারে বা বিনা দোষ প্রমাণে, এমনকি দোষী প্রমাণিত হবার পরেও আইন হাতে তুলে নিতে পারে না বা প্রকারান্তরে গণধোলাইতে হত্যা করতে পারে না। আইনের মাধ্যমেই শাস্তি হতে হবে। মনে রাখতে হবে, অভিযুক্তরা পুলিশের হাতেই বন্দি ছিল। পুলিশ যেভাবে বন্দি রাখে তাতে কোনভাবেই পালানো সম্ভব নয়। গল্প অন্যত্র।

অনেকেই এই খবরে তৃপ্তি পাচ্ছেন। ভাবছেন সুবিচার হল। ভাবনা ও তৃপ্তির অধিকার সকলেরই আছে। কিন্তু আবেগ বড়ো অন্ধ। এবং প্রায়শই অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো।

এই এনকাউন্টারের খবর প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশের প্রশংসায় আর অভিনন্দনে উপচে পড়ছে সোসাল মিডিয়া। উদ্দেশ্য ও বিধেয় মারাত্মকভাবে সফল। গভীর রাতে ফেক সার্জিকাল স্ট্রাইকের খবরেও এভাবেই আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল প্রচুর মানুষ প্রচুর মিডিয়া। চিলের পেছনে আসমুদ্রহিমাচল দৌড়ানোর পরে কানে হাত দিয়েছিলাম আমরা।

আচ্ছা, ধরা যাক আপনি একজন পুরুষ। আপনি এই এনকাউন্টারের তীব্র সমর্থক। আপনার বিরুদ্ধে একজন মহিলা ধর্ষণ করে হত্যার চেষ্টার মিথ্যে অভিযোগ আনলেন। ওনার অভিযোগ পেয়েই পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করল। এই খবর মিডিয়ায় প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই মিডিয়া, সোসাল মিডিয়া, জনতার আবেগ সব আছড়ে পড়া শুরু হল। গণধোলাই, ফাঁসির দাবিতে উত্তাল জনতা। আপনার আত্মপক্ষ সমর্থন কেউ শুনতেও পেল না। পেলেও বলল যে দোষীরা অমন বলেই। এদিকে আবার পুলিশ আপনার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ যোগাড় করতে পারছে না। এর মধ্যে আবার ঘরে বাইরে প্রবল চাপ। শেষ পর্যন্ত একটি অসাধারণ উপায় বের করা হল। মাঝ রাত্রে গারদের দরজা খুলে এক কনস্টেবল বললেন, 'আপনি পালান। এখানে থাকলে আপনার ফাঁসি হবে।' আপনি বললেন, 'আমি পালাব না। আদালতে দাঁড়িয়ে এই মিথ্যে অভিযোগের মোকাবিলা করব।' এতটা শুনে সেই কনস্টেবল ভিতরে চলে গেলেন। হয়ত বড়কর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে। কিছুক্ষণ পরে আপনি দেখলেন, একটি মারাত্মক হিংস্র কুকুর ঢুকিয়ে দেওয়া হল আপনার ঘরে। আপনি প্রাণভয়ে খোলা দরজা দিয়ে দৌড়তে শুরু করলেন। মুহূর্তের মধ্যে পেছন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এলো ধারালো বুলেট। আপনার ছিন্নভিন্ন দেহটি ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর কোলে।

একজন 'ধর্ষক'এর মৃত্যু হল। একটি খবরের জন্ম হল। পরের দিন সেই তৃপ্তির খবর শুনে বহু মানুষ তাদের শুভদিনটি শুরু করলেন। মিডিয়া থেকে সোসাল মিডিয়া সর্বত্র বীর সাহসী করিৎকর্মা পুলিশের প্রতি অভিনন্দনের বন্যা। প্রচুর হাততালি। কান পাতা দায়।

মাননীয়, আপনি কি অনুভব করছেন সেই হাততালির শব্দ? চেষ্টা করুন, পারবেন। কারণ এই পরিস্থিতিটি কাল্পনিক এবং আপনি এখনও জীবিত আছেন। এবং জীবিত মানুষ কল্পনা করতে পারে, তলিয়েও ভাবতে পারে। চাইলে, নির্বিচার হত্যার অর্থ বোঝাও তার দুঃসাধ্য নয়।

প্রচুর মানুষ এই এনকাউন্টারে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন। যেদিন রূপ কানওয়ারকে জীবন্ত পুড়িয়ে 'সতী' বানানো হয়েছিল, সেদিনও পুরো গ্রাম সোচ্চার সমর্থনে ভেঙে পড়েছিল সেই মহতী যজ্ঞ দেখতে। সেদিনের ঘটনাটির সঙ্গে এই ঘটনাটি কোনওভাবেই তুলনীয় নয়। কিন্তু মানুষের হিতাহিতজ্ঞানশূন্য আবেগ যে কী ভয়ংকর হতে পারে, দুটি ঘটনাতেই সেটি প্রত্যক্ষ করা গেছে ও যাচ্ছে।

আগামী সময়ে যদি অভিযুক্তরা আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হয় তবে কে তার দায় নেবে ?

এটি ঠিকই যে অনেক রেপ কেসেই অপরাধ প্রমাণে পুলিশের গাফিলতি থাকে। অভিযুক্ত অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও বেকসুর খালাস পায়। এখন প্রশ্ন হল, এটি কীভাবে আটকানো যায়।

আমার মনে হয়, দুভাবে।

এক, আইন করে তিনমাসের মধ্যে রেপ কেসের বিচার। এবং অপরাধ প্রমাণে পুলিশের অপদার্থতার প্রমাণ পেলে তাদের কারবাস। এবং ধর্ষিতাকে বিনামূল্যে উচ্চ পর্যায়ের আইনি সহায়তা।

দুই, অভিযোগ ওঠা মাত্রই সত্য মিথ্যা যাচাই না করে বিনা বিচারে এনকাউন্টারে খুন করা।

এখন প্রশ্ন হলো কে কোন মতের পক্ষে। আমি প্রথমটির। (ক্রমশ)
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours