কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

এ মুহূর্তের 'সিংহম'। তাও পর্দার না, একেবারে রক্তমাংসের। জলজ্যান্ত।
'তেড়ে মেরে ডান্ডা করে দিই ঠান্ডা।' ডান্ডার মডার্ন ভার্সান পিস্তল, রাইফেল। তাই আজকের 'সিংহম' ওই ঠান্ডা করার কাজটি সারেন পিস্তল দিয়ে।

কিন্তু প্রশ্ন একটাই। বারেবারে 'সিংহমের' হাত থেকে অভিযুক্তরা পালানোর চেষ্টা করে কেন? আর পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরাটা কি নির্ভেজাল নিয়তি?

২০০৮ সালের ১০ ডিসেম্বর। তখনও অন্ধ্রপ্রদেশে বিভাজন হয়নি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রসের ওয়াইএস রাজশেখর রেড্ডি। শীতের সকালে এক নৃশংস ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলো ওয়ারাঙ্গল।
কাকাটিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স- এর দুই ছাত্রী। তাদের ওপর অ্যাসিড হামলার ঘটনায় কেঁপে উঠেছিলো গোটা রাজ্য। অভিযুক্ত তিন যুবক। সবারই বয়স কুড়ির মধ্যে। মারাত্মক জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন দুই ছাত্রী। স্বপ্নিকা আর প্রণিতা। মুখ, শরীরের বেশকিছু জায়গা ভয়ঙ্কর রকমের পুড়ে গেছিলো দুজনের। জীবনযুদ্ধে সেদিন হেরে গেছিলেন স্বপ্নিকা। আর শরীরে মারাত্মকরকম জখমের চিহ্ন নিয়ে প্রাণে বেঁচে গেছিলেন প্রনিতা।
ঘটনার খবর পেয়েই ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো মানুষ। ওয়ারাঙ্গল পুলিসের ভূমিকার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে ছাত্র সংগঠনগুলি। পুলিসের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তোলে নাগরিক সমাজ। জনরোষের মুখে পড়ে যান এসপি। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিসের জালে ধরা পড়লো অভিযুক্তরা। ক্ষোভে রাশ পড়লো জনতার। তখনও আরেক বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো ওয়ারাঙ্গলের জন্য। এরপর আটচল্লিশ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই, সকালে খুশির হাওয়া বয়ে গেল শহরে। সবাই জানতে পারলেন, চরম শাস্তি পেয়ে গেছে অপরাধীরা। খতম তিন অপরাধী পুলিসের এনকাউন্টারে। সেদিনও রাতারাতি ভিলেন থেকে হিরো হয়ে গেছিলেন এসপি। কলেজছাত্রীরা তাকে সম্মান জানিয়েছিলেন শাল, পুষ্পস্তবক দিয়ে। এসপি'র নামের জয়ধ্বনিতে গমগম করে উঠেছিলো অন্ধ্রপ্রদেশের আকাশ, বাতাস।

সেই ঘটনার সঙ্গে হুবহু মিল শুক্রবার ভোরের হায়দরাবাদ এনকাউন্টারের। আর তা হবেই বা না কেন? কারণ দুই এনকাউন্টারের মূলে ছিলেন একই ব্যক্তি- বিশ্বনাথ চন্নাপ্পা সজ্জনার। ১৯৯৬ ব্যাচের আইপিএস অফিসার। ঘনিষ্ঠরা হুবলির এই মানুষটিকে চেনেন বেশ বন্ধুবৎসল বলে। মৃদুভাষী। ওয়ারাঙ্গলের মানুষ সেদিন ফুলবৃষ্টি করেছিলো সজ্জনারের মাথায়। এগারো বছর আগে, এমনই উৎসবের মেজাজে দেখা গেছিল গোটা শহরকে।

সরকারি 'সিংহম'।
বিশ্বনাথ চন্নাপা সজ্জনার।
তাঁর অবশ্য আরেকটা পরিচিতিও আছে 'এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট'। এগারো বছর আগে, ওয়ারাঙ্গলেই আরও এক পালক সংযোজন হয়েছিলো তাঁর মুকুটে- নারীপরিত্রাতা। সেই এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট, নারীপরিত্রাতা, ভিসি সজ্জনার বর্তমানে হায়দরাবাদের পুলিশ কমিশনার। শুক্রবার সকাল থেকে তিনি দেশের 'সিংহম'।
কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, অভিযুক্তদের গুলি করে মেরে, পুলিসের একজন পদস্থ অফিসার কিভাবে মহিলাদের পরিত্রাতা হলেন? জবাবদিহির দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু জবাব নেই। মুখ পুড়েছে সরকারের। 'জাস্টিস ডিলেড, জাস্টিস ডিনায়েড'। বিচারে দেরি মানেই বিচারে অস্বীকার। উন্নাওয়ের সেই অসহায় মেয়ে মারা যাওয়ার আগে, সরকার, প্রশাসন, আইন কানুনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়ে গেলো।

মানুষের নিরাপত্তার অভাববোধ আজ আকাশছোঁয়া। ভরসা রাখতে পারছে না আইনের দীর্ঘসূত্রিতায়। মানুষের আবেগের সেই চোরাগলি দিয়েই উঠে এসছেন সজ্জনার। এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট। হায়দরাবাদের ঘটনা গোড়া থেকে ভেবে দেখুন, যখন প্রিয়াঙ্কার বাবা পুলিসের দ্বারস্থ হয়েও ফিরে এসছিলেন। সে রাতেই পুলিস তৎপর হলে, প্রিয়াঙ্কার প্রাণ বাঁচানো অসম্ভব হতো না। কিন্তু বাস্তবে তখন পুলিসের ভূমিকাও ছিলো ঠুঁটো জগন্নাথের। কোনও সদিচ্ছায় নয়। জনরোষের চাপে পড়েই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছিল পুলিস।
অতীতের ঘটনাও চোখে আঙুল দিয়ে সেরকমটাই দেখায়। রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন জোরদার করতে পারেন না সজ্জনার, যাতে অপরাধীদের হৃদকম্প হয়। বরং অপরাধ হয়ে যাওয়ার পরে, নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারদর্শী সজ্জনার।

হায়দরাবাদের মতোই ওয়ারঙ্গলের ঘটনা নিয়েও বিবৃতি দিয়েছিলেন তৎকালীন এসপি সজ্জনার। কাকভোরে তিন অভিযুক্তকে নিয়ে ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল পুলিস। লক্ষ্য ঘটনার পুনর্নিমান। ঘটনাস্থলে পৌঁছতেই পুলিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিযুক্তরা। হাতে দেশি পিস্তল। তাদের মোকাবিলা করতে পুলিসও গুলি চালায়। মারা যায় তিন অভিযুক্ত। সোজাসাপটা বক্তব্য। আর তাতেই বাজিমাত।

২০১৬ সালের অগাস্ট। অন্ধ্রপ্রদেশে তখন মাওবাদী, নক্সালদের নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ সরকারের। নক্সালদের শায়েস্তা করতে সজ্জনারের নেতৃত্বে শুরু হলো 'অপারেশন গ্রেহাউন্ড'। হায়দরাবাদ শহরতলীতে পুলিসের গুলিতে প্রাণ গেল মাওবাদী নেতা নইমুদ্দিনের। অভিযোগ পালানোর চেষ্টায় সে পুলিসের ওপর হামলা করে।
সজ্জনারের প্রেস বিবৃতিতে, তিনটি এনকাউন্টারের ঘটনাতেই অদ্ভুতরকমের সাদৃশ্য।
হায়দরাবাদের অভিযুক্তরা পালাতে চেষ্টা করেছিলো। হামলা করেছিলো পুলিসের ওপর। বাধ্য হয়েই পুলিস গুলি চালায়।
নক্সাল নেতা নইমুদ্দিনও ওই একই চেষ্টা করতেই, পুলিসের গুলিতে মারা যায়।
ওয়ারাঙ্গলের অভিযুক্তরাও তাই। পুলিসের ওপর হামলা করায়, আত্মরক্ষার তাগিদেই পুলিস গুলি চালায়। মারা যায় তিন অভিযুক্ত।
এখনও মনে হচ্ছে না, একই চিত্রনাট্যের বারবার প্রদর্শন? সেই কুমিরের, বারেবারে একই ছাগলছানা দেখানোর গল্পের মতো।

ঠিক একইরকম পুলিসের ওপর সময়ে অসময়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার গল্প শোনা যেত বাংলায়। সেটা ছিল সত্তর দশকের সিদ্ধার্থ রায় জমানা। মাঠ ময়দানে পড়ে থাকতো পুলিসের গুলিতে ফুঁড়ে যাওয়া তরুন, যুবকের নিথর রক্তমাখা শরীর। গায়ে নক্সালবাদীর সীলমোহর। আজ যারা হায়দরাবাদের পুলিস এনকাউন্টারের ঘটনায় লাফাচ্ছেন, তাদের অনেকেই সম্ভবত সেযুগটার কথা কিছুই জানেন না। হায়দরাবাদের ঘটনায় যাঁরা খুশি হতে পারেননি, তার কারণ একটাই। সজ্জনারের অতীত। আর দেশের বিভিন্ন রাজ্যে পুলিস এনকাউন্টারের নারকীয় ঘটনা।

পুলিস নিজের হাতে বিচারের দায়িত্ব তুলে নিলে অবস্থাটা কী দাঁড়ায়, তা দেখা গেছিল ভাগলপুরে। সময়টা ছিল ১৯৭৯-১৯৮০। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে ওই ১৯৮০ সালেই বসেন কংগ্রেসের জগন্নাথ মিশ্র। ভাগলপুরে তখন গুন্ডারাজ। গণধর্ষিতা হয়েছিলেন পনেরোজন তরুনী। লুঠতরাজ। মাত্র দশমাসের মধ্যে, পুলিসের খাতায় দায়ের হয়েছিল কমপক্ষে উননব্বইটি খুনের অভিযোগ। সেদিনও জনতার ক্ষোভ সামাল দিতে বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলো বিহার পুলিস।
অভিযুক্তদের চরম শিক্ষা দিতে একত্রিশজন বিচারাধীন বন্দির চোখে অ্যাসিড ঢেলে অন্ধ করে দেওয়া হয় নির্মমভাবে। খুঁচিয়ে গেলে দেওয়া হয়েছিলো অভিযুক্তদের চোখ। পুলিসের সেই বর্বরতায়, সেদিনও আজকের তেলেঙ্গানার মতোই ধন্য ধন্য করেছিল রাজ্যবাসী। সবাই ভেবে বসেছিল, পুলিসের ওই নৃশংসতাই তাদের স্বস্তি এনে দেবে মাস্তানরাজ থেকে। বিহার পুলিসের বর্বরতা নিয়ে যখন সংসদ তোলপাড়, রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ভারতের 'আয়রন লেডি' তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধি। অনেক পরে ভাগলপুরের ওই ঘটনা নিয়েই বলিউডে তৈরি হয়েছিল গঙ্গাজল।

জনরোষ ঠেকাতে, কখনও রাজনৈতিক কারণে, আচমকাই অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে পুলিস। তৈরি হয় বিতর্ক। তবে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ করলে এই অতি সক্রিয়তা অনেক সময়েই এড়ানো যায়।
প্রিয়াঙ্কার বাবার অভিযোগ নিয়ে তেলেঙ্গানা পুলিস ঠিক সময়ে তৎপর হলে, প্রাণে বাঁচানো যেত তাকে। তাতে অবশ্য কোনও চমক থাকতো না। জনতাও জয়ধ্বনি দিতো না পুলিস কমিশনারের নামে। তবে গণধর্ষিতা হয়ে পুড়ে মরতে হতো না প্রিয়ঙ্কাকে। এমনটা আশা করাই যায়।
বিশ্বনাথ চন্নাপ্পা সজ্জনারকে 'সিংহম' বানাতেই বারেবারে পালানোর চেষ্টা করেনাতো, তেলেঙ্গানা পুলিসের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তরা?
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours