আহসান হাবিব লেখক বাংলাদেশ:

মনোবিদরা বলেন হতাশা বা ডিপ্রেশন হচ্ছে সর্দি কাশির মত আসে যায়। কিন্তু কোন কোন হতাশা মানসিক অসুখ হয়ে দাঁড়ায়। তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়।
মাসখানেক আগে আমার বন্ধুর ফোন ‘আমি মাস সাতেক আগে পরপর তিনদিন ঘুমাতে না পেরে পাগল হয়ে উঠেছিলাম, শেষে বাসার পাশেই আমার এক পরিচিত ওষুধের দোকানে গিয়ে সমস্যার কথা বলি । তিনি আমাকে সম্ভবত একটা ঘুমের ওষুধ দেন, আমি রাতে এসে খাই, তারপর ঘুমিয়ে পড়ি । আমার চমৎকার ঘুম হয় এবং সকালে অসাধারণ ভাল বোধ করি । পরপর তিনদিন খাই এবং আমার ঘুম হয়, আমি ভাল বোধ করতে থাকি । পরের দিন না খেয়ে ঘুমাতে যাই, দেখি সেই একই অবস্থা, একফোঁটা ঘুম না হয়ে সকাল হয়ে গেল ।আমার আবার খুব খারাপ লাগতে লাগলো । আমি আবার সেই ওষুধের দোকানে গেলাম, আমার সমস্যার কথা বললাম, এবার তিনি আমাকে দশটি অন্য একটি বড়ি দিয়ে বললেন প্রতিদিন একটা করে খেয়ে যেতে । আমি কোন প্রশ্ন না তুলে খেয়ে যেতে থাকলাম এবং আমার ঘুমও হতে থাকলো । সাত মাস হয়ে গেল, আমি ওই বড়ি ছাড়া ঘুমাতে পারছি না, মধ্যিখানে না খেয়ে চেষ্টা করেছিলাম, ঘুম হয়নি, কি করবো’?
আমি দুঃখ প্রকাশ করলাম প্রথমে তারপর বললাম ‘তুমি ওষুধের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছ । ঘুমের ওষুধগুলির এটাই একটা বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া । একসময় নেশা হয়ে পড়ে, তখন আর ছাড়া যায় না’ । আমি সেই তিনদিনের কথা জিজ্ঞেস করলাম, সে বলল ‘জানি না, ঠিক কি হয়েছিল, হয়তো কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলাম’। আমি তাকে আশ্বস্ত করি, বলি ‘এমন হয়, আবার ঠিক হয়ে যাবে’
‘কিভাবে’?
বললাম ‘নিজের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে । কেউ যখন নিজের কাজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখন সে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে । একটা দুশ্চিন্তা মাথায় এসে ভর করে, তখন আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলি চঞ্চল হয়ে ওঠে, স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে । ঘুমের জন্য যে হরমোন নিঃসরণের কথা সেটা কমে যায় ।আর অন্যদিকে দুশ্চিন্তাকে বাড়িয়ে তুলবে এমন হরমোন বেশি করে নিঃসরণ হতে থাকে এবং এটা অনেক কিছুর উপর প্রভাব ফেলে, সব থেকে বেশি ফেলে ঘুমের উপর’
‘তাহলে এখন উপায় ? আমি এই ওষুধ ছাড়াই ঘুমাতে চাই, সম্ভব?’
বললাম ‘খুব সম্ভব’
‘কিভাবে’?
আমি তার কাজের কোন ফিরিস্তি চাইলাম না, তার সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং পারিবারিক কোন অবস্থার কথাই জানতে চাইলাম না । কেননা আমি জানি এইসবই একজন মানুষকে হতাশায় ফেলে দিতে সব সময় কাজ করে চলেছে । বন্ধুটির মানসিক অবস্থার কথা আমি জানি, একজন বুদ্ধীদীপ্ত, জানাশোনা, রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর চিন্তার একজন দৃঢ় চিত্তের মানুষ । হয়তো এর মধ্য এমন কিছু ঘটেছে যা তার আস্থাকে নড়িয়ে দিয়েছে । তাই আমি শুধু সেই সহজ কথাগুলি বললাম- ‘নিজের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনো । তুমি ঠিক যা, তাই কর, অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজের যা ভাল লাগে তাই কর । অন্যের উপদেশ কিংবা অন্যকে খুশি করার জন্য নিজের অনিচ্ছায় কিছু করোনা । অন্যের অভিজ্ঞতা তোমার অভিজ্ঞতা নয়, তুমি নিজেই নিজের পথ নির্মাণ কর তা যাই হোক না কেন । নিজের যে স্বপ্ন তার পেছনে সমস্ত শ্রম এবং বুদ্ধি বিনিয়োগ কর । আর ওষুধ খাওয়া একটু একটু করে কমিয়ে একসময় ছেড়ে দাও । যদি কয়েকদিন ঘুম না হয়, চিন্তা করোনা, তোমার মানসিক দৃঢ়তা ঠিক জয় করে ফেলবে নির্ঘুমতাকে’
সবশেষে বললাম 'নিজের আপন হয়ে ওঠো'
বন্ধু আমার কথা শুনল, প্রায় কিছু বলল না, শুধু বলল ‘ঠিক আছে।’
গতকাল তার ফোন এলো, ‘শুভ সকাল’ জানিয়েই বলল ‘আজ চমৎকার এক ঘুম থেকে জেগে উঠে তোমাকে কল করলাম, আজ কয়েকদিন কোন ওষুধ খাচ্ছি না কিন্তু ঘুম ঠিক মতই হচ্ছে’
দেখলাম বন্ধুর কণ্ঠে দারুণ আনন্দ এবং দৃপ্ত ভঙ্গিমা ফুটে উঠেছে, যা আমি চেয়েছিলাম । আমি তাকে শুভকামনা জানালাম আর মনে মনে ভাবলাম হয়তো কয়েক বছর পর এমনি এক সকালে পত্রিকা খুলে তার অসাধারণ সাফল্যের কাহিনী শুনবো । কেননা এমন কাহিনী আমাদের দেশে প্রায় শুনতে পাই। মানসিক শক্তির উত্থান এবং নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে যদি কেউ দৃঢ়তা দেখাতে পারে, এটি সম্ভব।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours