কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

'সান্টা ক্লজ' এখন পথেঘাটে।
সাদা দাড়ি, লাল পোশাকের আড়ালে এক খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষ। বণিকের হুকুমে মুখে রংচং মাখা। ফুটপাথে নেমে উৎসবমত্ত মানুষের মনোরঞ্জন করা। সবশেষে মানুষকে টেনে দোকানে বা মলে ঢোকানো। কায়দাটা চুরি করা। আর উদ্দেশ্যেও দুস্তর ফারাক।
আমেরিকার 'স্যেলভেশন আর্মি'র সদস্যরাও ওরকম সান্টা ক্লজ সেজে নিউইয়র্কের রাস্তায় নামতো। মানুষের থেকে টাকা নিতো। সেই টাকা দিয়ে বড়দিন উপলক্ষে গরীব মানুষদের মাগনায় ক্রিস্টমাস মিল খাওয়াতো, 'স্যেলভেশন আর্মি' নামের প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান চার্চ আর আন্তর্জাতিক ওই দাতব্য সংস্থা। মোটামুটি ভাবে, 1890 পর্যন্ত ওই দস্তুর ছিল। তবে আজও সেই প্রথা টিকে আছে। আমেরিকার অনেক রাস্তার ধারেই আজও দেখা মেলে সান্টাদের। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে তারা ঘণ্টা বাজায়। ঘোষনা করে প্রভু যিশুর আগমণ বার্তা।

সিন্ট নিকোলাস। এই ডাচনাম হয়ে দাঁড়ালো সিন্টার ক্লাস। শেষ পর্যন্ত পরিচিত হলেন সান্টা ক্লজ নামে। তৃতীয় শতাব্দির কোনও এক সময়ের কথা। ইতিহাসবিদদের মত, 280 সালে জন্ম আমাদের 'মানুষ' সান্টার। মাতৃভূমি টার্কির পাটরা। বেশ কম বয়সেই হারান মা বাবাকে। তারপর নেহাত উত্তরাধিকারী সূত্রেই, এক বিশাল সম্পদের মালিক হন তিনি। কিন্তু মনটা ছিলো আমাদের পরিচিত সান্টার মতোই দরাজ। দুহাতে মানুষের সেবায় ধন বিলোতেন তিনি। অনেকটা গৌরী সেনের মতো। আবার দাতাকর্ণও বলা চলে। এমন মানুষ যে ধর্মপ্রাণ হবে তা স্বাভাবিক। পরে তিনি বিশপের দায়িত্ব নেন। তবে দানধ্যানের জন্য সেন্ট নিকোলাসকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল নানা গল্প। যা মানুষের মুখে মুখে ফিরতো।

এক গরীব পরিবার। দুবেলা তিন মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিতে পারতেন না অসহায় পিতা। পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে তিনি ঠিক করলেন, মেয়েদের বেচে দেবেন। দাসী বা দেহোপজীবিনী হয়েই তারা বেঁচেবর্তে থাকবে। একথা নিকোলাসের কানে যেতেই নড়েচড়ে বসলেন তিনি। রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি সেই বাড়িতে রেখে এলেন তিন থলেভর্তি সোনা। রক্ষা পেল সেই পরিবার। প্রবাদের মতো এই কাহিনীর কিছু ফারাক হয়েছে লোকের মুখে মুখে।
তবে বাজারি সভ্যতার হাতে পড়ে উবে গেছে দরাজ দিলের সান্টা ক্লজরূপী সেন্ট নিকোলাসের সেই ছবি। তবে তাঁর সেই ভাবমূর্তি ভাঙিয়ে উপহার কেনাবেচা করে, মুনাফা লোটার কাজটা দিব্য চলছে।

ছোটরা কিন্তু তাদের সান্টা ক্লজকে মনে রাখলো এক মজার মানুষ হিসেবে। বরফসাদা চুলদাড়ি। সাদা ফারের ইয়া চওড়া লাইনিং দেওয়া লাল টকটকে কোট, নাইটক্যাপ। কোমড়ে বেশ গাবদা বাকলওয়ালা কালো বেল্ট। পিঠে খেলনা, চকলেট, লজেন্সভর্তি অতিকায় এক ঝোলা। বড়দিনের আগের রাতে অথবা কাকভোরে আট বল্গাহরিণের টানা স্লেজগাড়িতে সওয়ার সান্টা চুপিচুপি হানা দেয় লোকের বাড়িতে। বাড়িতে ঢোকার পথটাও বিচিত্র। রান্নাঘরের চিমনি গলে ঢুকে পড়ে সে। মোজায় ভরে কচিকাচাদের জন্য রেখে যায় নানা উপহার। ঠিক যেমন করে সুদূর অতীতে, ওই তিনবোনের জন্য রেখে গেছিলেন তিন থলে সোনা। বাচ্চারা সোনার বদলে টফি, লজেন্স, খেলনা নিয়েই খুশি। খালি হাতে সান্টাকে ফেরায় না কচিকাচার দল। সান্টার জন্য তারা রেখে দিতো তাদের প্রিয় কুকিজ, দুধ। আর সান্টার বল্গাহরিণের জন্য গাজর।

কিন্তু বাচ্চাদের পছন্দসই, সান্টার এরকম নাদুস নুদুস চেহারাটা তুলে ধরলো কে?
জন পিন্টার্ড। নিউইয়র্ক হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির এক সদস্য। তিনি সোসাইটির বার্ষিক সভায় সবার হাতে এক উডকাট তুলে দিয়েছিলেন। ওই উডকাটে যে সান্টাকে দেখা গেছিল তা অনেকটাই আজকের  সান্টা ক্লজের মতো। প্রেক্ষাপটেও সান্টা, তার হাতে মোজাভর্তি খেলনা। ফায়ারপ্লেসের ওপর ঝুলছে ফলের ঝুড়ি। তবে আজ যেই সান্টাকে দেখি তার অবিকল ছবি আঁকা হয়েছিল আরও কিছুদিন পরে।

সাল 1822। ক্লিমেন্ট ক্লার্ক মুর নামের এক ভদ্রলোক তাঁর তিন মেয়ের জন্য লিখে ফেললেন এক ক্রিসমাস কবিতা। পরে সেই কবিতা বিখ্যাত হলো 'ইট ওয়াজ দ্য নাইট বিফোর ক্রিস্টমাস' নামে। সেই কবির কল্পনায় রাশভারি সেন্ট নিকোলাস, মজার মানুষ সান্টা হয়ে দেখা দিলেন। প্রায় ষাট বছর পর 1881 সালে সেই কবিতার জন্য ছবি আঁকলেন নামকরা কার্টুনিস্ট থমাস নাস্ট। তখনকার এক জনপ্রিয় সাপ্তাহিক 'হার্পারস উইকলি'তে ছাপা হলো সান্টা ক্লসের নতুন চেহারার ছবি। দেখা গেল আজকের সান্টা ক্লসের অবিকল রূপ, সাজসজ্জা।

কিন্তু প্রশ্ন অন্যখানে, তাঁর ওই মোটা ভুঁড়িওয়ালা চেহারাটা দেখে কি রেগে যেতেন না সেন্ট নিকোলাস? কারণ আদপেই তিনি ওরকম ছিলেন না। ছিলেন বেশ গম্ভীর স্বভাবের রাগী মানুষ। অন্তত এরকমটাই বলেন, সেন্ট নিকোলাসকে নিয়ে চর্চা করা জ্ঞানীগুণীজনরা। আবার চার্চের নিয়মনিষ্ঠা পালনে রীতিমতো কঠোর। তবে মানুষের বিপদে পড়ার কথা শুনলে, স্থির থাকতে পারতেন না। ঝাঁপিয়ে পড়তেন বিপদগ্রস্ত মানুষটাকে মদতের জন্য। তা সে সাধারণ কেউ হোক অথবা বণিক, নাবিক যে কেউ। অপরাধীদেরও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখাটাই ছিলো তাঁর অভ্যাস।

তবে বাচ্চাদের ত্রাতা হিসেবে সেন্ট নিকোলাসের খ্যাতি হয় অন্য এক ঘটনার দৌলতে। এক সরাইখানার ইনমালিক তার তিন বাচ্চাকর্মীকে খুন করে। তারপর তাদের লুকিয়ে রাখে পিপেতে। সেন্ট নিকোলাস রেগে আগুন হয়ে যান নৃশংস এই ঘটনায়। ছুটে যান সেই সরাইখানায়। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার বলে প্রাণ ফিরিয়ে দেন সেই তিন বাচ্চার স্পন্দনহীন শরীরে।

343 সালের 6 ডিসেম্বর মারা যান সেন্ট নিকোলাস।
তবে আমেরিকার নাগরিক সমাজে তিনি জনপ্রিয় হন অষ্টাদশ শতাব্দির শেষের দিকে। বড়দিনে বাচ্চাদের উপহার দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দির গোড়া থেকেই। 1840 নাগাদ অনেক পেপারেই ক্রিসমাস উপলক্ষে দোকানিরা কেনাকাটার বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করলো। সেই বিজ্ঞাপনে ছবি ছাপা হতো  সান্টা ক্লসের। ফিলাডেলফিয়ার দোকানে বাচ্চারা ভিড় করতো মানুষের মতো বড়োসড়ো সান্টার মডেল দেখতে। আজ আর মডেল না। ভারতের শহরেও সেই 'স্যেলভেশন আর্মি'র ধাঁচেই মল, বাজারে দেখা মেলে জীবন্ত সান্টা ক্লজের। কোথাও সেই সান্টারে মা বাবার হাত ধরে চলা কচিকাচাদের হাতে গুঁজে দেয় লজেন্স। তবে সেটা টোপ। আরও লোভনীয় সব উপহার পেতে গেলে ঢুকে পড়ো দোকান অথবা মলে। তারপর 'ফেলো কড়ি মাখো তেল'।

সান্টা ক্লজ সেজেই কিছু মানুষের রুজি রোজগার বছরের শেষমাস ডিসেম্বরে। লালটুপি ফিরি করে বেড়ায় আরও কিছু মানুষ। এদের বাড়িতেও যদি চুপিচাপি কিছু উপহার রেখে দিয়ে আসতো আমাদের সান্টা ক্লজ!এরইমধ্যে যদি কোনও সান্টা ক্লজ বলে উঠতো- 'সব কা সাথ, সব কা বিকাশ'!
তাহলে কিন্তু বেশ হতো।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours