কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

কোথায় গেলেন সোশ্যাল মেডিয়ার জেহাদিরা?
তাঁরা এখন ভীষন ব্যস্ত এক নয়া ইস্যুতে। নাগরিক বিল নিয়ে উবে গেছে সবার রাতের ঘুম। উত্তেজনার পারা চড়ছে চড়চড় করে। সোশ্যাল মেডিয়ার পাতা রণক্ষেত্র। রামকানাই থেকে রহমত্তুলা, সবাই উজার করে দিচ্ছেন জ্ঞানভান্ডার। খুলে যাচ্ছে নাগরিক বিল সমর্থন, বিরোধিতার কতশত দিক। তবে শর্ত সবারই এক, তাঁর কথার ওপর কিছু বলা যাবে না। তিনি শেষকথাটি বলে দিয়েছেন।

এই নাগরিক বিলের স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞরা, দেশের আইন কানুনকে যে কতটা তুচ্ছ মনে করেন তা আগেই দেখা গেছে। আদালতেরও ওপর দিয়ে চলেন তাঁরা। কেন? আদালত চরমদণ্ডের ছাড়পত্র দেওয়ার আগে, দোষীকে দয়াভিক্ষার শেষ সুযোগ দেয়। ঠিক যেমনটা দেওয়া হলো নির্ভয়া মামলায় দোষী ধর্ষকদের। সোশ্যাল মেডিয়ার বিচারকরা সে সুযোগ দিতে রাজি না। আবেগের ঝড় তুলে জনমত গড়ে, তাঁদের রায় চাপিয়ে দেওয়ার জন্য অবিরত চাপ তৈরি করতে থাকে তাঁরা। বিরোধিতা করলেই খিস্তিখাস্তা। এমনকি তাতে সাধারণ মানুষ তো কোন ছাড়, নেতা মন্ত্রীদেরও তোয়াক্কা করা হয় না।
প্রশ্ন এখানেই।
বাহান্ন বছরের প্রবীণ, বিজেপি খেদানো ধর্ষক বিধায়ক নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটলেন কেন এই প্রতিবাদীরা? যেখানে খোদ সিবিআই ধর্ষক প্রাক্তন বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছে, সেখানে জেহাদিরা একটাও পোস্ট করছে না। উল্টে আদালতের কাছে সিবিআইয়ের আবেদন জানাতে হচ্ছে, এক নির্বাচিত জন প্রতিনিধির এই জঘন্য অপরাধে কঠোরতম শাস্তি নাহলে, সমাজের কাছে ভুল সঙ্কেত পৌঁছবে। মুশকিল হবে এ ধরনের পাশবিক কাণ্ডে রাশ টানার।

ধরে নেওয়া যাক, পাবলিক এতদিনের অভিজ্ঞতায় জেনে ফেলেছে, হাই প্রোফাইল মানুষরা যাই অপরাধ করুক না কেন এদেশে শাস্তি হয় না। সম্পদ, প্রভাবের জোরে তাঁরা সহজেই আইনের চোখে ধুলো দেন। ঘটনা যে সর্বৈব মিথ্যা, এমনটাও নয়। ধর্ষক সেঙ্গারও একজন সেরকমই রাজনৈতিক প্রভাবশালী মানুষ। তাই কি চরম হতাশায় উন্নাওয়ের মৃত নাবালিকা ধর্ষিতার হয়ে আওয়াজ তোলার প্রয়োজন নেই, এমনটা মনে করলেন সোশ্যাল মেডিয়ার প্রতিবাদীরা? নিষ্ফলা শক্তিক্ষয় থেকে আপাতত বিরত রইলেন তাঁরা?
তাই বা কী করে হয়?
সবার আশা ছিল, দিল্লিতে যে বর্বরতার শিকার হতে হয়েছিল নির্ভয়াকে, বারো বছর পরের এক ডিসেম্বরেই ফাঁসিতে ঝুলতে চলেছে তাঁর ধর্ষকরা। আপাতত তাও ঝুলে রইলো। জেহাদিরা তেলেঙ্গানাকাণ্ডে প্রায় রাতারাতি ধর্ষকদের ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবিতে দেশ তোলপাড় করেছিলো। বারো বছর পরেও নির্ভয়াকাণ্ডের ধর্ষকদের দয়াভিক্ষার সুযোগ দেওয়া নিয়ে তাঁদের অবস্থান এতো হিমশীতল কেন?
তবে মুখর হয়েছিলেন নির্ভয়ার মা।
"সবার অধিকার আছে। আমাদের অধিকারের কী হবে?" আদালতের কাছে সরাসরি জানতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁকে আশ্বস্ত করে জাজ বলেন, "আপনাদের জন্য আমি আছি।"
আপাতত  ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ফাঁসির দণ্ডবিধান স্থগিত। ওইদিন ফের শুনানি হবে অতিরিক্ত সেশন জাজ সতীশ কুমারের আদালতে। নির্ভয়ার অপরাধীরা তো সাধারণ মানুষ। ওই তেলেঙ্গানার অপরাধীদের সঙ্গে বিশেষ ফারাক নেই তাদের। তাহলে ভোজবাজির মতো কোথায় উবে গেলেন সোশ্যাল মিডিয়ার বিশেষত সেই তেজি প্রতিবাদী মহিলারা?

ওদিকে ঝুলে থাকলো উন্নাও মামলা। ইতিমধ্যেই পসকো আইনে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে সেঙ্গার। কাল ফের সিবিআইয়ের আর্জি শুনবে বিশেষ আদালত। প্রাক্তন বিধায়কের আইনজীবী এখন চেষ্টা চালাচ্ছেন সেঙ্গারকে গরিবগুরবো সাজাতে। আইনজীবী আদালতকে জানিয়েছেন, উন্নাও ধর্ষিতার পরিবারকে কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর মক্কেলের নেই। সেই সঙ্গে আবেদন জানানো হয়েছে, প্রাক্তন বিধায়কের সামাজিক ও উন্নয়নের কাজগুলি মনে রেখে যেন দণ্ডবিধান করা হয়।  এদিকে দেখতে দেখতে আড়াই বছর পেরলো নিজের বাড়িতেই গণধর্ষিতা, মৃতা নাবালিকা উন্নাওকন্যার।

না, টুঁ শব্দটিও করেনি কেউ। ফেসবুকের পাতায় নির্ভয়া বা উন্নাওকন্যাকে নিয়ে কোনও পোস্ট চোখে পড়েনি। কেন? আসলে আজকে হাতে চলে এসেছে আর এক ইস্যু। নাগরিক আইন। গোটা দেশ জ্বলছে। ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে সেই আগুনের আঁচ নিতে ব্যস্ত সবাই। নির্ভয়া, উন্নাওকন্যার হিমশীতল শরীর সেখানে পাত্তা পায় না।
গত ৬ ডিসেম্বর তেলেঙ্গানা এনকাউন্টারের মধ্যেও এই উত্তেজনা লুকিয়ে ছিল। সেদিনও সেই উত্তেজনার আগুনে পুড়েছিলো সোশ্যাল মিডিয়াপ্রেমীরা। এক তাৎক্ষণিক আবেগ ছাড়া সেই ঘটনাতেও কোনও সারবত্তা ছিল না। শুধুই কি এক অন্তঃস্বারশূন্য প্রতিবাদের ছবি দেখেছিল দেশ?


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours