কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:


হায়দরাবাদে সেভাবে রাজনীতির ছক্কা পাঞ্জা খেলার সুযোগ পাননি রাজনীতির মতলববাজরা। খেলা শুরু হতে না হতেই শেষ। ধর্ষণ খুন অভিযুক্তদের নিকেশ গোটাটাই হয়ে গেছিলো দুরন্ত গতিতে।
ওদিকে প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে যখন হুলুস্থুল, তখন উন্নাওকন্যা হাসপাতালে জীবনযুদ্ধ চালাচ্ছিলো দাঁতে দাঁত চেপে। বারেবারে উঠেছে সে প্রসঙ্গও। তাই মানসিক ভাবে আগে থেকেই তৈরি ছিলেন রাজনীতির খেলুড়েরা। মাত্র দশ দিনের ফারাকে মৃত্যু আরেক গণধর্ষিতার। প্রতিবাদীকন্যার গলা স্তব্ধ। এবার মুখর হলেন গণতন্ত্রের মাস্টারমাইন্ডরা। একেবারে ফর্মুলায় ফেলা বারবার দেখা নাটক।
তড়িঘড়ি সব ছুটলেন উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে। শাসক, বিরোধী সবাই। মওকা চলে এলো হাতের মুঠোয়।

দিল্লি থেকে ছুটে এসছিলেন প্রিয়াঙ্কা গাঁধিও। 'রানুর প্রথম ভাগ'- এর মতোই আগেভাগে বিধানসভার বাইরে ধর্নায় বসে গেছিলেন অখিলেশ যাদব। রুটিন মাফিক এঁরা সবাই তোপ দাগলেন যোগিরাজ, পদ্ম শিবিরের দিকে। যোগিরাজকে 'জঙ্গল রাজ' বলে মন্তব্য করে বসলেন বহেনজি মায়াবতী। পাল্টা বিবৃতি দিতে পিছিয়ে থাকলো না যোগীবাহিনী। সব 'এক সে বড়কে এক' জনদরদী নেতানেত্রী।

কথায় বলে, চোরের মায়ের গলা বড়ো।
ধর্ষকদের বিরুদ্ধে যে দল যতোই গলা ফাটাক না কেন, ঝুলি খুলতেই বেড়িয়ে পড়ে বেড়াল। আর ঝুলি খোলার এই কাজটাই সেরে রেখেছিলো অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস। সংস্থার রীতিমতো চমকে দেওয়া পরিসংখ্যানে, আজ এ মুহূর্তেও আটচল্লিশজন এমন নির্বাচিত জন প্রতিনিধির আছেন, যাঁরা কোন না কোনও মহিলা সংক্রান্ত মামলায় জড়িয়ে। এঁদের মধ্যে আবার তিনজন সাংসদ। বাদবাকী পঁয়তাল্লিশজন বিধায়ক। এই কলঙ্কিত সাংসদ, বিধায়কদের হাতের শোভা বাড়াচ্ছে গণতন্ত্রের রাজদন্ড। সেই সঙ্গে সুনিশ্চিত করছে এঁদের নিরাপত্তাও।
রক্ষকের দলেই ভিড়ে গেছেন ভক্ষকরা। দলের জার্সি গায়ে নায়ক হয়ে গেছেন খলনায়েক। ধরা পড়ে গেছে সংবিধাধের নামে শপথ নিয়ে তাঁদের লোকঠকানো, ক্ষমতা ভোগদখলের কাহিনী। এরপর যদি মানুষ দেশের সরকারের ওপরে খেপে ওঠে, তাহলে কি তাদের দোষ দেওয়া যায়? সামাজিক নিরাপত্তার দাবিতে 'খুন কা বদলা খুন'-এর দাবিতে উত্তাল গোটা দেশ। এই জেহাদিদের সিংহভাগই মহিলা। কারণ এই জঙ্গল রাজের পাশবিকতার মূল শিকার হচ্ছেন মহিলারাই। আপাতত তাঁরা যে তালিবানি বিচারব্যবস্থা চাইছেন, তা সাংবিধানিক নয়। তবে সংবিধানের ওপর মানুষের ভরসা অটুট রাখার কাজটাও করতে পারেননি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। সেই প্রতারণার ফলতো ভুগতে হবেই। গণতান্ত্রিক বিচারব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে তালিবানি বিচারব্যবস্থায় ভরসার সন্ধান করছেন দেশবাসী, বিশেষত ভুক্তভোগীরা।

ধর্ষণের ঘটনাস্থল ছিলো উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলি। সেই রায়বরেলি, যেখানকার সাংসদ এক হাই প্রোফাইল মহিলা। সনিয়া গাঁধি। উন্নাওকন্যাকে এই রায়বরেলিতে তুলে এনেই দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছিলো তার প্রেমিক শিবম ত্রিবেদি। ডেকে আনে বন্ধু শুভম ত্রিবেদিকেও। ধর্ষিতার মুখ বন্ধ করতে ধর্ষণের ছবি ধরে রাখা হতো ভিডিওতে। এরপর সব সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গণধর্ষণ। লালগঞ্জ থানায় দুই ধর্ষকের কথা জানায়। পুলিস অভিযোগ নেয়নি। লাভ হয়নি এসপিকে চিঠিতে আর্জি জানিয়েও।
তবু হাল ছাড়েনি সেই মেয়ে। শেষ পর্যন্ত শরণাপন্ন হয় আদালতের। আদালতের আদেশে লালগঞ্জ পুলিস বাধ্য হয় অভিযোগ দায়ের করতে।
রায়বরেলি আদালত আদেশ দেয় দুই অভিযুক্ত ধর্ষকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে। নড়েচড়ে বসে পুলিস। আদালতে আত্মসমর্পণ করে শিবম। কিন্তু একমাসের কিছু পরেই জামিনে খালাস হয়ে যায়।

ক্রমেই পরিণতির দিকে এগোতে থাকে ঘটনা।
৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ । মামলার শুনানিতে হাজির হতে সকাল সাড়ে চারটার ট্রেন ধরে রওনা দেয় উন্নাওকন্যা। ধর্ষকদের 'জানে মেরে দেওয়ার' হুমকিতে ডরায়নি সে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। রাস্তার মধ্যেই হামলার মুখে পড়লো সেই অসম্ভব একরোখা মেয়ে। প্রথমে ছুরির হামলা। তারপর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া। সেই জ্বলন্ত অবস্থাতেই পুলিসকে ফোন করলো অসম্ভব জেদি সেই মেয়ে। আদালতের বদলে উন্নাওকন্যা পৌঁছে গেলো জেলা হাসপাতালে। অগ্নিদগ্ধ অবস্থাতেই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দিতে জানালো, আরও তিন শাগরেদকে জুটিয়ে এনেছিলো শিবম শুভম।
পুলিসে অভিযোগ দায়ের করলো নির্যাতিতার ভাই। বিপদের আঁচ পেয়ে এবার তৎপর হলো পুলিস প্রশাসন। বিকেলের মধ্যেই পাকড়াও করে অভিযুক্তদের। ওদিকে শরীরের অবস্থা বেগতিক দেখে উন্নাওকন্যাকে পাঠানো হয় লখনউ সিভিল হাসপাতালে। কিন্তু কোনও ঝুঁকি না নিয়ে, সেদিন সন্ধ্যাতেই তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে।

খাতাকলমে গণধর্ষণের এই ঘটনা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর।
ঘটনার শেষ হলো ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর।
সেদিন দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে পোড়া শরীরের যন্ত্রণায় ছটফট করছে উন্নাওকন্যা। তারমধ্যেই যেন খানিকটা আশার আলো দেখালো আদালত। চোদ্দদিনের জেল হেফাজতে পাঠালো অভিযুক্তদের। কিন্তু হয়ত নিয়তির পরিহাস, চোখের আলো নিভে গেলো প্রতিবাদীর।
সেরাতেই দীর্ঘ চল্লিশ ঘণ্টার লড়াই শেষ করলেন বাহাদুর উন্নাওকন্যা। জ্বালা জুড়লো বিভৎস ভাবে তাঁর পুড়ে যাওয়া শরীরের। আর তাঁর মনের আঁচ ছড়িয়ে পড়লো গোটা দেশ জুড়ে। জ্বলে উঠলেন মহিলারা। আর শীতের রাতের সেই আগুনে, হাত সেঁকতে হাজির হলেন রাজনীতির বাস্তুঘুঘুরা।

অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু রায়বরেলি। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধিকে এই রায়বরেলিই পাঠিয়েছিলো সংসদে। প্রয়াত ফিরোজ গাঁধির রায়বরেলি। এমনকি বর্তমানে সনিয়া গাঁধিও এই লোকসভার সাংসদ। ওই আসনে ইতিমধ্যেই তিনি হ্যাটট্রিক করে ফেলেছেন। সেই রায়বরেলিতেই ঘরবন্দি রাখা হয়েছিলো উন্নাওকন্যাকে। করা হয়েছিলো গণধর্ষণ। উন্নাওকন্যার গত একবছরের লড়াইতে কোথায় ছিলো কংগ্রেস? ঘটনার ক্লাইমেক্সে এসে হাজির হলেন প্রিয়াঙ্কা। তোপ দাগলেন, মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ যোগী সরকার। উন্নাওকন্যার প্রায় এক বছরের লড়াইতে, কেন তাঁর পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি কোনও রাজনৈতিক হেভিওয়েটদের?

গোটাটাই বাস্তবে বিশ্বাসভঙ্গের কাহিনী।
প্রেমিক শিবমকে বিশ্বাস করেই গণধর্ষিতা হয়েছিলো উন্নাওকন্যা।
প্রতিবাদী মাত্র তেইশ বছরের মেয়েটি শেষ পর্যন্ত ভরসা রেখেছিলো দেশের সংবিধানসম্মত আইন কানুনে। সেখানেও বিশ্বাসভঙ্গ পুলিসের নিষ্কৃয়তায়। তাঁর মৃত্যুর পর রাজনীতির হেভিওয়েটরা যে দরদ, তৎপরতা দেখালেন, তার এক ভগ্নাংশ তৎপরতাও যদি আগে দেখাতেন,  ঘটনার মোড় অন্যদিকে গড়াতো। তাঁদের ভূমিকাও মোটেই বিশ্বাসযোগ্য ছিলো না। 
উন্নাওকন্যাকে জীবিত রাখতে কে কতটা আগ্রহ দেখাতেন, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। তবে অন্তত খানিকটা শান্তিতে মরতে পারতেন প্রতিবাদী।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours