গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

আবার নতুন করে NRC নিয়ে গভীর বিশ্লষণ শুরু হয়ে গেছে, পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক উপ নির্বাচনের ফলাফলে এই NRC প্রসঙ্গটিই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বা বলা ভাল, এই রাজ্যে বিজেপির মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে! মুখে না বললেও পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির নেতৃত্ব হয়তো মনে মনে আফসোস করছেন এখন! অনুপ্রবেশের সমস্যা বা উদ্বাস্তু সমস্যা সবথেকে বেশি যদি কোথাও থেকে থাকে, মনে হয় সেটা এই রাজ্যেই, অসমের থেকেও বেশী!  এই কারণেই বেশি যে অসমের অধিবাসীরা দীর্ঘ দিন ধরে এই অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছিল, যদিও এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে এই মুহূর্তে অসমের ভূমিপুত্রদের মনোভাব NRC নিয়ে ঠিক একই যায়গায় দাড়িয়ে আছে কিনা!  কারণ NRC প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে সেখানে! পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিটা আবার সম্পূর্ণ আলাদা, এখানে সবাই জানে প্রতিদিন অনুপ্রবেশ হয়! প্রথমে উদ্বাস্তু হয়ে যেখানে সেখানে অস্থায়ী ভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে বসবাস তারপর জবরদখলকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ, এরপর স্থানীয় রাজনৈতিক দাদাদের সাহায্য, জাল-নথিপত্র তৈরী করে  ঘুরপথে ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব আদায় করে নেওয়া!  সবাই সব জানে, চোখের সামনে ঘটে যেতে দেখেছে এইসব ঘটনা, তবুও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ বিশেষ আপত্তি জানায়নি কখনও! 
ভাবটা অনেকটা এরকম "আমাদের কি এসে যায়"!  সত্যিই কি আমাদের কিছুই এসে যায় না!  এই অনুপ্রবেশের জন্য দ্রুত গতিতে বাড়িতে থাকা জনসংখ্যার চাপ কি কোনো রকম আঘাত করে না অর্থনীতিকে !!  পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক দুরবস্থার সঙ্গে কি এই অনুপ্রবেশের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই !  আজ হয়তো বোঝা সম্ভব হচ্ছে না কিন্তু একদিন ঠিক বোঝা যাবেই!  ধরুন আপনার বাড়ীতে আপনার পরিবারের মানুষের সঙ্গে হঠাৎ করে বাড়তি কিছু আশ্রিত মানুষ থাকতে শুরু করে, তারপর সেই আশ্রিত মানুষরা আবার তাদের আত্মীয়স্বজনদের এনে আপনারাই ছাঁদের তলায় বসবাস করতে শুরু করেন, আপনি কতদিন তাদের খাওয়াতে পরাতে পারবেন, হয়তো কিছুদিন, কিছু মাস কিন্তু আজীবন পারবেন বলে মনে হয় না! আর খেতে দিলে শুতেও দিতে হয়! কোথায় করবেন তাদের শোওয়ার ব্যবস্থা ! ঘরতো আপনার একটাই!  এর সঙ্গে যদি যোগ হয় আর্থিক সঙ্গতির ব্যাপারটা, সেটা যদি আদৌ ভালো না হয়,  তাহলে তো একমাসও পারবেন না সেই আশ্রিতদের আশ্রয় দিতে! সে যতই আপনি হৃদয়বান, দয়ালু হোন না কেন!  হয়তো ওই অনাহূত অতিথিরা আপনার শক্তি বাড়াবে! পাশের বাড়ির সঙ্গে মারামারি হলে আপনার জয় সুনিশ্চিত করবে!  কিন্তু দিনের শেষে আপনার ভাতের থালায় ভাগ বসাবে! ধীরে ধীরে আপনার ঘরে অধিকার বসাবে তখন কি হবে! হচ্ছেও তাই!  বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর জেলাগুলোর অবস্থা দেখুন, কতো মানুষ বাংলাদেশ থেকে এসে ওইসব অঞ্চলে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অনুপ্রবেশকারী বা উদ্বাস্তুরা অনেক যন্ত্রণা নিয়েই নিজের বাসভূমি ছেড়ে আসে বা আসতে বাধ্য হয়!  কিন্তু কেন এই বিষয়ে চর্চা হচ্ছে না!  কি কি কারণে, কোন কোন সম্প্রদায়ের মানুষ দলে দলে বাংলাদেশ ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন যায়গায়, বিশেষত এই পশ্চিমবঙ্গে!  হ্যাঁ আলোচনাটা যদি শুধু পশ্চিমবঙ্গেই সীমিত রাখি,  তাহলে কি দেখতে পাই! দেশভাগ আর উদ্বাস্তুদের ইতিহাস কিছুতেই আলাদা করা সম্ভব নয়!  অনেক অজানা ষড়যন্ত্রের কাহিনী লুকিয়ে আছে এই উদ্বাস্তু সমস্যার গভীরে!  সত্যি-মিথ্যে সেভাবে যাচাই করার চেষ্টাও করা হয়নি কখনও!  বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে থেকেই যে অজস্র উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় খুঁজছিলেন তার আসল কারণ কি!  বলাবাহুল্য যে, পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু সমস্যা যে সত্তরের দশকেই প্রথম দেখা দিয়েছিল তা নয়!  ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বহু শরণার্থী কেন চলে আসতে শুরু করেন!  এর উত্তর পাওয়া সহজ নয় আবার খুব জটিলও নয়!  দিল্লিই হোক বা পশ্চিমবঙ্গেই হোক স্বাধীনতার পর থেকেই কংগ্রেস দল ক্ষমতায় ছিল দীর্ঘ সময় ধরে!  আর ওই সময় প্রতিদিন প্রতিমূহুর্তে ওই অত্যাচারে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া শরণার্থীরা কিন্তু  অলীক আশায় দিন গুনতেন,  যে তারা হয়তো  একদিন আবার তাদের দেশে ফিরে যেতে পারবেন! নিজের বাড়িতে পা রাখতে পারবেন!  ভারত সরকার নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন তাদের জন্য! কারণ তারাও তো ভারতীয় ছিলেন কোনো এক সময়ে !  কিন্তু না তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু এই বিষয়ে দূরদৃষ্টি দেখাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন!  জেনে আশ্চর্য হবেন না এতো উদ্বাস্তু সমস্যা থাকা সত্তেও স্বাধীনতার প্রায় এক বছর পরেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনো পুনর্বাসন দফতরই ছিল না!  অথচ তৎকালিন কেন্দ্র বা রাজ্যের সব নেতাই লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিতেন এই উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন নিয়ে! কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু করেননি!  রক্ষাকর্তা হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশাভঙ্গ করেছেন বারবার!  শ্রদ্ধেয় বিধান রায় অবশ্য বারংবার চিঠি লিখেও নেহরুর কাছ থেকে  কোনো রকম সাহায্য পাননি, সে কথা আজ অনেকের ই জানা নেই !   এই অসহায় উদ্বাস্তুদের নিয়ে আবার কম্যুনিস্ট পার্টির ভূমিকাও কম বিস্ময়কর নয়!   জানা যায় সেসময় পূর্ব-পাকিস্তানের কমরেডদের রীতিমতন  নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যাতে তারা ভারতবর্ষে না আসেন!  যদিও কিছু কমরেডকে পাঠানো হয়েছিল পশ্চিম-পাকিস্তানে!  কিন্তু শুনলে আশ্চর্য লাগলেও এটাই সত্যি যে পূর্ব-পাকিস্তানে যাঁরা থেকে যান তাঁদের অনেককেই রাজনৈতিক শত্রুতায় জেলে যেতে হয়েছিল! আর পার্টির আদেশ অমান্য করে যারা এরপরও শুধু প্রাণের দায়ে ভারতে আসেন তাঁদের প্রায় সবাইকে বহিষ্কার করা হয়! এর উত্তর খুব পরিষ্কার ধর্মভিত্তিক দাঙ্গাকে ঢেকে রাখা বা অস্বীকার করার দ্বিচারিতা!   দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের রাজত্বে এই একই কৌশলে কিন্তু ধর্মভিত্তিক দাঙ্গা দমনে কম্যুনিস্টরা চুড়ান্ত সফল!  কিন্তু ঝুলি থেকে বেড়াল বেরতে বেশি সময় লাগেনি!  জোর-জবরদস্তি করে সত্যি কে অস্বীকার করা যায়নি বেশিদিন!  একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাই, ছোট্ট একটা ঘটনা, 1948 এ মানিকতলার বহু কারখানার মালিকরা শ্রমিক ধর্মঘট চলার সময়, বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে কম টাকায় উদ্বাস্তুদের ধরে ধরে এনে চাকরি দিতে শুরু করেন! স্বভাবতই, কম্যুনিস্ট পার্টির একমাত্র হাতিয়ার 'ধর্মঘট'  বিফলে যাওয়ার প্রবলভাবে আশঙ্কা তৈরি হতেই নড়েচড়ে বসে তারা! উদ্বাস্তুদের মন থেকে কম্যুনিস্টদের প্রতি চরম বিদ্বেষ বা বৈরিতা দুর করার জন্য নতুন একটা স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে তারা !  সিপিআই নেতা বিজয় মজুমদারকে কংগ্রেসি বা মতান্তরে অরাজনৈতিক  সাজিয়ে পাঠানো হয় লেক ক্যাম্প উদ্বাস্তু কলোনিতে, কারণ কম্যুনিস্ট হিসাবে পাঠালে বিজয়বাবুকে উদ্বাস্তুরা কিছুতেই মেনে নিতেন না! তারপর ছ-মাসে কাটতে না কাটতেই বিজয় বাবু উদ্বাস্তু আন্দোলনের রাশ কংগ্রেসের হাত থেকে ছিনিয়ে নিজের হাতে তুলে নেন!  বিস্ময়কর ভাবে মানিকতলা শ্রমিক ধর্মঘট বানচাল হয়ে যাওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যেই, হাওয়া বদলে যায়, 1949 এর লক্ষ্মীপুজোর দিনে তৈরি হয় এক বৃহত্তম উদ্বাস্তু কলোনি,  যার নাম  ‘বিজয়গড়’।  তারপর ধীরে ধীরে দক্ষিণ শহরতলিতে তৈরি হয় একে একে পোদ্দারনগর, বাঘা যতীন, বিদ্যাসাগর, রামগড় ইত্যাদি উদ্বাস্তু কলোনি। কিছু কিছু যায়গায় তখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের আধিপত্যে বজায় থাকলেও বেশিরভাগ উদ্বাস্তু কলোনির দখল চলে যায় কম্যুনিস্ট নেতাদের হাতে!  উদ্বাস্তুদের অভাব অভিযোগকে সম্বল করে দানা বাঁধতে থাকে বামপন্থী আন্দোলন!  তৈরী হতে থাকে দারিদ্র্য দেখাতে বেশ কিছু জটিল সিনেমা ও নাটক!!!  পঞ্চাশের দশকের শুরুতে এইভাবেই একাধিক উদ্বাস্তু কলোনি গড়ে উঠেছিল, কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ক্রমাগত আসতে থাকা উদ্বাস্তুদের জন্য একসময় এইসব কলোনিতেও স্থানাভাব তৈরী হয়।  এরপর ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এদেশি অর্থাৎ পুরোনো পশ্চিমবঙ্গবাসীরা ধৈর্য হারাতে শুরু করেন। তাই 1967 এর নির্বাচনে শরণার্থী সমস্যা একটা বৃহত্তর ইস্যু হয়ে ওঠে!  তখনো ক্ষমতায় কংগ্রেস!  যদিও রাজ্য সরকারের কাছে কোনো সমাধান ছিল না!  আর এই একই সমস্যা কিন্তু 1947 এ স্বাধীনতার পরও দেখা দিয়েছিল, কিন্তু কেন্দ্র বা রাজ্যে সরকার সেবারও রাজ্যবাসীকে শুধু নিরাশই করেছিলেন!  এরপর সরকারের কাছ থেকে কোনোরকম সাহায্য বা প্রতিশ্রুতি না পেয়ে, উদ্বাস্তুরা অধৈর্য হয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই  মাথা গোঁজার জন্য অন্যায় ভাবে জবরদখলকারী হয়ে উঠতে শুরু করে!  রাজ্য জুড়ে গড়ে উঠতে থাকে একাধিক জবরদখল করা উদ্বাস্তু কলোনি!   যে উদ্বাস্তুরা দেশভাগের পর কম্যুনিস্টদের সহ্যই করতে পারতেন না, এই সর্বহারা উদ্বাস্তুদের নিয়েই বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার স্বপ্নও দেখতে শুরু করে!  বিরাট  সমর্থন তৈরী হয় লো-প্রোফাইল কম্যুনিস্ট নেতাদের!  প্রথমে সিপিআই তারপর সিপিআইএম এইভাবেই উদ্বাস্তুদের ওপর ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে!  শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে যেহেতু উদ্বাস্তুদের আধিক্য ছিল, তাই কংগ্রেসি INTUC এর বিকল্প হিসাবে উঠে আসতে থাকে AITUC, CITU এবং UTUC ইত্যাদি বামপন্থী ট্রেড-ইউনিয়ন!  সত্তরের দশকে উদ্বাস্তুরা আবার নতুন করে মুক্তির স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সমান অধিকার, সমান মর্যাদার দাবিতে লাল ঝান্ডা হাতে তুলে নেয় পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির হাত ধরে!  সাতাত্তরের নির্বাচনের ফল তাই উদ্বাস্তুদের জন্য খুশির খবর নিয়ে এলো!  কিন্তু কি হলো তার ফলে, শুধু বাড়ল অনুপ্রবেশের সংখ্যা আর নতুন নতুন জবরদখল!  কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় জমির চড়া দামের কারনে নতুন শরণার্থীদের জন্য আর কলোনি বানানো সম্ভব হল না!  এমনকি মফস্বল অঞ্চলেও তাঁদের মাথা গোঁজার কোনো ব্যবস্থা করা গেল না,  উদ্বাস্তুদের নতুন থাকার জায়গা হতে শুরু করল রেললাইনের দুই পাশ আর রেলের লাগোয়া জমি! উত্তর ও দক্ষিণ শহরতলির রেললাইনের পাশের অগুন্তি ঝুপড়ির অধিকাংশই তাই উদ্বাস্তুদের দখলে!   ভোট বড়ো বালাই! তাই ক্ষমতাসীন কোনো রাজনৈতিক দলই এই উদ্বাস্তুদের ঘাঁটায় না!  উপরন্তু বুক দিয়ে আগলে রাখে!  কিন্তু এই সমস্যা সমাধানের উপায়ও খোঁজে না!  পঞ্চাশের দশকে শরণার্থী বা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য যেমন  একটা আন্তরিক তাগিদ ছিল কিন্তু সত্তরের দশকে সেসব সহানুভূতি উড়ে যায়!  উদ্বাস্তুরা হয়ে যায় শুধুই ভোটব্যাঙ্ক!  দাবা খেলার বোড়ে!   কর্মসংস্থানের সুযোগ আর রাজনৈতিক কারণে বহু শরণার্থীই শেষপর্যন্ত রেললাইন সংলগ্ন ঝুপড়ি থেকে আর বেরিয়ে আসতেই পারেননি। শহরের বাইরে বা গ্রামাঞ্চলে আবার তৈরি হয় অন্য এক সমস্যা, পঞ্চাশের শুরুতে মূলত হিন্দু শরণার্থীরাই বাংলাদেশ থেকে আসতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু সত্তরের প্রথমদিক থেকে জাতিধর্ম নির্বিশেষে দলে দলে মানুষ নিশ্চিন্তে সীমানা টপকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে শুরু করে!  প্রথমত পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যে সেসময় বাংলাদেশের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল, দ্বিতীয়ত পশ্চিমবঙ্গে একটা আপাতনিরীহ শান্ত ধর্ম-নিরপেক্ষ পরিবেশ ছিল।  বাংলাদেশের অত্যাচারিত হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাই ভালোভাবে বাঁচার তাগিদে নিশ্চিন্তে সীমানা টপকে পশ্চিমবঙ্গকেই উপযুক্ত আশ্রয়ের যায়গা ভাবতে শুরু করে!  কিছু বাংলাদেশি মানুষ তো আবার ডুয়েল সিটিজেনও হয়ে যায়, যখন ইচ্ছে সীমানা পেরিয়ে সুবিধা মতো এপারে ওপারে দুই দেশেই বসবাস করতে থাকে!  কিছু উদ্বাস্তু আবার ঘুরপথে ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, আসাম, দিল্লি, ত্রিপুরায় ।  যদি বলা হয় সম্পূর্ণ ভোটের তাগিদে চৌত্রিশ বছরে শরণার্থী সমস্যার সমাধান করে উঠতে পারেনি বামফ্রন্ট খুব ভুল বলা হবে না মনে হয়!  কারণ কোনো চেষ্টাই তো করে নি কখনও!  এর ফলে সীমান্ত এলাকায় বহু নিম্নবিত্ত বা গরিব আদি পশ্চিমবঙ্গবাসী নিজভূমে পরবাসী হয়ে উঠতে থাকেন!  এই প্রেক্ষাপটের ওপরে দাঁড়িয়েই তৈরী হয়  দণ্ডকারণ্য এবং মরিচঝাঁপির মতো লজ্জার ইতিহাস!  কত মানুষের রক্ত ঝরেছে, কত মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন সে কথা আজ নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।  মুলত এই সত্তরের দশকের সময় থেকে, যে জাল পাসপোর্ট আর জাল র‍্যাশন কার্ডের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়েছিল তা এখনো অব্যাহত!
বিশ্বজুড়ে এখন শরণার্থী সমস্যা ফের প্রকট হয়ে উঠেছে।  আর বর্তমানে রাজনৈতিক কারণে পশ্চিমবঙ্গেও নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে শরণার্থী প্রসঙ্গে, যাতে ইন্ধন জুগিয়েছে বিজেপি, নতুন একটা শব্দ 'NRC' ঘোষণা করে,  যা মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, পরিস্কার করে বললে এই 'NRC' তে ভয় পাওয়ার কথা তো শুধু অন্যায় ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা মানুষদের, যাদের নাগরিক পরিচয়ে কোথাও একটা ধোঁয়াশা আছে!  আবার এটাও গভীর ভাবে ভাবার বিষয়, বিভিন্ন সমীক্ষায় যে তথ্য উঠে এসেছে তা হলো, শুধু 1964 থেকে 2013 এর মধ্যেই এক কোটিরও অনেক বেশি বাংলাদেশি হিন্দু,  দেশ ছেড়ে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গেই প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছেন!  আসামের মতো পশ্চিমবঙ্গেও অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি করতে চায় বিজেপি৷  ভারত ভাগের পর জনতার একাংশ পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছেন আবার ভারত থেকেও একাংশ পূর্ব পাকিস্তানে গেছেন৷ বহু মানুষ তাদের ভিটেমাটি হারিয়েছেন৷ এই স্থানান্তরিত হওয়ার অবাঞ্ছিত ঘটনা এক অর্থে বাধ্যতামূলকই ছিল৷
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের সময় যে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল, তার সঙ্গে সাম্প্রতিক বিতর্কের কোনো  যোগ নেই!  1947 এর বহু বছর পরেও দেখা গেছে সীমান্ত দিয়ে মানুষের নিত্য যাতায়াত থামেনি, বরং ক্রমশ বেড়েছে!  বিভিন্ন কারণে অসংখ্য মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গেই প্রবেশ করেছে!  প্রথম থেকেই অবশ্য এই বিষয়ে বিজেপির বক্তব্য ছিল খুব পরিষ্কার, বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে!  সেই অনুপ্রবেশে এখনও লাগাম টানা যায়নি!   তাই জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা NRC তৈরি করে অনুপ্রবেশকারীদের  চিহ্নিত করা হবে৷   2015 এ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শ্রী যুগল কিশোর এবং বিচারপতি শ্রী প্রহ্লাদ সিং পাটেল কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দফতরকে নির্দেশ দেন যে, 1947 এর পর থেকে পাকিস্তান থেকে আসা এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানরত, শরণার্থী বা অভিবাসীর সংখ্যা রাজ্য ভিত্তিক পেশ করার জন্য।  সেইমতো 28 এ জুলাই, 2015 তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু একটি তথ্য সুপ্রিম কোর্টে পেশ করেন।  সেই রাজ্যওয়ারি উদ্বাস্তু এবং অভিবাসীর সংখ্যার পরিসংখ্যানের অনুযায়ী  1948 থেকে 1958 পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আগত যে বিপুল সংখ্যক হিন্দু বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে, তাদের সংখ্যা সরকারি হিসেবেই একত্রিশ লক্ষ একষট্টি হাজার!  যেখানে অসমে ওই সময়ে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র চার লক্ষ সাতাশি হাজারের মতো।  আরও উল্লেখযোগ্য তথ্য হচ্ছে, এই সময়ে মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু কাশ্মীরে অনুপ্রবেশকারী শরণার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র সাতচল্লিশ হাজারের মতো। এখানেই শেষ নয়,  কিরেন রিজিজুর তথ্য অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান থেকে 01.01.1964  থেকে 25.03. 1971 পর্যন্ত আগত অনুপ্রবেশকারী ব্যক্তির সংখ্যা শুধু পশ্চিম বঙ্গেই সাত লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজারের মতো!  আর আসামে মাত্র দু লক্ষ চোদ্দ হাজার, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশকারী সংখ্যা আসামের তুলনায় প্রায় সাত গুণ বেশী! এবং এই অনুপ্রবেশকারীদের অধিকাংশই হিন্দু!  এই সাত গুণ বেশি সংখ্যক অভিবাসী নিয়েও পশ্চিমবঙ্গবাসীর কিন্তু কখনও মনে হয়নি আসামের ধাঁচে একটা বিদেশি তাড়াও আন্দোলন এখানেও হোক বা এখানেও একটা NRC হওয়া খুব দরকার!  না হলে রাজ্যটা গোল্লায় যাবে একদিন!  যদিও গোল্লায় যেতে আর কিছু বাঁকি নেই!  বিজেপির হিসেব অনুযায়ী 1971 থেকে 2019 পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা আটচল্লিশ বছরে বেড়েছে এক কোটির অনেক বেশি যা পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় আট ভাগের এক ভাগ ! নিরবচ্ছিন্নভাবে আটচল্লিশ বছর গড় হিসেবে দৈনিক সাড়ে পাঁচশোরও বেশি অনুপ্রবেশকারী সীমানা  টপকালে তবেই এই সংখ্যা হতে পারে!  আচ্ছা একটা খুব সঙ্গত প্রশ্ন, সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব তো বিএসএফের!  আর বিএসএফ তো কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে, তাহলে!  এটাও মনে রাখতে হবে এই সময়কালের মধ্য বাজপেয়ীর ছয় বছর আর মোদীর ছয় বছর মিলে মোট বারো বছর বিজেপি সরকার কেন্দ্রে সরকারে ছিল!  মোরারজি,ভিপিসিং, গুজরালের সময় ধরলে যার অংশীদার জনসঙ্ঘ বা বিজেপিও ছিল তাহলে আরও বেশি !  NRC তে 1971এর 25 মার্চকে ভিত্তিবর্ষ মেনে নেবার পিছনে কিন্তু ছিল একটা অঙ্ক!  আসামের উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও জাতীয়তাবাদীদের মনে  প্রাথমিকভাবে সেই অঙ্কই কাজ করেছিল!  তারাও হয়তো ভেবেছিলেন 1971 এর 25 মার্চ কে ভিত্তিবর্ষ ধরলে হিন্দুরা ঠিক বেঁচে যাবে, আর ছাঁকনিতে বাদ পড়বে এর পরের দিকে অনুপ্রবেশ করা মুসলিমরা!  কিন্তু অঙ্কে একটা মস্ত ভুল ছিল,  সঠিক তথ্য হাতে না নিয়েই দুম করে NRC ঘোষণা করে তাই আজ বোধহয় ঘোর বিপাকে বিজেপি!  অন্তত পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই!       এবার উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে একটু গভীরে প্রবেশ করি, দেখে নেওয়া যাক এবিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ কি বলছে:- শরণার্থী বা উদ্বাস্তু অর্থাৎ  'Refugee' মানে একজন ব্যক্তি যিনি নিজ ভূমি ছেড়ে অথবা আশ্রয়ের সন্ধানে অন্য দেশে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করেন।জাতিগত-সহিংসতা, ধর্মীয় উগ্রতা, জাতীয়তাবোধ বা রাজনৈতিক আদর্শগত কারণে সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতাই এর প্রধান কারণ।  যিনি শরণার্থী বা উদ্বাস্তুরূপে স্থানান্তরিত হন, তিনি আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে পরিচিত হন।  আশ্রয়প্রার্থী  ব্যক্তির স্বপক্ষে তার দাবীগুলোকে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই একটু রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে ঢুকে পড়েছি, রোহিঙ্গাদের নিয়েও চর্চা হচ্ছে, চায়ের দোকানে, বাসে, ট্রেনে, অফিসের কাজে ফাঁকি দিয়ে,মানুষের নাগরিক অধিকার রক্ষা নিয়ে প্রচুর কথা হচ্ছে, কিন্তু এই সমস্যা তৈরির ইতিহাসে যদি একটু চোখ রাখি, এই সমস্যার শুরুর গল্প অনেকটা এইরকম :-      ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ঘিরেই মুলত এই সমস্যা,1947 এ দেশভাগ বা অবশ্যই বলা যেতে পারে সিলেট ভাগের কারনে, বিশেষত বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের নাগরিকত্বের অধিকারকে ঘিরেই এই সমস্যার শুরু। কিন্তু পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বাঙালিদের নিয়েই শুধু এই মাথাব্যথা কেন!  প্রথমে দেশভাগ ও পরে বাংলাদেশের জন্মের পর পূর্ববঙ্গ থেকে আসা শরণার্থীরা যে শুধুমাত্র বাঙালি ছিলেন তা তো নয়, প্রচুর সংখ্যক আদিবাসীরাও তাঁদের জমি বাড়ী রুজি রোজগার হারিয়ে, চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন নিজেদের জন্মভূমি থেকে, বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষরা।                   
1947 এ ‍র‍্যাডক্লিফ লাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের প্রায় 98% বৌদ্ধ ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর মতামত কে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে এই অঞ্চলকে জুড়ে দেয়া হয় নতুন ভাবে জন্ম নেওয়া পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে! ব্রিটিশ শাসনকালে প্রশাসনিক স্বার্থে এই অঞ্চলের বিশেষ মর্যাদা ‘Totally Excluded Area’ র আইন-কানুনকে সম্পূর্ণ অমান্য করে একদম ঘেঁটে দেওয়া হল!  যার ফলে পঞ্চাশের দশক থেকেই ওই আদিবাসীরা চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়তে শুরু করে, চট্টগ্রামের গুরুত্ব তার শিল্প সম্ভাবনা, তার ভৌগোলিক অবস্থানকে ঘিরে আর এই অবস্থানকেই ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠে। 1953 তে চন্দ্রগোলাতে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের সহায়তায় কর্ণফুলি পেপার মিল এবং 1959 থেকে 1963 সাল পর্যন্ত পাকিস্তান আমলের সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা, কাপতাই হাইড্রোইলেকট্রিক প্রোজক্ট তৈরি করা হয়, চট্টগ্রামকে শিল্পনগরী গড়ে তোলার কাজে এবং কাপতাই প্রোজেক্টের সার্থক রূপায়ণের জন্য প্রায় 52000 একর চাষযোগ্য জমি অধিগ্রহণ করাও হয়, যা ছিল চট্টগ্রামের মোট আবাদি চাষযোগ্য জমির প্রায় 40%।   চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমারা সংখ্যার দিক থেকে বেশি হলেও, মারমা, টিপরা, হকং, হাজং, রিয়াং প্রভৃতি জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষেরও বাসভূমি। সমস্যাটা শুরু হয় প্রথম এই জমি অধিগ্রহণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে, প্রায় কয়েক লক্ষ আদিবাসীকে জমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার তাদের কোনো রকম ক্ষতিপূরণ না দেওয়ায় তারা অন্যত্র চাষের জমি এবং বাসস্থান খুঁজতে শুরু করে।  এই সময়েই প্রথম ভূমিহীন আদিবাসীরা আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয়ের চেষ্টা ও দাবি জানাতে শুরু করে।                                                            1960 এ প্রায় চল্লিশ হাজারেরও বেশী চাকমা ও হাজং রা ত্রিপুরা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে, কেন্দ্রীয় সরকার নেফা অঞ্চলের টিরাপ ও চাংলাং জেলার এজেন্সি এলাকায়, লোহিত ও সুবলসিঁড়ি জেলায় প্রায় 10780 একর জমিতে এদের চিরস্থায়ী ভাবে পুনর্বাসনও দেয়। যদিও 1955 এর নাগরিকত্বের আইনে এদের কিন্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। 1972 সালের 21এ জানুয়ারি নেফা ইউনিয়ন টেরিটরিতে পরিণত হয়। অরুণাচল প্রদেশ নামে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পাওয়ার পর থেকে Peoples party of Arunachal আর All Arunachal parades Students Union, চাকমা ও হাজং উদ্বাস্তুদের অবস্থানের বিরোধিতা শুরু করে।  1980 থেকে রাজ্য সরকার এদের চাকরি ও ব্যবসা করার বিরোধিতা করতে শুরু করে! সরকারের যুক্তি ছিল, কম জনসংখ্যার কারণে অরুণাচল প্রদেশ ক্রমে উদ্বাস্তুদের ‘dumping ground’ এ পরিণত হয়ে যাচ্ছে।  1985 এর নাগরিকত্ব আইনেও এদের কথা বলা হয়নি ঠিক অসমের মতোই, যেসব আদিবাসীরা জন্মসূত্রে অরুনাচলের বাসিন্দা, তাদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকারও আইনত স্বীকৃত হয়নি,  এতো পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারে আজকের এই চিৎকার চেঁচামেচি করা বিরোধী দল কংগ্রেসই ছিল!
1971 এ স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর মিজোরাম আর ত্রিপুরাতে এই আদিবাসীদের অনুপ্রবেশ আরও বাড়তে শুরু করে।   1975 এ জিয়া-উর-রহমানের ‘রাষ্ট্রীয় ইসলামিকরণ’ নীতি ও এরশাদের শাসনকালে কয়েক লক্ষ বাঙালি মুসলমানকে চট্টগ্রামে বসবাসের জন্য জমি প্রদান করা হয়, অথচ এই একই সময়ে মিজোরামে প্রায় 30000, ত্রিপুরায় প্রায় 70000 চাকমা আশ্রয় নেয়।  পরবর্তীকালে এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা রক্তপাত ও সংঘর্ষের পর, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে 1997 এ বাংলাদেশ সরকার অবশেষে PCJSS এর সঙ্গে ‘Peace Accord’ চুক্তিতে  সই করে, সামান্য কিছু আদিবাসীরা ফিরে গেলেও বেশিরভাগই থেকে গেছে, যাঁদের নাগরিকত্ব স্বাভাবিক ভাবেই আজ প্রশ্নের মুখে। 1970 এর মাঝামাঝি থেকে চট্টগ্রাম যখন জাতিসত্তা ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার নিয়ে সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল, 1978 এ নাফ নদী পেরিয়ে এবং  বান্দরবন-মায়ানমার সীমানা অতিক্রম করে প্রথমে প্রায় দু লক্ষ মানুষ চট্টগ্রামে আশ্রয় নেন, তারপর থেকে অনুপ্রবেশ চলতেই থাকে, এখন অবধি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় এগারো লক্ষেরও বেশি। মায়ানমার এর উত্তর রাখাইন প্রদেশে ঠিক একই রকমের ধর্ম, ভাষা ও জাতিসত্তা রক্ষার প্রশ্নে বিপন্ন মুসলমান রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার জন্য উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয়ের খোঁজে চলে আসছেন।  যদিও বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে প্রত্যাবর্তন নিয়ে এখনও পর্যন্ত চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছে, কিন্তু এদের ঘুঁটি বানিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে সাহায্যে নিতে কিন্তু অস্বীকার করেছে না, তাই  হয়তো মুখ রক্ষা করতে হাসিনা সরকার উখিয়া ও টেকনাফ অঞ্চলে অস্থায়ী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ও বাসস্থানের সামান্য কিছু লোক দেখানো ব্যবস্থা করেছেন।  কিন্তু অবৈধ ভাবে বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত লাগোয়া গ্রামে আশ্রয় নেওয়া বা জনসমাজের মূল স্রোতে জোর করে মিশে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের সংখ্যাটা অনেক বেশী!   চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করছে অসংখ্য দেশি-বিদেশি NGO, আর তাই অনেক ক্ষেত্রেই বিধিনিষেধ না মেনে স্থানীয় শ্রম-বাজারে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করছে এই রোহিঙ্গারা, দেহ ব্যবসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধ মুলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ, স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যেও এই নিয়ে চুড়ান্ত অসন্তোষ আছে, তাই একই ধর্মাবলম্বী হয়েও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে এখন সবথেকে বেশি বিরক্ত বাঙালি মুসলমানরা! বুঝে দেখুন ব্যাপারটা! তাদের সবথেকে বড় ভয়, এভাবে অনুপ্রবেশ চলতে থাকলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা হয়তো একদিন বাঙালি মুসলমানদের থেকেও বেশি হয়ে যাবে।  এতো বড়ো গল্পটা বলার একটাই উদ্দেশ্যে, এই হারে অবাধ অনুপ্রবেশ চলতে থাকলে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও এরকম হতে পারে ভবিষ্যতে!  কেউ এখনও গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে না এই উদ্বাস্তু সমস্যার কথা, শুধু ভোটের অঙ্ক মাথায় রেখে  যে যার মতো রাজনীতি করতেই ব্যাস্ত!  কেউ আবেগের কথা, অতিথি সেবার কথা বলছে তো কেউ চুপচাপ সাম্প্রদায়িক তাস খেলছে!    সংখ্যালঘুদের নিয়ে, তাদের সুরক্ষা নিয়ে, সীমান্তের কাছে বসবাসকারী নিপীড়িত মানুষেদের ছবি কিন্তু পৃথিবীর সব দেশেই মোটামুটি একই রকম....
আসামে NRC তে তালিকাছুট উনিশ লক্ষ মানুষের পরিচয় কী হবে! তাঁদের ভবিতব্য কী হতে চলেছে!  সত্যিই জানা নেই ... কিন্তু এটা নিশ্চিত যে সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি করা এখন বিরোধী দল গুলোর বৃহত্তর রাজনৈতিক খেলা, বলা ভালো ভোটের অঙ্ক কষা !!!   NRC নিয়ে তাই ভারতে বসবাসকারী Separatists দের সাথে অজ্ঞান, অশিক্ষিত, দেউলিয়া ইমরান খানের সুরও মাঝে মাঝে এক সুরে মিলে যায়! যেটা একদম কাম্য নয়! তাই  আখের গোছাতে ব্যস্ত নেতাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কাছে হার মানে ইতিহাস আর বাস্তব....                         




(সংগৃহীত তথ্য অনুসারে লেখা পরিসংখ্যানে ত্রুটি থাকলে মার্জনীয়)



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours