সন্দীপ চক্রবর্তী, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

পশ্চিমবঙ্গে কেউ যদি নিজের হিন্দু পরিচয়ে পরিচিত হতে চান তা হলে বাম-প্রগতিশীল এবং ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের কেষ্টবিষ্টুরা রে রে করে তেড়ে আসবেন। একজন মুসলমান নিজেকে মুসলমান বলুন, আপত্তি নেই। খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রেও না। শুধু একজন হিন্দু নিজেকে হিন্দু বললেই তিনি সাম্প্রদায়িক। না, দুর্গাপুজোর ফিতে কাটতে তাদের কোনও অসুবিধা নেই, এমনকী, মাঝে মাঝে কালীঘাট বা তারাপীঠে পুজোও দেওয়া চলতে পারে—কিন্তু প্রকাশ্যে নিজেকে হিন্দু বলা বা ভাবা তাদের কাছে গর্হিত অপরাধ! চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনে এবং তার পরের তৃণমূলী শাসনে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার এমনই এক জগাখিচুড়ি মার্গদর্শন লাভ করেছি।
 স্বাভাবিকভাবেই সম্প্রতি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে লোকসভায় এবং রাজ্যসভায় যে দীর্ঘ বিতর্ক হয়ে গেল, সেখানেও আমরা এই মার্গদর্শনের সফল মঞ্চায়ন প্রত্যক্ষ করলাম। এ কথা অনস্বীকার্য, দেশীয় রাজনীতির কিছু কিছু মৌলিক বিষয়ে বামেদের এবং কংগ্রেসিদের চিন্তাভাবনায় কোনও পার্থক্য নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ভোটব্যাঙ্ক এরকম দুটি বিষয়। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ক পশ্চিমবঙ্গের মার্গদর্শনটি সারা ভারতেই চলে। অর্থাৎ হিন্দুরা এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে তারাই অত্যাচারী। আবার তাদের মধ্যে তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষেরা তুলানায় বেশি ক্ষমতাশালী, তাই তাদের অত্যাচার ভয়াবহ। অন্যদিকে মুসলমানরা এ দেশে সংখ্যালঘু বলে তারাই শোষিত, নিপীড়িত। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে বিতর্কেও মোটামুটি এই চিন্তাভাবনার প্রতিফলন দেখা গেছে। যারা বিলের বিরোধিতা করেছেন তাদের বক্তব্য, বিলটি মোদী সরকারের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ফসল। এই বিল মুসলমান-বিরোধী এবং বৈষম্যমূলক। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন গলা আরও একধাপ চড়িয়ে মন্তব্য করেছেন, এই বিল বাঙালির স্বার্থবিরোধী। এবং তারা কোনওভাবেই পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের বঞ্চিত করে শুধু হিন্দু শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান এবং পার্সিদের নাগরিকত্ব দিতে দেবেন না।
 এইসব বাগাড়ম্বর শুনে প্রাথমিকভাবে মনে হয় আজকাল ভারতে বিরোধী রাজনীতিবিদদের শিক্ষাদীক্ষার হাল বেশ খারাপ হয়ে পড়েছে। একটু তলিয়ে ভাবলে তারা বুঝতে পারতেন পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে যারা ভারতে এসেছেন, রাষ্ট্রপতি সাক্ষর করে দেবার পর আইনে পরিণত হওয়া এই বিল তাদের মধ্যে কারা অনুপ্রবেশকারী আর কারা শরণার্থী তা স্পষ্ট করতে চায়। তারপর প্রকৃতই যারা শরণার্থী তাদের নাগরিকত্ব দিতে চায়। কিন্তু প্রকৃত শরণার্থী কারা? এ ব্যাপারে সরকার নির্ভর করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া শরণার্থীর সংজ্ঞার ওপর। এই সংজ্ঞা সারা বিশ্বে মান্য। সংজ্ঞাটি এরকমঃ যে ব্যক্তি ধর্ম, বর্ণ বা জাতিগত কারণে, কিংবা কোনও রাজনৈতিক মতামতের কারণে নিজের দেশে অত্যাচারিত হয়ে বা অত্যাচারের আশঙ্কায় অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন তিনিই শরণার্থী। এই সংজ্ঞা মেনে নিলে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন ওঠে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান ঘোষিত ইসলামিক দেশ। এইসব দেশে কোনও মুসলমান কি ধর্ম,বর্ণ বা জাতিগত কারণে অত্যাচারিত হতে পারেন? জবাব, পারেন না। তা হলে পশ্চিমবঙ্গে এখন যে কোটি কোটি বাংলাদেশী মুসলমান বসবাস করছেন তারা কারা? অবশ্যই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। এই আইন তাদের চিহ্নিত করে এ দেশের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সিস্টেম থেকে বহিষ্কার করতে চায়। কারণ এদের একটা বড়ো অংশ বাংলাদেশের জামাত এবং হেফাজতের মতো মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। প্রথম এনডিএ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানী এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের তখনকার বাম সরকারকে সতর্ক করেছিলেন। তখনই জানা গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গব্যাপী অসংখ্য জঙ্গি মডিউলের কথা। এইসব মডিউলের পিছনে আছে বাংলাদেশের মৌলবাদী সংগঠন জামাতের লোকেরা। বলা বাহুল্য, এরা সকলেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। এদের কাছে রেশন কার্ড থেকে শুরু করে আধার কার্ড সবই আছে। এরা এমনভাবে ভিড়ে মিশে থাকে যে সাধারণ মুসলমানদের পক্ষেও এদের প্রকৃত উদ্দেশ্য জানতে পারা সম্ভব নয়। খাগড়াগড়-কাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এন আই এ) এদের সম্বন্ধে অনেক তথ্য পেয়েছে। খাগড়াগড়-কাণ্ডে জামাত-যোগের প্রমাণও পাওয়া গেছে। সুতরাং, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা পশ্চিমবঙ্গের তথা সারা ভারতের নিরাপত্তার জন্যেও সবিশেষ প্রয়োজন।

কিন্তু লালকৃষ্ণ আদবানীর সতর্কবার্তা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যেমন মুসলমান ভোটের লোভে ফুতকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঠিক সেরকম ঢংয়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করতে নেমে পড়েছেন। অথচ এই মমতাই ২০০৫ সালে সংসদে বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে ২ কোটি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। তাদের রেশন কার্ড দিয়ে ভোটার বানিয়েছে সিপিএম এবং তাদের ভোটের জোরেই বামফ্রন্ট বছরের পর বছর গদি টিকিয়ে রেখেছে। হ্যা, অনুপ্রবেশকারীরা তখন সিপিএমকে ভোট দিত। এখন দেয় মমতাকে। তাই এখন তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশের সমর্থক। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং নাগরিক পঞ্জীকরণের বিরোধী। অর্থাৎ সবটাই ভোটের জন্য। তার কাছে হিন্দু বাঙালির মানসম্মান ও নিরাপত্তার কোনও দাম নেই। মহরমের মিছিল যাবে বলে মুসলমানরা দুর্গামূর্তির মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলে তিনি পরোয়া করেন না। নবির জন্মদিন পালনের অজুহাতে তেহট্ট স্কুলের সরস্বতী পুজো বন্ধ করে দেয় জেহাদি মুসলমানেরা আর মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যত পুলিশবাহিনী বিক্ষোভরত হিন্দু ছাত্রীর মাথা ফাটিয়ে দেয়।
এরকম একজন মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্যে নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের একাংশ যে রাজ্যটিকে মগের মুলুকে পরিণত করবেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। হয়েছেও তাই। প্রচুর টায়ার পুড়েছে, রেলের কাউন্টার থেকে টাকা লুট হয়েছে, হিন্দুদের দোকানঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে আর দাড়ি-টুপি শোভিত একদল গুন্ডার ছোড়া ইটের টুকরোয় রক্তাক্ত হয়েছেন রেলের যাত্রীরা। পুলিশ যথারীতি কলের পুতুল। অবশ্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা হাতজোড় করে অনুনয় করেছেন। গুন্ডাদের অনুরোধ করেছেন, যদি সম্ভব হয় তা হলে অন্যভাবে প্রতিবাদ করতে। বুদ্ধিজীবীদের সমস্যাটি বোঝা দুরূহ নয়। বাংলাদেশে বইয়ের বাজার ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশের মানুষকে চটানো চলে না। তাই বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সত্যি কথাটাও বলা যায় না। সব দেখে শুনে মনে হয়, ব্রিটিশ ভারতে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে যে-মানুষটি নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন, আজ তিনি থাকলে এইসব বুদ্ধিজীবীকে দেখে বেজায় কষ্ট পেতেন। আবার আনন্দও তার কম হত না। কারণ তার প্রজ্ঞা ব্যর্থ হয়নি। বাঙালির চরিত্র সম্বন্ধে তিনি লিখেছিলেন, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি। অন্তত বাঙালি বাম-প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে কথাটা আজও বর্ণে বর্ণে সত্যি।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours