কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

রবিবারের আগুন মঙ্গলবারেও ফের দিল্লির বুকে।
জামিয়াকাণ্ডের আঁচ ছড়ালো রাজধানীর জাফরাবাদে। আগুন জ্বললো দিল্লি পুলিস পোস্টে। পুড়ে ছাই হয়ে গেলো পুলিসের বাইক। চললো বাসে ভাঙচুর। তারমধ্যেই দুদিক থেকে পাথরবৃষ্টি। রবিবারের ছবিটাই ফের যেন আজ আবার ফিরে আসতে চেষ্টা চালালো দিল্লির বুকে।

একদিকে কংগ্রেস অন্যদিকে আপ। দুয়ের রশি টানাটানি। ছাত্র বিক্ষোভে পুলিসের লাঠিচার্জের অজুহাতে নিজেদের উচ্চাশা পূরণ। রবিবারের ঘটনার পর চব্বিশ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই, ক্রমে ঘটনার নেপথ্য রহস্য ফাঁস হচ্ছে। বাস্তবে রবিবার জামিয়া ছাত্রদের অবস্থাটা দাঁড়িয়েছিল শিখন্ডির। তাদের সামনে রেখে রবিবার দিল্লির রাস্তায় তাণ্ডব চালায় বহিরাগত দুষ্কৃতিরা।

রাজধানীর বুকের আগুনে সে সন্ধ্যায় ঘৃতাহুতির কাজ করেছিল সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু অপপ্রচার। যার মূলে ছিলেন রাজনীতির ধুরন্ধররা। আর এ ব্যাপারে প্রথমেই যাঁর নাম উঠে এসছে, তিনি দিল্লির উপমুখ্যামন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া। সব মিলিয়ে, নাগরিক বিলের মতো নির্ভেজাল এক রাজনৈতিক ঘটনায় ক্রমেই চেপে বসছে সাম্প্রদায়ক রং।

তবে এখনও ঘোর সন্দেহ দিল্লি পুলিসের ভূমিকায়। জামিয়া ছাত্রছাত্রীদের ওপর তারা কেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? ঠিক কতটা নৃশংস হামলা চালিয়েছিল পুলিস? এ ব্যাপারে আম আদমি পার্টির সঙ্গে গলা মিলিয়েছে কংগ্রেস। ওদিকে নিজেদের সাফাই দিয়েছে দিল্লি পুলিসও। এক ভিডিও প্রকাশ করে পুলিস দাবি করে, ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে সমানে পাথরবৃষ্টি করা হচ্ছিল। পুলিস বারবার সাবধান করার পরেও তাদের ওপরে হামলাবাজি থামেনি। এরপরেই জামিয়া ক্যাম্পাসে পুলিস ঢুকে পড়ে।
তবে জামিয়া পড়ুয়াদের ছাত্রছাত্রীদের কথায় স্পষ্ট, পুলিস সে রাতে লাইব্রেরিতে ঢুকে নিরীহ পড়ুয়াদের সম্পূর্ণ অকারণেই বেধড়ক পিটিয়েছিল। পুলিসের ওপর তারা কেউ পাথর ছোঁড়েনি বলে দাবি বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের।

ঘটনায় ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে যা মনে হয়, রবিবার রাতে এক ব্যাপক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল জামিয়া ছাত্রছাত্রী আর দিল্লি পুলিস উভয়েই। যার পরিণতিতে পুলিসের জুলুমের শিকার হয় অহিংস আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা। তাহলে সেরাতে ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে পাথর ছুঁড়ছিলো? এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত লুকানো আছে জামিয়া উপাচার্য নাজমা আখতারের কথায়। তিনি জানান, সাড়ে সাতশো ফেক আইডি ধরা পড়েছে। ওদিকে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের মারধোর করার প্রতিবাদে রবিবার রাতে দিল্লি পুলিস হেড কোয়ার্টারের সামনে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পড়ুয়ারা। তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে দেশের একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

ছাত্রদের মিছিল যে হিংসা ছড়ায়নি সে কথা পুলিসও কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে। তবে ভিড়ের মধ্যে যে পরিকল্পনামাফিক বেশকিছু দুষ্কৃতি ঢুকে গেছিল তাও পরিষ্কার। পুলিসের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া দশজন সন্দেহজনকের মধ্যে একজনও ছাত্র নেই। এদের মধ্যে সাতজনই দাগী। বাদবাকী তিনজনের নামও আছে পুলিসের খাতায়। বাস জ্বালানো, বাইক ভাঙচুরের খলনায়ক ছিল এরাই। তবে ওই ঘটনা যে নেহাত গুন্ডামি ছিলো না, ভিডিওতে তাও পরিষ্কার। হামলাকারীদের বলতে শোনা গেছিল, বেছে বেছে সরকারি গাড়িতে আগুন লাগানোর কথা।
ঘটনার পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল রাজনীতির বাস্তুঘুঘুরাই। তার স্পষ্ট প্রমাণ রেখেছিলেন আম আদমি পার্টির দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া। ঘটনার সন্ধ্যায় তিনি যে ভিডিওটি প্রচার করেছিলেন, তাতে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে বাসে আগুন লাগিয়েছে খোদ দিল্লি পুলিস। ওই একটিমাত্র ভিডিওই আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করে। জামিয়া ক্যাম্পাসে ঢুকে বেধড়ক ছাত্র পেটানোর ঘটনায় এমনিতেই খেপে ছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। তার ওপরে বিক্ষোভরত ছাত্রদের হাতে সেই ভিডিওটি চলে আসায়, রাগ মুহূর্তেই আক্রোশের চেহারা নেয়। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে পুলিসের গুলিতে ছাত্রমৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই। খোদ জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটির উপাচার্য নাজমা আখতার জানান, পুলিসের গুলিতে দুই ছাত্রের মৃত্যুর গুজবও ছড়িয়েছিল।
কিন্তু সত্যিই কি সেরাতে পুলিস গুলি চালিয়েছিল? ঘটনা যে মনগড়া তা নয়। কারণ গুলিতে আহত এক আন্দোলনকারী হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যান। তবে ওই জখম ব্যক্তির পায়ের ক্ষত রাবার বুলেটের কিনা তা স্পষ্ট নয়। এদিকে গুলি চালানোর অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছে পুলিস।

সন্দেহের আঙুল উঠেছে আরেক আপ বিধায়ক অমানতুল্লার দিকেও। অভিযোগ, তিনিও সেদিন এক জনসভায় উসকানিমূলক বক্তব্য রাখেন। যদিও অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন বিধায়ক। আপের বক্তব্য, গোটা ঘটনার পিছনে কলকাঠি নেড়েছে বিজেপি। পদ্মশিবিরের লক্ষ্য, আগামী বছরের নির্বাচনে আপের হাত থেকে যেভাবেই হোক দিল্লি কেড়ে নেওয়া। ওদিকে মোদি সরকারকে তুলোধনা করেছে কংগ্রেসও। বিভাজনের রাজনীতির প্রতিবাদ করাতেই জামিয়াতে হামলা চালিয়েছে পুলিস। ছাত্র পিটিয়ে তাদের আন্দোলনকে দমানো যাবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। রবিবার রাতেই বিক্ষোভরত ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান একাধিক কংগ্রেস নেতা।

গোটা ঘটনায় পরিষ্কার, ছাত্রমিছিলে দুষ্কৃতি ঢুকিয়ে, ফেক ভিডিও প্রচার করে, জামিয়া পড়ুয়াদের সঙ্গে দিল্লি পুলিসকে সরাসরি লড়িয়ে দেওয়ার ছক কষা হয়েছিল নিপুণ হাতে।
ঘটনার পরদিনই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তৎপরতায় স্পষ্ট হয়, পুলিস আগুন নেভানোর কাজই করেছিলো। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের কথাতেও তা স্পষ্ট হয়। তাঁদের বক্তব্য, গুন্ডামির ঘটনায় জামিয়া ছাত্ররা ছিলো না।
তবে রবিবারের ঘটনাকে হালকা করে দেখতে রাজি না দিল্লি পুলিস। তাদের দাবি, আরও কোনও বড় ঘটনা ঘটানোর চক্রান্ত করা হয়েছিলো। ঘটনার পেছনে বিদেশি হাত আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই গৃহমন্ত্রকের দপ্তরে ঘটনার রিপোর্ট জমা দিয়েছে পুলিস।

এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে ফের উত্তেজনা ছড়ায় দিল্লির জাফরাবাদে। জামিয়াকাণ্ডের প্রতিবাদে সিলমবাদ থেকে এক মিছিল বেরোয়। এরপর তা জাফরাবাদ এলাকায় পৌঁছতেই হিংস্র রূপ নেয়। পাথর ছোঁড়া হতে থাকে পুলিসের দিকে। মারমুখী বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুর চালায় বাসে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় পুলিস পোস্ট, বাইকে। দুধার থেকে উড়ে আসা পাথরের মধ্যে পড়ে একসময় পিছু হটতে বাধ্য হয় পুলিস। তবে তারপরেই ফের ঘুরে দাঁড়ায় তারা। আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঘণ্টা তিনেকের চেষ্টায়, পুলিস এলাকার পরিবেশ শান্ত করে।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours