আহসান হাবিব, লেখক, বাংলাদেশ:

সময় যত এগিয়ে চলেছে, মানুষ ক্রমে একা হয়ে পড়ছে। সমষ্টি থেকে একা, এমনকি পরিবারও একত্বের দিকে এগিয়ে চলেছে । মানুষ একা থাকতে চাইছে, একাই নির্মাণ করতে চাইছে নিজের পৃথিবী, ফলে দ্বন্দ্বও প্রখর হয়ে উঠছে । এটা ভাল কি মন্দ তার চাইতে এটা একটি বাস্তবতা, তা ফুটে উঠছে । তাই আপনি যেখানেই দাঁড়াবেন বিভাজিত হয়ে পড়বেন, এমনকি নিজের ছায়ার কাছেও আপনি বিভাজিত । ভোরের রোদের কাছে আপনি এক রকম আবার দ্বিপ্রহরে অন্যরকম । অপরাহ্ন যখন আপনাকে ঘিরে তৈরি করবে নিজ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আবহ বা ছায়া, আপনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করবেন আপনার বিভাজিত রুপ, আপনি ক্ষুদ্র হয়ে পড়েছেন।

আপনি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সংগে গল্প করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন । বিষয় থেকে বিষয় নিয়ে কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছেন । এক সময় আপনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করছেন আপনার বন্ধু আপনার চেয়ে অসাধারণ দক্ষতায় বিষয়ের গভীরে ঢুকে তুলে আনছেন কথার মুক্তোরাজি, আপনি ধীরে ধীরে নীরব হয়ে পড়ছেন, একটা হীনমন্যতা আপনাকে গ্রাস করছে, হয়তো অন্য কেউ টের পাচ্ছে না, আপনি খুব টের পাচ্ছেন, আসলে আপনি তখনই বিভাজিত হয়ে পড়েছেন । আপনার প্রিয় বন্ধুর কাছে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে । বন্ধু তার বাগ্মিতা উপভোগ করছেন দারুণ এক ভঙ্গিমা বজায় রেখে । উল্টোটিও হয় । অর্থাৎ আপনি যখনি কোন মানুষের সান্নিধ্যে যাচ্ছেন, আপনি বিভাজিত হয়ে পড়ছেন । আপনার চাওয়া কিংবা না চাওয়ার উপরে নির্ভর করছে না । এটা শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়, লক্ষ্য করেছি, প্রাণী জগতের সবার ভেতরে এই বিভাজন ক্রিয়াশীল । বিভাজন মানেই বৈষম্যের ইঙ্গিত । অর্থনৈতিক যে কোন প্রপঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এই বৈষম্য অবধারিত ভাবেই বিদ্যমান এবং এর মধ্য দিয়েই সামাজিক গতিময়তা চলমান । শ্রেনীদ্বন্দ্ব এবং তা থেকে উৎসারিত বৈষম্য বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।
সমাজ হেটারজেনাস উপাদানে ভরপুর । কেউ দারুণ বুদ্ধিমান, কেউ বুদ্ধু । কারো ভেতর কাজ করে অগ্রগামী চিন্তার কল্পনাশক্তি, কেউ আবার শুধু দিন যাপন করে, বাঁচে । কেউ ভীতু, কেউ দারুণ সাহসী, কেউ বিপ্লবী, কেউ আবার নন্দলাল । এমন বৈপরীত্বে ভরা এই সমাজ । যত বৈপরীত্ব তত বিভাজন, তত বৈষম্যের সূত্রপাত । এখন প্রশ্ন হল এই বৈপরীত্ব কি প্রাকৃতিক নাকি সামাজিক ? প্রথমত এটা প্রাকৃতিক, পরে মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে বাধ্য হয়েছে, তখন থেকেই সামাজিক হতে শুরু করেছে । নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মানুষ প্রকৃতির কাছে হাত পেতেছে, তাকে বদলেছে । তার ভেতর থেকে নিজের জন্য বেঁচে থাকার সব উপাদান তৈরি করেছে । অর্থাৎ মানুষ উৎপাদন ক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়েছে । এই যুক্ত হয়ে পড়ার রুপ প্রথমে যেমন ছিল, ক্রমে তা বদলে যেতে থেকেছে । ক্রমে সুসংহত হয়েছে । মানুষ প্রকৃতিকে জানতে শুরু করেছে এবং এই বদলানোর মধ্য দিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছে । এটা কোন একক মানুষের ইচ্ছাকৃত কাজ নয়, ইচ্ছা নিরপেক্ষ সামাজিক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এটা হয়ে চলেছে । ইচ্ছা করলেই মানুষ এই গতিকে রুদ্ধ করতে পারে না । অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তার নিজস্ব নিয়মেই চলবে, কারো কোন মাতব্বরি চলবে না।

তাহলে মানুষ কি করতে পারে ? মানুষ কি বিভাজন কমাতে পারে ? পারে, উৎপাদিত বস্তুর ন্যায্য বণ্টনে মানুষ ভুমিকা রাখতে পারে । রাখতেই হবে এমন দিব্যি কেউ দেয়নি, তবে মানুষ তার বিবর্তনের ধারায় যে সংস্কৃতি নির্মাণ করেছে, সহমর্মিতা তার একটি শ্রেষ্ঠ উপাদান । এই উপাদন দিয়েই বিভাজন কমিয়ে আনা সম্ভব এবং সেই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে । বৈষম্য আছে কিন্তু দারিদ্র্য কমে আসছে । যদিও এই কমে আসা পৃথিবীর সবখানে এক নয়, ভিন্ন রকম । এইখানে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার বাস্তবায়নের উপর নির্ভর  করছে যাবতীয় পরিবর্তন । কেননা এখন পর্যন্ত যা বললাম সবই রাজনীতির অন্তর্গত এবং নিয়ন্ত্রিত । একটি দ্বন্দ্বমুলক সহাবস্থান এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে অব্যাহত রাজনৈতিক চাপ বৈষম্য কমাতে ভুমিকা রাখে এবং এই ভুমিকার জন্যই একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার উপর মানুষের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পেয়ে আসছে।

জোর করে কিংবা চাপিয়ে দিয়ে কি এই বৈষম্য বা বিভাজন কমানো যায় ? ইতিহাস বলছে- না । বরং জোর করে যা কিছু হয়েছে, পরবর্তীতে তা টেকেনি, ভেঙে পড়েছে । এখন এই সত্য দিবালকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে প্রকৃতিকে তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বদলে ফেলার নিয়ম আত্মস্থ করে সামাজিক সহমর্মিতার উদাহরণ তৈরির এবং সংগে রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে ক্রমে বিভাজনের রেখাগুলি কমিয়ে আনা সম্ভব এবং পৃথিবীর মানুষগুলি সেই পথেই হাঁটছে । শেষ কথা বলে রাখি, মানুষের জার্নি থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় বৈশিষ্ট্য তার জেনেটিক্সে ধারিত থাকার ফলে মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন মানুষের ভেতর থেকে যাবে না, সামজিকভাবেও তা দৃশ্যমান হবে, তবে তা এতো কমে যাবে যে তা অবজ্ঞাযোগ্য হয়ে উঠবে এবং মানুষের পৃথিবী প্রকৃত সুন্দর হয়ে উঠবে ।তবে সত্যি হল এই যে অনাগত সমাজ এবং তার উপাদান মানুষ সম্পর্কে কোন ভবিষ্যৎবাণী করা যায় না । আমরা শুধু ইতিহাসের আলোকে ইঙ্গিত দিতে পারি । সেই ইঙ্গিত আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব এবং সামস্টিক কল্যাণের কথা চিন্তা মাথায় রেখে । আমাদের বিভাজনের সমস্ত দ্বন্দ্ব প্রকৃতির সংগে হোক- এই হচ্ছে আশাবাদ।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours