জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

একটি বিষয় যথেষ্ট ভাববার যে এত মানুষ এই এনকাউন্টারকে সমর্থন করছেন কেন।আমি করছি না কিন্তু বহু মানুষ করছেন।সোসাল মিডিয়া উপচে পড়ছে সমর্থনে।নারী পুরুষ শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে এটি করছেন।আমি সব বুঝি আর ওরা বোঝেন না বা আমি ঠিক আর ওরা বেঠিক-এ কথা ভাববার বা বলার মতো উন্নাসিক আমি নই।বিপরীত মতগুলিও ধৈর্য ধরে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন।
মূলত,দুটি কারণের কথা মনে হচ্ছে। একটি প্রত্যক্ষ কারণ। অপরটি পরোক্ষ ও মনস্তাত্বিক।

প্রত্যক্ষ কারণ হল, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা।আমাদের বিচারব্যবস্থা নানা কারণেই অত্যন্ত শ্লথ।পঞ্চাশ বছর ধরে চলা কেসের উদারহরণও অপ্রতুল নয়।একটি ধর্ষণের ক্ষেত্রে বা হত্যার ক্ষেত্রে তিন মাস বা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।বিচারকের সংখ্যা কম। পদ্ধতিগুলি বস্তাপচা। টেকনিকাল কারণে বছরের বছরের ঘোরে আর বিচারপ্রার্থী টেনিসবলের মতো ঘুরতে থাকে। পরিশেষে ঘটনা ও বিচারের সেই অভিঘাত আর থাকে না।Justice delayed justice denied.

প্রায় বছর কুড়ি বা তারও আগে সূভাষ ভৌমিকের ঘুষ নিতে গিয়ে হাতেনাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার খবর কাগজে পড়েছিলাম।উনি হাতেনাতে ধরা পড়েন। আজো সেই কেস চলছে।ষোলো সতের বছর পরে প্রথম রায় দান হয়। এর পর উচ্চতর কোর্ট বা হাইকোর্ট,তারপর ডিভিসন বেঞ্চ, অতঃপর সুপ্রিম কোর্ট এবং সেখানেও ডিভিসন বেঞ্চ।আমি নিশ্চিত যে সুভাষ ভৌমিক তার জীবদ্দশায় চূড়ান্তভাবে দোষী স্যব্যস্ত হয়ে শাস্তিভোগের সুযোগ পাবেন না।অন্তত তিরিশ বছর এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া যাবে।

ধর্ষণের ক্ষেত্রে অনেক ধর্ষিতার পক্ষেই ধর্ষকের বিরুদ্ধে বিশেষ করে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী ধর্ষকের বিরুদ্ধে এত দীর্ঘ লড়াই চালানোর মতো অর্থ ও মনের বা শরীরের জোর থাকে না।তারা অসহায়ভাবে লড়াই থামিয়ে দেয়। তাছাড়া অনেকসময় প্রভাবশালী ধর্ষক ভয় ও প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করে। ফলে বিচার গরীবের তামাসায় পরিণত হয়।

এমতাবস্থায়,মানুষ তার অভিজ্ঞতা থেকে দেখছে যে ধর্ষিতা বিচার পাচ্ছে না।কেন পাচ্ছে না-সেটি খতিয়ে দেখে সামগ্রিক বিচারব্যবস্থার আমূল সংস্কারে সরকারকে বাধ্য করার বদলে জনমত তাৎক্ষণিক ও হুজুগে প্রতিকার চাইছে।দশ বছর ধরে কেস চলার থেকে একবারে নিকেশ করাতেই তারা প্রতিকার হল বলে মনে করছেন। তাদের আবেগ অস্বাভাবিক নয়। তবে কাউকে ধরে চোর বলে নিশ্চিত না হয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা কোনও সুস্থ আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়।বরং এই আবেগে ভর করে সরকারকে বাধ্য করতে হবে বিচারব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতে।যাতে সমস্ত কেসই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করা যায়।মানুষ যদি দেখেন,নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ধর্ষণের মামলা বা ধর্ষণের মিথ্যা মামলার নিষ্পত্তি হয়ে অপরাধীর শাস্তি হচ্ছে তবেই এই মারণমুখী আবেগ নিয়ন্ত্রিত হবে।মাথা ঠান্ডা হলে ও সত্ত্বর সুবিচার পেলে মানুষ বুঝবে যে এনকাউন্টার একটি স্বৈরতান্ত্রিক গুন্ডামি,আজ মতের পক্ষে সেটি যত মিষ্টি লাগছে,বুমেরাং হয়ে নিশানা ঘুরে গেলেই সেটি অনেক বেশি তেতো লাগবে।এনকাউন্টার এক বেপরোয়া পুলিশরাজের পদধ্বনি।ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ বিষয়ে সকলকে সতর্ক করেছেন।

দ্বিতীয়ত,আমাদের অনেকের মধ্যেই(সকলের নয়) এক রিরংসা এবং কখনও ধর্ষকাম প্রবৃত্তি আছে।তুলনায় ভিন্ন অবস্থানে থাকা মানুষের পীড়ন ও অস্বস্তিতে আমরা সুখ পাই।লক্ষ্য করে দেখবেন,পাড়ায় বড়লোক বাড়িতে ডাকাতি হলে,ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের বাড়িতে ভিজিল্যান্স রেড হলে,সুদর্শন ছেলে ফেল করলে অথবা পরের ঘরের নারীপুরুষ কেচ্ছায় জড়ালে বা পরের ছেলে উচ্ছন্নে গেলে অনেকেই মনে মনে বেশ খুশী হন।ধর্ষণের বিরুদ্ধে পাঁচ কথা বলা সচেতন বোদ্ধা ধর্ষণের লাইভ ভাইরাল রগড়িয়ে উপভোগ করেন, বন্ধুমহলে শেয়ার করেন।একজন ধর্ষিতা হলে সেটি সব বয়সী আড্ডাতেই সেটি বেশ উপাদেয় চর্চা হয়ে ওঠে।

চোর ধরা পড়ে গণপিটুনি খেলে অনেক ছাপোষা ভদ্রলোককেও দেখবেন গিয়ে দুই ঘা দিয়ে আসতে। ওখানে দুই ঘা দিলে প্রত্যাঘাতের সম্ভাবনা নেই।তাই নিশ্চিন্তে মারা যায়।তার ওপর গণধোলাইতে কেস নেই।
আসলে মারার মধ্যে একটা সুখ আছে।সে মারা চোখ দিয়ে হতে পারে, চর্চা দিয়ে হতে পারে,ভাবনা দিয়ে হতে পারে আবার হাত দিয়েও হতে পারে।

তাই প্রত্যক্ষ একটি কারণকে আশ্রয় করে অনেক সময়েই অবচেতনের এই রিরংসা মাথা চাড়া দেয়।তবে সকলের ক্ষেত্রেই এটি সত্যি নয়।
গণতন্ত্রে ভিন্নমত সুস্থ ও স্বাভাবিক।তাই মতান্তর দোষের নয়। তবে উভয়পক্ষের যুক্তি থাকা বাঞ্ছনীয়।
পরিশেষে,সকল পুরুষ এবং নারীদের কাছেও আবেদন,পরস্পর পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করুন।এ ছাড়া পথ নেই বলেই নয়,এ ছাড়া পথ খোঁজার নয় বলেই।

নারীর মধ্যে যে গুণ আমি দেখেছি,যতটা শ্রদ্ধা তাদের অনেককেই করতে পেরেছি,কোনও পুরুষকে ততটা পারিনি।সারদা মায়ের মতন জননী,নিবেদিতার মতন ভগিনী আমাদের ঘরেই বিরাজ করেন।দেবী দুর্গা আর ঘরের মেয়ে উমা একাত্ম হন আমাদের একান্নবর্তী সংসারে।

নিজে ধর্ষিতা হয়ে ধর্ষকের জীবনের কথা ভেবে সমস্ত দায় নিজের ওপর নিয়ে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা করতেও দেখেছি নারীকে।পূজায়-প্রেমে-শ্রদ্ধায় সেই নারীর কাছেই আত্মসমর্পন করেছি বারংবার। (শেষ)
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours