রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

ছোট থেকে বনি বড্ড শাসনে মানুষ। একটু ভুল করলেই পিটিয়ে তক্তা করে ফেলতেন মা - বাবা। ছেলে যাতে বিগড়ে না যায় তার জন্য চালানো হত কড়া নজরদারি। বারো বছর বয়সে স্কুলের খাতায় বন্ধুদের মজা করে লেখা কিছু সংলাপ পাওয়া যায়। হাতের লেখা তার নয় বারবার বলা সত্ত্বেও সেদিন শোনেননি " শাসন দ্বারাই বাচ্চা মানুষ করা সম্ভব " ভেবে বসা অভিভাবক। তিনদিন আটকে রাখা হয়েছিল চিলেকোঠার ঘরের অন্ধকারে, বাচ্চার চিৎকার শুনেও অন্ধ হয়ে রইলেন তাঁরা।

এরপর থেকেই আস্তে আস্তে বদলে গেল বনি। প্রথমেই মেশা বন্ধ করে দিল বন্ধুদের সঙ্গে। একদিন ছাড়া হয়ে গেল স্কুলও। মা - বাবা খাবারে বিষ মিশিয়ে তাকে খুন করতে পারে, এই সন্দেহে খাওয়া - দাওয়া ত্যাগ করল সে। বয়স তখন পনেরো, উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করত অদৃশ্য কারোর নির্দেশ, বেড়ে গেল হিংস্রতা। একদিন বাবাকে সন্দেহের বশে বেধড়ক মারধর করল সে, উদ্বিগ্ন পরিবার হাত -পা বেঁধে ফেলে দিয়ে গেল অ্যাসাইলামে। " পাগল নিয়ে ঘর করা সম্ভব নয় " এই নীতি মেনে সরে দাঁড়ালেন আপনজনেরা, অ্যাসাইলামের চিকিৎসকগণ সর্বোতভাবে চেষ্টা করেও শেষরক্ষা করতে পারেননি। মারা যায় বনি যখন বয়স মাত্র ষোলো, অদৃশ্য কেউ তাকে নির্দেশ দিয়েছিল অ্যাসাইলামের ছাদ থেকে ঝাঁপাতে। তাদের বাড়িতে আজও শোনা যায় সন্তানহারা মায়ের হাহাকার, " হয়ত একটু কম শাসন করলেও হতো!"

বস্তির ছেলে রঘু, পেটে সবদিন ভাত না জুটলেও সঙ্গীদের বদান্যতায় নেশার সামগ্রী জুটে যেত ঠিকই। আজ ডেনড্রাইট, কাল পাউডার ; যখন যা জুটত টেনে ঝিম মেরে পড়ে থাকত খালপাড়ের শ্মশানে। গরীব বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, জারজ সন্তান বলে খোঁটা এমনকি ভুখা পেট ; কোনোকিছুই তাকে স্পর্শ করত না। তার জিগরি দোস্ত রবি বেশ কিছুদিন তার মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ করছিল। জিজ্ঞেস করে জানা যায়, পাউডার টানার পর হ্যালুসিনেশন হয় তার ; সে তখন সাঁতার কাটে এক সুন্দরীর কোলে। মুছে যায় সব অভাব, নিত্য সমাজের দাঁত খিঁচুনি।
টানা তিনবার অ্যাসাইলামে দেওয়ার পরেও পালিয়ে এসেছে রঘু। চুরিচামারি, পকেটমারি বাদ দেয়নি কিছুই নেশার সামগ্রী জোটাতে। চেপে ধরলে বলত, সেই সুন্দরীর নির্দেশ যেভাবেই হোক আসতে হবে তার কাছে। একটি অবাস্তব কল্পনাকে বাস্তব ভেবে জীবন কাটাচ্ছিল রঘু, ট্রেন থেকে পড়ে বডিটা দুইভাগে ভাগ হওয়ার আগে পর্যন্ত!
আপনারা মহেশ ভাটের " ওহহ লমহে " সিনেমাটি দেখেছেন? ছবিতে অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত যে চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন সেটি স্কিৎজোফ্রেনিক ছিল। সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছিল পরিস্থিতি ও আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলির বঞ্চনা - অত্যাচার - নির্দয়তা কিভাবে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে মানসিক রোগীতে পরিনত করতে পারে।
বিখ্যাত অভিনেতা আমির খানের ভাই স্কিৎজোফ্রেনিক ছিলেন, তাঁকে অমানবিকভাবে চারদেওয়ালের ভেতর বন্দী করে রেখেছিলেন স্বয়ং অভিনেতা ; মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। ঘটনাটি সামনে আসে এক নার্সের বয়ানে, যেখানে বলা হয়েছিল সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও বন্দীদশা কাটেনি তাঁর। কারণ আমীর খান মনে করেছিলেন, তাঁর ভাই তাঁর চেয়ে ভালো অভিনেতা! আমীর খান অবশ্য অস্বীকার করেছিলেন সবই,  কিন্তু তাতে বদলে যায়নি এক অকালমৃত স্কিৎজোফ্রেনিক যুবকের দূর্ভাগ্য। 

স্কিৎজোফ্রেনিয়া এমন একটি মানসিক রোগ যা আমাদের বাস্তব থেকে ধীরে ধীরে সম্পর্কমুক্ত করে ফেলে। রোগী সবসময় একটি ঘোরের মধ্যে থাকেন, সন্দেহ করতে শুরু করেন আশেপাশের মানুষদের। অবাস্তব কোনো গন্ধ পান, পান অদৃশ্য কারো নির্দেশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি দেখা যায়। 

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে পনের থেকে পঁয়ত্রিশ, এই বয়সের মানুষই বেশি আক্রান্ত হন এই রোগে। অত্যাধিক মানসিক চাপ, আঘাত,  নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা আর মাত্রাতিরিক্ত ডিপ্রেশন ডেকে আনে এই অসুস্থতা। রোগী ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন সমাজ ও পরিবার থেকে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগী সেরে উঠতে পারেন যদি সঠিক চিকিৎসা ও পরিবারের সাপোর্ট থাকে। একজন মানসিক রোগীর সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হয় নির্ভরতা ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। পরিবারের সহানুভূতি, স্নেহ ও সঠিক ওষুধ তাকে আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। দয়া করে রোগীকে দুমদাম বিয়ে দিয়ে বসবেন না। কারণ রোগ লুকিয়ে গড়ে তোলা একটি সম্পর্ক ও সেই সংক্রান্ত বিদ্বেষ ও নিরাপত্তাহীনতা একজন রোগীর অবস্থা আরো খারাপ করে তুলতে পারে। যদি কেউ সবটুকু জেনে দায়িত্ব নিতে সম্মত হন তবেই বিবাহের কথা ভাবা উচিত। ঠিক সেইরকম, অ্যাসাইলামে পৌঁছে হাত ধুয়ে ফেলাটাও মূর্খামি, আপনজনদের সহমর্মিতা ছাড়া শুধুমাত্র ওষুধ দিয়ে এই রোগের নিরাময় কার্যত অসম্ভব।

বাচ্চাকে অযথা শাসন করবেন না, চাপিয়ে দেবেন না নিজের সিদ্ধান্ত। তাকে তার মত বেড়ে উঠতে দিন, বন্ধু হিসাবে আগলে রাখুন। উৎপীড়ন দ্বারা মহৎ কার্য হয় না, ছেলে মানুষ তো একেবারেই হয় না। সবটুকুর মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখা চাই। মানসিক রোগী আপনার বোঝা নয়। তাকে দূরে না সরিয়ে কাছে রাখুন, দেখবেন সঠিক ওষুধ ও আপনার ভালোবাসায় সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। মনে রাখবেন, নির্ভরতা ও বিশ্বাসের চেয়ে বড় ওষুধ আজও এই পৃথিবীতে নেই।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours