রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

মহিন আপাতদৃষ্টিতে একজন সুস্থ, সবল, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন পুত্র, স্নেহশীল ভ্রাতা। একটি বিখ্যাত আইটি ফার্মে মোটা বেতনের চাকরী করা মহিনকে নিয়ে তার পরিবারের গর্বের শেষ নেই। যথাসময়ে সুন্দরী পাত্রী পছন্দ করে অনেকগুলি টাকা ও অন্যান্য সামগ্রী যৌতুক নিয়ে পুত্রবধূ ঘরে আনলেন তার মা। সমস্যাটা ধরা পড়ল ঠিক এইখানে।

বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই যৌনাঙ্গে অধিক রক্তক্ষরণ ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে অত্যন্ত সিরিয়াস কন্ডিশনে হাসপাতালে ভর্তি হলেন তার নববিবাহিতা স্ত্রী। যে ডাক্তার তাঁকে পরীক্ষা করেছিলেন প্রথমবার দেখার পর ভয়ে ঘেন্নায় বমি করে ফেলেছিলেন তিনি। মেয়েটির যৌনাঙ্গের পর্দাগুলি ক্ষতবিক্ষত ছিল, সারাশরীরে ছিল বেল্ট ও সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ। রক্তক্ষরণ এতটাই বেশি ছিল যে রোগীর জীবন বাঁচাতে ডাক্তাররা তাঁর ফ্যালোপিয়ান টিউব বাদ দিতে বাধ্য হন৷ প্রায় একমাস হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষেছিলেন ওই রোগিনী। সেইসময়ই কথায় কথায় ডাক্তাররা জানতে পারেন এক ভয়ঙ্কর সত্য।

মহিন আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক হলেও একজন ভয়ংকর যৌনাকাঙ্ক্ষী পুরুষ ছিল৷ প্রতিরাতে পর্ণ সাইটে দেখা বিডিএসএম ভিডিওগুলিতে যে অত্যাচার দেখানো হত সেগুলি সে প্রয়োগ করত করত তার স্ত্রীর ওপর। মারধর, সিগারেটের ছ্যাঁকা তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, যৌনাঙ্গের ছিদ্র বড় করার জন্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল মোমবাতি! শুধুমাত্র লিঙ্গদ্বারা মিলনই নয়, প্রকৃতপক্ষে স্ত্রীকে যৌনযন্ত্রণা দিয়ে তৃপ্তিলাভ করত মহিন। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করার পর জানা যায় আরেক ভয়ঙ্কর তথ্য। শিশুকালে তারই এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া দিনের পর দিন মলেস্ট করেছিলেন তাকে, মাকে বলেও কাজ হয়নি ; কারণ তিনি বিশ্বাস করেননি৷ এরপর থেকেই বদলে যায় মহিন, শুরু হয় বিডিএসএম পর্ণ দেখা। দশটাকা - কুড়িটাকা দিয়ে ফুটপাথের ডেনড্রাইটখেকো কন্যাশিশুদের ওপর আগে এই অত্যাচার চালাত সে, স্ত্রী নামক খেলনাটি হাতে আসার পরে প্রয়োগটি অতিমাত্রায় হয়ে গিয়েছিল আর কি!  মহিন এখন জেলবন্দী, সাথে চলছে তার মানসিক চিকিৎসা। 

গগন একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, বয়স সবে আঠারো। এগারো বছর বয়সে সে প্রথম নেশা ও হস্তমৈথুন করে, এখন সেটি মাত্রারিক্ত আকার ধারণ করেছে। কাজের শেষে বন্ধুদের সঙ্গে বসে একপেট নেশা না করলে মানসিক শান্তি পায়না সে। তার আরো একটি নেশা আছে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বাচ্চা মেয়েদের শিকার করা। নিজের তুখোড় কথা বলার স্টাইল, দুঃখী দুঃখী আচরণ ও বোকাসোকা চেহারা দিয়ে সে প্রথমে মেয়েদের মন জয় করে। শুরু হয় ফোন ও চ্যাটে সর্বক্ষণ কথা। বাচ্চা মেয়েটি তার ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করার পরেই শুরু হয় তার আসল খেলা। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে তার সঙ্গে সেক্স চ্যাটে বাধ্য করে মেয়েটিকে, এবং তার গোপনাঙ্গের ছবিও নেয় ছলে - কৌশলে। কিছুদিন পর থেকে মেয়েটিকে রগরগে খিস্তি ও বেশ্যা সম্বোধন সহযোগে নিজের বন্ধুদের সামনেই চলে তার ভার্চুয়াল বস্ত্রহরণ। শিকার মেয়েটি জাল কেটে বেরোবার জন্য ছটফট করতে থাকে, আর তার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে গগন ও তার বন্ধুদের মধ্যে শুরু হয় বিকৃত তৃপ্তিলাভ,  ঠিক যেমন পতঙ্গকে জালে জড়াবার পর তাকে খেলিয়ে খেলিয়ে মারে মাকড়সা! এক শিকারে বেশিদিন কাজ চলেনা তাদের, কিছুদিন পরপরই লাগে নতুন মেয়ে ; নতুন শিকার।
ওপরের ঘটনাগুলি চেনা চেনা লাগছে? আসলে এটিই হল বিকৃত যৌনবোধ বা হাইপার সেক্স অ্যাডিকশনের দুটি নমুনা। নির্ভয়া কাণ্ডের নাবালক ধর্ষকটির কাণ্ড মনে আছে? এরচেয়েও আরো ভয়ংকর উদাহরণ আছে, খোঁজ নিয়ে দেখুন অবশ্যই পাবেন। বিজ্ঞানীরা একে একধরনের মানসিক রোগ বলেছেন যা মেয়েদের ক্ষেত্রে নিম্ফোম্যানিয়া ও ছেলেদের ক্ষেত্রে স্যাটাফোরিয়াসিস নামে পরিচিত।  এটি আবার নানা মানসিক রোগের প্রাথমিক উপসর্গ হতে পারে। যেমন,  বাইপোলার ডিজর্ডার, সিজোএফেক্টিভ ডিজর্ডার, বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার ইত্যাদি। হরমোনের ভারসাম্যহীনতাও অনেকাংশে এরজন্য দায়ী। পার্কিনসন ডিজিজের নিরাময়ে যে ওষুধ প্রয়োগ করা হয় তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও এই রোগ হতে পারে। অনেক মানুষই শৈশবে যৌন উৎপীড়নের শিকার হন, যা তারা প্রকাশ করতে পারেন না। বড় হওয়ার পরে এটিও যৌন বিকৃতি বা সেক্সুয়াল ফেটিসিজমের কারণ হয়ে ওঠে।

এখনো আমাদের দেশে শুধু রোগী পরিবারই নয়, অনেক মুক্তচিন্তক এমনকি লেখকও যৌনবিকৃতিকে মানসিক রোগ বলে মানতে রাজি নন, তাঁদের কথায় এটি যৌন স্বাধীনতার নামান্তর। বিকৃত কথাটি সমাজের সৃষ্টি, ব্যক্তির ক্ষেত্রে এর সংজ্ঞা আলাদা হতে পারে। অনেক সাহিত্য ও জার্নাল রচিত হয়েছে এর সপক্ষে ও বিপক্ষে, কিন্তু সমাধানসূত্র আজও অধরা।

অত্যাচার কখনো স্বাধীন যৌনতার সংজ্ঞা হতে পারে না, যেখানে অপরের যন্ত্রণা একজনের যৌনতৃপ্তির সহায়ক৷ শিশুকালে অনেক পুরুষশিশু যৌন অত্যাচারের শিকার হয়। মা - কাকীমার বয়সী আত্মীয়ারা যখন তার ক্ষুদ্র যৌনাঙ্গ নিয়ে খেলাচ্ছলে মজা করে তখন শিশু মনে মনে অস্বস্তিবোধ করলেও কিছু বলতে পারেনা। বা বললেও তা পরিবারের মানুষজন মেনে ন্যান না৷ এরফলে ভেতরে লজ্জা ও অস্বস্তি পুষে বড় হয়ে ওঠা শিশু ভেতরে ফুঁসতে থাকে, বড় হয়ে বিকৃত যৌনমানসিকতার শিকার হয়৷

শিশুদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ মিশুন, তারা যেন নিজের সব সমস্যার কথা আপনাকে খুলে বলতে পারে। শিশুর যৌনাঙ্গ নিয়ে মজা করা আত্মীয়াদের থেকে তাকে দূরে রাখুন, পারলে তার সামনেই ওই আত্মীয়াদের কষে ধমকে দিন। বড় হওয়ার সাথে সাথে ছেলেমেয়েদের প্রকৃত যৌনশিক্ষা সম্পর্কে সচেতন করে তুলুন ও অবশ্যই শেখান আত্মরক্ষার কৌশল৷ ভারী গুরুজন না হয়ে প্রকৃত আপনজন হয়ে উঠুন, যাতে শিশু সবকথা আপনাকে খুলে বলতে সংকোচবোধ না করে। দরকার হলে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়ান, কাউন্সিলিং করান।

ধর্ষকাম সহ্য করবেন না, আশেপাশে এমন ঘটছে দেখলে প্রতিবাদ করুন । সে আপনার যত ভালোবাসারই মানুষ হোক, তার মধ্যে বিকৃত যৌনতার বিন্দুমাত্র সন্ধান পেলে হয় তাকে কাউন্সিলিং করান, নয়ত প্রতিবাদ করুন৷ চুপ থাকবেন না, সহ্য করবেন না। এদের ভেতরেই কখনো কখনো ধর্ষক লুকিয়ে থাকে।।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours