সন্দীপ চক্রবর্তী, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:
ভারতীয় রাজনীতি নিয়ে অনেকে অনেকরকম প্রশ্ন করেন। কিন্তু একটা প্রশ্ন কখনও কাউকে করতে শুনিনি। রাষ্টের কাছে তার নাগরিকের প্রাথমিক পরিচয় কী হওয়া উচিত? ভোটার নাকি মানুষ? একজন নাগরিক ভোট দেন বলেই কি রাষ্ট্র তার কল্যাণের কথা চিন্তা করে? এই প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যা হয় তাহলে বলাই বাহুল্য, এর থেকে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না। আবার এটাও ঠিক, স্বাধীন ভারতবর্ষে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের সম্পর্ক ভোটাধিকার এবং ক্ষমতায়নের মতো দুটি মেঠো বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে আসছে। ভোটার-কাম-নাগরিকের রাজনৈতিক শিক্ষা এখানে জরুরি নয়। বরং তিনি যত অশিক্ষিত হবেন ততই রাজনৈতিক দলগুলোর লাভ। জাতপাত এবং উপাসনা পদ্ধতি-নির্ভর ধর্মপরিচয় ভাঙিয়ে রাজনীতি করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া তাতে অনেক সহজ। উদাহরণ অনেকই দেওয়া যায়। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ মেনে নেওয়া থেকে শুরু করে একেবারে হালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের উন্মত্ত বিরোধিতা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেশের মানুষকে স্রেফ ভোটার বা নিদেন ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে দেখার নেতিবাচক প্রবণতা সহজেই চোখে পড়ে।
এ দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে মুসলমান সম্প্রদায় এবং তপশিলি জাতি জনজাতি ও বনবাসী সমাজ দাবার বোড়ে। দেশের যেখানেই নির্বাচন হোক না কেন, প্রথমেই এই দুটি ভোটব্যাঙ্কের ওপর সবার নজর পড়ে। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ এবং বাম-প্রগতিশীল শিবিরের। কারণ এরা রাজনৈতিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। প্রথাগত শিক্ষার হালও বেশ খারাপ। সংরক্ষণের আওতায় থেকেও বেশিরভাগ অর্ধশিক্ষিত, কেউ কেউ নিরক্ষরও। সুতরাং হাতে গরম কিছু দিয়ে এবং নিরন্তর ভুল বুঝিয়ে এদের মহামূল্যবান ভোটটি আদায় করে নেওয়া খুব সহজেই সম্ভব। তপশিলি জাতি এবং জনজাতিগুলির সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার সময় বাবাসাহেব আম্বেদকর বলেছিলেন, দশ বছর পর পরিস্থিতি বিচার করে কেন্দ্র এই ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিতে পারে। কিন্তু ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণে কংগ্রেস তা করেনি। যার ফল হয়েছে সাংঘাতিক। আমলাতন্ত্রের গেরোয় কিংবা শাসকের ছক অনুসারে সংরক্ষণের সুবিধা তপশিলি জাতি ও জনজাতি সমাজের সর্বত্র পৌছয়নি। কেউ কেউ লেখাপড়া শিখে সরকারি চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু আর্থিক সাচ্ছল্য অর্জন করার পরেও সংরক্ষণের সুবিধা ছাড়েননি। অর্থাৎ তপশিলি জাতিভুক্ত আইএএস অফিসারের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেও সংরক্ষণের আওতায় থেকে গেছেন। অন্যদিকে ওই জাতিগোষ্ঠীর বৃহত্তর সমাজ থেকে গেছে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার অন্ধকারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এরকম কেন হল? স্বাধীনতার পর গত সত্তর বছরে কোনও সরকার কি এইসব জাতিগোষ্ঠীর অন্ন বস্ত্র বাসস্থান এবং শিক্ষার মতো মৌলিক দাবি পূরণ করতে পারত না? নিশ্চয়ই পারত। কিন্তু সেই চেষ্টাই কেউ কখনও করেনি। কারণ মৌলিক দাবি পূরণ হয়ে গেলে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থাকত না। আর সংরক্ষণ না থাকলে জাতপাতের রাজনীতি করে দশকের পর দশক ক্ষমতায় থাকা যেত না।
রাজনীতির দশচক্রে পড়ে মুসলমানরাও আগে ভোটার তারপর মানুষ। তাদের নিয়ে সারা বছর তোষণের রাজনীতি হয়। ইফতার পার্টিতে কে মাথায় হিজাব পরবেন আর কে কে ফেজ টুপি পরবেন তাই নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। কিন্তু উন্নয়নের কথা কেউ বলেন না। বাম আমলে সাচার কমিটির রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অবস্থা সব থেকে খারাপ। গত আট বছরেও এ রাজ্যের মুসলমানদের অবস্থার বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি। এখনও তাদের একটা বড়ো অংশ গোরু পাচার, হিউম্যান ট্র্যাফিকিং এবং জালনোটের কারবারের সঙ্গে যুক্ত। অনেকে আবার সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের আড়কাঠি কিংবা অপারেটর হয়ে যান। তথ্য আদানপ্রদান এবং লোক ভাড়া করার বিনিময়ে হাতে বিস্তর টাকা আসে। শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণেই যে তারা জঙ্গিদলে নাম লেখান তা নয়। অভাবও মস্ত বড়ো একটা কারণ। কিন্তু এই অভাব যাদের দূর করার কথা তারা কথা রাখেননি। তারা জানেন মুসলমান সমাজে ধর্মের থেকে ধর্মতন্ত্র বড়ো। এখানে ইমাম-মৌলবিদের কথাই শেষ কথা। তারাই বলে দেন কাকে ভোট দিতে হবে আর কাকে দেওয়া চলবে না। সমাজও তাদের কথা বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়। সুতরাং সাধারণ মুসলমানকে দেখার দরকার নেই। ইমাম-মৌলবিদের দুধেভাতে রাখলেই হল। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে ইমাম ভাতা মোয়াজ্জেম ভাতা চালু করা হয়েছে। অর্থাৎ নিয়মিত ঘুষ দেওয়া হচ্ছে। অথচ মুসলমানকে মানুষের মর্যাদা দিলে এসবের দরকারই হত না। সহজেই তাদের দেশের সংস্কৃতিতে আস্থাবান করা যেত। তারা জাতীয় সংহতির মজবুত স্তম্ভ হতে পারতেন। সব থেকে বড়ো কথা, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য যদি মুসলমান সমাজকে দূরে সরিয়ে রাখা না হত, যদি তাদের ভারতের মূলধারার সমাজকাঠামোর অঙ্গ করে তোলা যেত তা হলে প্রতিবেশী ইসলামিক দেশের শত প্ররোচনাতেও তারা ফাদে পা দিতেন না। কিন্তু তা বললে কি চলে? দেশে প্রকৃত অর্থে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি হলে মুসলমানদের নিয়ে রাজনীতি কীভাবে হবে? আর জাতপাত-ধর্মের রাজনীতি না থাকলে পারিবারিক শাসনের দিনও যে শেষ হয়ে যাবে।
সুতরাং যেমন চলছে চলুক। ভারতীয় রাজনীতিতে মানুষ না থাকলেও চলবে। ভোটার থাকলেই হল। কারণ রাষ্টের সঙ্গে ভোটারের সম্পর্ক দেনাপাওনার। পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসার নয়। কেউ কাউকে সম্মান করে না। নগদ ছাড়া কেউ কারও কাছে কিছু প্রত্যাশাও করে না। ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের সম্পর্ক এরকম ছিল। সত্তর বছর হয়ে গেল ভারত স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু এ দেশের জাতীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে সেই ঔপনিবেশিক মনন এখনও রয়ে গেছে।
ভারতীয় রাজনীতি নিয়ে অনেকে অনেকরকম প্রশ্ন করেন। কিন্তু একটা প্রশ্ন কখনও কাউকে করতে শুনিনি। রাষ্টের কাছে তার নাগরিকের প্রাথমিক পরিচয় কী হওয়া উচিত? ভোটার নাকি মানুষ? একজন নাগরিক ভোট দেন বলেই কি রাষ্ট্র তার কল্যাণের কথা চিন্তা করে? এই প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যা হয় তাহলে বলাই বাহুল্য, এর থেকে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না। আবার এটাও ঠিক, স্বাধীন ভারতবর্ষে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের সম্পর্ক ভোটাধিকার এবং ক্ষমতায়নের মতো দুটি মেঠো বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে আসছে। ভোটার-কাম-নাগরিকের রাজনৈতিক শিক্ষা এখানে জরুরি নয়। বরং তিনি যত অশিক্ষিত হবেন ততই রাজনৈতিক দলগুলোর লাভ। জাতপাত এবং উপাসনা পদ্ধতি-নির্ভর ধর্মপরিচয় ভাঙিয়ে রাজনীতি করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া তাতে অনেক সহজ। উদাহরণ অনেকই দেওয়া যায়। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ মেনে নেওয়া থেকে শুরু করে একেবারে হালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের উন্মত্ত বিরোধিতা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেশের মানুষকে স্রেফ ভোটার বা নিদেন ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে দেখার নেতিবাচক প্রবণতা সহজেই চোখে পড়ে।
এ দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে মুসলমান সম্প্রদায় এবং তপশিলি জাতি জনজাতি ও বনবাসী সমাজ দাবার বোড়ে। দেশের যেখানেই নির্বাচন হোক না কেন, প্রথমেই এই দুটি ভোটব্যাঙ্কের ওপর সবার নজর পড়ে। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ এবং বাম-প্রগতিশীল শিবিরের। কারণ এরা রাজনৈতিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। প্রথাগত শিক্ষার হালও বেশ খারাপ। সংরক্ষণের আওতায় থেকেও বেশিরভাগ অর্ধশিক্ষিত, কেউ কেউ নিরক্ষরও। সুতরাং হাতে গরম কিছু দিয়ে এবং নিরন্তর ভুল বুঝিয়ে এদের মহামূল্যবান ভোটটি আদায় করে নেওয়া খুব সহজেই সম্ভব। তপশিলি জাতি এবং জনজাতিগুলির সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার সময় বাবাসাহেব আম্বেদকর বলেছিলেন, দশ বছর পর পরিস্থিতি বিচার করে কেন্দ্র এই ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিতে পারে। কিন্তু ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণে কংগ্রেস তা করেনি। যার ফল হয়েছে সাংঘাতিক। আমলাতন্ত্রের গেরোয় কিংবা শাসকের ছক অনুসারে সংরক্ষণের সুবিধা তপশিলি জাতি ও জনজাতি সমাজের সর্বত্র পৌছয়নি। কেউ কেউ লেখাপড়া শিখে সরকারি চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু আর্থিক সাচ্ছল্য অর্জন করার পরেও সংরক্ষণের সুবিধা ছাড়েননি। অর্থাৎ তপশিলি জাতিভুক্ত আইএএস অফিসারের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেও সংরক্ষণের আওতায় থেকে গেছেন। অন্যদিকে ওই জাতিগোষ্ঠীর বৃহত্তর সমাজ থেকে গেছে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার অন্ধকারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এরকম কেন হল? স্বাধীনতার পর গত সত্তর বছরে কোনও সরকার কি এইসব জাতিগোষ্ঠীর অন্ন বস্ত্র বাসস্থান এবং শিক্ষার মতো মৌলিক দাবি পূরণ করতে পারত না? নিশ্চয়ই পারত। কিন্তু সেই চেষ্টাই কেউ কখনও করেনি। কারণ মৌলিক দাবি পূরণ হয়ে গেলে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থাকত না। আর সংরক্ষণ না থাকলে জাতপাতের রাজনীতি করে দশকের পর দশক ক্ষমতায় থাকা যেত না।
রাজনীতির দশচক্রে পড়ে মুসলমানরাও আগে ভোটার তারপর মানুষ। তাদের নিয়ে সারা বছর তোষণের রাজনীতি হয়। ইফতার পার্টিতে কে মাথায় হিজাব পরবেন আর কে কে ফেজ টুপি পরবেন তাই নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। কিন্তু উন্নয়নের কথা কেউ বলেন না। বাম আমলে সাচার কমিটির রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অবস্থা সব থেকে খারাপ। গত আট বছরেও এ রাজ্যের মুসলমানদের অবস্থার বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি। এখনও তাদের একটা বড়ো অংশ গোরু পাচার, হিউম্যান ট্র্যাফিকিং এবং জালনোটের কারবারের সঙ্গে যুক্ত। অনেকে আবার সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের আড়কাঠি কিংবা অপারেটর হয়ে যান। তথ্য আদানপ্রদান এবং লোক ভাড়া করার বিনিময়ে হাতে বিস্তর টাকা আসে। শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণেই যে তারা জঙ্গিদলে নাম লেখান তা নয়। অভাবও মস্ত বড়ো একটা কারণ। কিন্তু এই অভাব যাদের দূর করার কথা তারা কথা রাখেননি। তারা জানেন মুসলমান সমাজে ধর্মের থেকে ধর্মতন্ত্র বড়ো। এখানে ইমাম-মৌলবিদের কথাই শেষ কথা। তারাই বলে দেন কাকে ভোট দিতে হবে আর কাকে দেওয়া চলবে না। সমাজও তাদের কথা বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়। সুতরাং সাধারণ মুসলমানকে দেখার দরকার নেই। ইমাম-মৌলবিদের দুধেভাতে রাখলেই হল। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে ইমাম ভাতা মোয়াজ্জেম ভাতা চালু করা হয়েছে। অর্থাৎ নিয়মিত ঘুষ দেওয়া হচ্ছে। অথচ মুসলমানকে মানুষের মর্যাদা দিলে এসবের দরকারই হত না। সহজেই তাদের দেশের সংস্কৃতিতে আস্থাবান করা যেত। তারা জাতীয় সংহতির মজবুত স্তম্ভ হতে পারতেন। সব থেকে বড়ো কথা, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য যদি মুসলমান সমাজকে দূরে সরিয়ে রাখা না হত, যদি তাদের ভারতের মূলধারার সমাজকাঠামোর অঙ্গ করে তোলা যেত তা হলে প্রতিবেশী ইসলামিক দেশের শত প্ররোচনাতেও তারা ফাদে পা দিতেন না। কিন্তু তা বললে কি চলে? দেশে প্রকৃত অর্থে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি হলে মুসলমানদের নিয়ে রাজনীতি কীভাবে হবে? আর জাতপাত-ধর্মের রাজনীতি না থাকলে পারিবারিক শাসনের দিনও যে শেষ হয়ে যাবে।
সুতরাং যেমন চলছে চলুক। ভারতীয় রাজনীতিতে মানুষ না থাকলেও চলবে। ভোটার থাকলেই হল। কারণ রাষ্টের সঙ্গে ভোটারের সম্পর্ক দেনাপাওনার। পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসার নয়। কেউ কাউকে সম্মান করে না। নগদ ছাড়া কেউ কারও কাছে কিছু প্রত্যাশাও করে না। ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের সম্পর্ক এরকম ছিল। সত্তর বছর হয়ে গেল ভারত স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু এ দেশের জাতীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে সেই ঔপনিবেশিক মনন এখনও রয়ে গেছে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours