নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:

উপনিষদের সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা বলেছেন -“এই জগৎ মৃত্যুহীন। শাশ্বত সত্তার আনন্দ সম্মেলনের মহাপ্রকাশ। বিশ্বসৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ কিংবা অদৃশ্য হিসেবে যা কিছু বিরাজিত, সবই সেই চিরসুন্দর, চিরশুদ্ধ অমরনাথের আনন্দময় অভিব্যক্তি। বিশ্বের সকল সৌন্দর্য, পার্থিব জগতের সমস্ত সঞ্চিত সুধা তাঁর থেকে সৃষ্ট বলেই অবিনাশী। অনাদিকাল ধরে তিনিই নানা রূপে বিকশিত। বিশ্বের জীবনপ্রবাহ তাই মৃত্যুহীন। হে অমৃতের অমর সন্তান, এই পরম সত্য জ্ঞাত হয়ে তুমি অমৃততত্ত্ব লাভ করো”

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই

আমাদের বিশ্বকবি "রবীন্দ্রনাথের ‘- মৃত্যু ভাবনা’ জীবনের আরেক নাম। জন্মজন্মান্তরের যাত্রাপথে পরমাত্মীয়ের মতো নতুন নতুন জীবনপথের অনুসন্ধান দান করে সে। মরণ কখনো তাই মহাকালের মিলনদূত। কবির মানস-সরোবরে অনুভূতির বর্ণচ্ছটায় রহস্যময় আবরণ পরে বিশেষকে ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে নির্বিশেষ। আবার পরক্ষণেই নির্বিশেষ থেকে বিশেষের স্তরে নেমে এসে ব্যক্তিসত্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে প্রণয়িনী রাধিকার শ্যামকৃষ্ণ হয়ে।
বিশ্বকবির রচনায় রবার্ট ব্রাউনিং-এর দার্শনিকতা,  কোলরিজ, বাইরনের জীবনমুখী বাস্তবতা, জন কীটসের অনিঃশেষ সৌন্দর্যচেতনা, ওয়ার্ডসোয়ার্থের পরিশুদ্ধ প্রকৃতি প্রেম এবং পার্সি বিশি শেলীর অতীন্দ্রিয় রহস্যময়তার অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তাঁর রচনা শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও অনন্য সম্পদ। বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের অতুল্য প্রতিনিধিত্ব রবীন্দ্রনাথই করেছেন।  প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংযোগ তাঁর রচনায় এমন একটি রোমান্টিকতার আবহ নির্মাণ করেছে, যার ভিত্তি প্রস্তুত হয়েছে জীবন সম্বন্ধে কবির সুগভীর ধারণা এবং বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধির প্রগাঢ়তা থেকে।
কবির মৃত্যু ভাবনা প্রসঙ্গেও এই মন্তব্য সত্য। মরণকেও তিনি উদঘাটিত করেছেন বিচিত্র রূপে-রসে। উপলব্ধির নতুন নতুন পর্যায় অতিক্রম করে।
নব নব জীবনের গন্ধ যাব রেখে
নব নব বিকাশের বর্ণ যাব এঁকে।
কে চাহে সংকীর্ণ অন্ধ কূপে
এক ধরাতল মাঝে শুধু এক রূপে
বাঁচিয়া থাকিতে!
যখন ব্যক্তিগত জীবনে স্বজন হারানোর ব্যথা শোকের আবর্তে তাঁকে মথিত করেছে, তখন কোলরিজ, বাইরনের জীবনমুখী বাস্তবতা প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে তাঁর চেতনায়। জীবনের সুধাপাত্র নিঃশেষ করে রিক্ততার অপার বেদনায় মৃত্যু তখন ধরা দিয়েছে নিষ্ঠুর নির্লিপ্ত বৈরাগীর বেশে। আবার কীটসের মতো সৌন্দর্যচেতনা অপরূপ প্লাবন তুলেছে মৃত্যু সম্পর্কে কবির উপলব্ধিতে। শেলীর কাছে রহস্যময়তাই যেমন জীবনের নতুন প্রেরণা হয়েছে বারবার, বিশ্বকবিও তেমনি মৃত্যুর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন নব নব জীবনের সন্ধান। ওয়ার্ডসোয়ার্থের প্রকৃতিপ্রেম মৃত্যুর সঙ্গে একাকার হয়েই রবীন্দ্রনাথের রচনায় অবগুণ্ঠণ খুলেছে জীবন-প্রণয়ীর মতো।  আবার পরক্ষণে দেখা যাচ্ছে - দার্শনিক ব্রাউনিং-এর জীবন গভীরতার সুর সেখানে ধ্বনিত হচ্ছে বৈচিত্র্যের হাতছানিতে।” মৃত্যু ভাবনা নিয়ে অনেক লেখাই পড়ি , পড়তে পড়তে নিজের মাঝে একটা উপলব্ধি হয় বটে ।
যেমন -আমার ইংরেজি ভাষায় দখলটা পোক্ত নয় বলে মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে একটা দৈন্য অনুভব করি , কিন্তু প্রকৃতির ভারসাম্য অপার , আমি যে দেশে বাস করছি সেখানে ইংরেজি ভাষার দখল ... পাখিরাও গান গায় ইংলিশে ঝিঁ ঝিঁ ডাকে ইংলিশে ,মৌমাছি গুন গুন করে ইংলিশে, এরা সব্বাই আমাকে ইংরেজি লিরিক কানে ভরে দেয় বলে মাতো মাতো আমাদের মত কথা বলো গান গাও কবিতা লিখো!
এতো কিছুর মধ্যে হঠাৎ আমার চেতনায় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল কয়েকটা শব্দ , আমার এত দিনের শোনা শব্দ সমস্ত অভিজ্ঞতা দেখা ও দর্শন  ঘন হয়ে এসে রূপ নিলো কবিতার লাইনে। জানি না যে কথা বলতে চাই লিখতে চাই তা লিখা হবে কিনা , হয়ত হবে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর , হয়ত অন্তিমে গিয়ে লিখতে পারবো গোটা কতক লাইন , জানি কবিতা শুধু আবেগ জাগানো নয় , কবিতা হলো অভিজ্ঞতা।
একটি কবিতা লিখবার জন্য কত কষ্ট পেতে হয়, কত ব্যথা বইতে হয় , কত কত শহর , কত কত মানুষ , কত বস্তু জানতে হয় , কত জীবের কর্ম , কত ফুল ফোটা ঝরে যাওয়া , পাখির উড়াল , নদীর বাঁক , সাগরের ঢেউ গুনতে হয় , কত কত অবহেলা অনাদর , কত কত প্রত্যাখ্যান কত কত সমবেদনা , সয়ে  তার হয়ত লেখা হয় কয়েকটি মহত কবিতা ।
প্রকৃতি দেয় মহত কবিতা লিখবার প্রসাদ । তখন কবি নিজেকে বোঝাতে পারে ' আমি ন্যূনতম  মানুষ নই , যারা আমাকে অবহেলা করে তাদের থেকে নিচু নই । একটা পৃথিবী গড়ে তোলেন কবি , আমাদের অজ্ঞাতেই আমরা এগিয়ে যাই তার দিকে । বলেছিলেন স্টিভেন্স তাঁর "The Necessary Angel "কবি  বলেছিলেন আমাদের ভেতরকার এই পৃথিবী যদি না থাকতো , তবে মিথ্যে হয়ে যেত আমাদের চারদিকে বাইরের এই পৃথিবী , আরো বলেছিলেন ঈশ্বরে বিশ্বাস ছেড়ে দেবার পর  মানুষ তার মুক্তি খুঁজে পায় কবিতার সারাৎসারে। কবি তখন হয়ে উঠেন অদৃশ্যের যাজক । মাল্টে, রিলকে ওয়ালেস স্টিভেন্স রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাদের কবিতা নিয়ে তুলনামূলক কিছু লিখবার জন্য একটা সাবজেক্ট মাথায় কুলবুল করছে বহুদিন ধরে , সময়ের অভাবে লিখতে পারছি না বলে মাঝে মাঝে মাথায় ঘুরপাক খেয়েই চলেছে , মনে হয় আর তো ভেতরে রাখতে পারছি না, বাইরে বেরোবার পথ খুঁজছে।
এই জীবন এবং জীবনব্যপী কর্ম এবং মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা যাকে দেবদূত বলে আহ্বান হয় কবিতার ভাষায় , শুধু স্টিভেন্স ,রবীন্দ্রনাথ ,মাল্টে , রিলকে নয় আমরা লালন , শাহ আব্দুল করিম , কিংবা হাসনরাজার গানেও দেবদূতের আহ্বান পেয়ে থাকি । জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সবাই যেন কার অপেক্ষায় বসে থাকি , স্টিভেন্স ভিন্ন দেশে বসে লিখেছেন এক দেব দূতের কথা যিনি এসে বলবেন 'I am the angel of reality ' স্বাগতম টাঙানো আছে যে দরজায় সেখানে এসে কি পৌছাবে না কেউ?
মূহুর্তের জন্য দেখা যায় এই angel কে তারপর আবার উধাও , সব শূন্য , - আমারই দেখায় তুমি দেখো , আমারই শোনাই তুমি শোন বলেন সে দেবদূত । বড় ক্ষণিক তাঁর অস্তিত্ব , মনের খোলা দরজার সামনে অল্প সময়ের জন্যই এসে দাঁড়ান, 'seen for a moment standing in the door!' এই লাইন গুলোর মধ্যে একটা অপেক্ষা পাই , কিংবা চলাচলের এই ছবিতে আমরা রবীন্দ্রনাথের লাইন গুলো মনে করতে পারি - চকিতে চলে যাওয়া তাঁর রাজার দুলালের কথা , তাঁর খেয়া বা গীতাঞ্জলির কোনও কোনও কবিতা । আক্ষরিক না হলেও প্রতীকের তাৎপর্য আছে , মাঝে মাঝে তব দেখা পাই , চিরদিন কেন পাই না ... তেমন কিছু প্রতিকী শব্দ পাই লালনের গানে , লালন রিলকে রবীন্দ্রনাথ বা স্টিভেন্স এই সব ছবির মধ্য দিয়ে আমাদের পৌঁছে দিতে চান এক অন্তর্গত সত্যের ধারণায় ।
আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি আমাদের প্রকৃতিতে ; আমাদের আকাঙ্খা যোগ্যতা আমাদের ভাবনা আর কাজ আমাদের আদর্শ আর বাস্তব মিলতে চায় না কোনো সামঞ্জস্যে। কিন্তু কোন এক শক্তি নেই বা মুহুর্ত মধ্যে দৃশ্যে- অদৃশ্যে ভিন্নতা লোপ করে দিতে পারে , দৃশ্যের মধ্যে এনে দিতে পারে অদৃশ্যের দ্যুতি।  দৃশ্য জগৎকেই আমরা একান্ত সত্য ভেবে জড়িয়ে থাকতে চাই বলে , এই দৃশ্যাতীতের আহ্বান কাঁপিয়ে তোলে না আমাদের , সহজে আমরা সইতে পারি না তার আর্বিভাব ।
রিলকে বলেছেন ..আমরা কেবল আমাদের প্রস্তুত করে রাখতে পারি , বহু যত্ন করে ধুয়ে মুছে রাখতে পারি , মনের মাঝখানে একখানা ঘর , যাতে অপচীয়মান মুহুর্তের মধ্যে হঠাৎ কখনো ছুঁয়ে যেতে পারি অন্তহীনকে ।
রিলকের মতে এই প্রস্তুতিই হলো ভালোবাসা , এই প্রস্তুতিই হয়ে - ওঠা। দৃশ্য আর অদৃশ্যের এই ভাবনাই অনিবার্য ভাবে আমাদের পৌঁছে দেয় জীবন আর মৃত্যুর ভাবনায় ।
এই সব কবিদের কবিতা ভাবনায় দর্শনে আমি চিন্তার খেই হয়ত মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলেছি অনেক খানে কিন্তু ঘুড়ি কাটা সুতো আবার আঙুলে জড়িয়ে তাদের ভাবনায় জুড়েছি নিজেকে ।
এই যে আমরা সাধারণ মানুষ দুই বাধা বন্ধন হারা  দেশের অধিবাসী , আসলে কি এপার বলে কিছু আছে ? ওপার বলে কিছু আছে ? মৃত্যু হলো  জীবনের চলমান এক স্তর , সেভাবে দেখলে বুঝলে , মানুষ তার মৃত্যুর অভিজ্ঞতাকে নিজেরই অন্তর্গত বলে জানতে পারে একদিন। পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের কথায় বলি -রবীন্দ্রনাথও জীবনের প্রথম প্রভাতে মৃত্যুকে অমৃতের স্বরূপ হিসেবেই আহ্বান করেছিলেন- ‘
মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।
মেঘবরন তুঝ, মেঘজটাজূট
রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু অমৃত করে দান।

(তথ্যসুত্র - নেট থেকে বিভিন্ন ফিচার পড়ে)




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours