কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

"তুম  ইতনা জো মুসকুরা রহে হো
কেয়া গম হ্যায় জিসকো ছুপা রহে হো!"
হাসছে হায়দরাবাদ। অট্টহাসি গোটা ভারতের।

হাসিতে চাপা পড়ে গেলো হতাশা।  হতাশা কাজির বিচারে। হতাশা দেশের আইনি প্রক্রিয়ায়। আদালতে। হতাশা না বলে ক্ষোভও বলা যায়। দেশের আইনি ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতায় শুধুই বিরক্ত নয়, ভরসা হারিয়েছে সভ্য সমাজ। তাই পুলিস এনকাউন্টারে প্রিয়াঙ্কা রেড্ডির ধর্ষক, খুনীদের মারা যাওয়ায় খুশি মানুষ। মানুষ চায় অপরাধীর শাস্তি। শাস্তি কোন পথে এলো তা বোঝার তাৎক্ষণিক অবকাশ থাকে না মানুষের সামনে। তাই আদালতের প্রাণদণ্ডের রায়ে অপরাধীর মৃত্যু না হয়ে, পুলিসের গুলিতে হলেও মানুষ স্বস্তি পায়। শুক্রবার সকালে সেই স্বস্তির ছবিটাই দেখলো গোটা দেশ।

বাঁধ ভাঙা খুশিতে জয়জয়কার তেলেঙ্গানা পুলিসের। মাত্র দশ দিনের ফারাকে ভিলেন থেকে ভগবান হয়ে গেল তেলেঙ্গানা পুলিস। যে পুলিস ২৬ নভেম্বর রাতে হাসাহাসি করেছিল প্রিয়াঙ্কার ঘরে না ফেরার খবর শুনে। প্রিয়াঙ্কার বাবাকে বলেছিল, দেখুন মেয়ে পালিয়ে গেছে কিনা। পরদিন সকালেই পশু চিকিৎসক তরুনী, সেই ঘরে না ফেরা মেয়েটার খোঁজ পেয়েছিল পুলিস। সে পালায়নি। তাঁর জ্বলন্ত দেহটা পড়ে ছিল রাস্তায়। গণধর্ষণের পর পেট্রোল ঢেলে প্রমাণ লোপ করতে চেয়েছিল চার ধর্ষক। নৃশংসতার নারকীয় দৃষ্টান্ত।

সাতাশ নভেম্বর ভোরে সে খবর ছড়িয়ে পড়তেই পুলিসের ভূমিকায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। তোলপাড় সারা দেশ। কোণঠাসা তেলেঙ্গানা রাজ্য পুলিস। কোণঠাসা তেলেঙ্গানা সরকার। ক্ষোভের আগুনে পড়েছিলেন তেলেঙ্গানা মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও। প্রশ্নের পর প্রশ্ন ওঠে তাঁর নির্লিপ্ততা নিয়ে। প্রিয়াঙ্কার শোকগ্রস্ত মা- বাবার পাশে না দাঁড়িয়ে বিয়েবাড়ির আমন্ত্রণে যোগ দিতে ছোটার জন্য, সংবাদমাধ্যমেও তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন রাও।

৬ ডিসেম্বর সকালে ছবিটা উল্টে গেল। মাত্র একটি ঘটনায় 'ড্যামেজ রিপেয়ারিং' হয়ে গেল তেলেঙ্গানা পুলিস আর তেলেঙ্গানা সরকারের। একদিকে জয়জয়কার তেলেঙ্গানা পুলিসের। অন্যদিকে রাজ্যবাসীর প্রশংসায় ভেসে গেলেন তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী। আরও একবার মসৃণ হলো তার রাজপাট। মোট একশো উন্নিশ আসনের রাজ্য বিধানসভায় কে চন্দ্রশেখরের দল তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি একাই দখল করেছিল অষ্টআশিটা। রাও ফিরে পেলেন তাঁর খোয়াতে বসা সেই জনপ্রিয়তাও। 

প্রিয়াঙ্কাধর্ষণ এবং খুনের পরদিনই তাঁর দেহ উদ্ধার করেছিল পুলিস। আর তার ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পরেই চার ধর্ষককে পাকড়াও করেছিল পুলিস। বৃহস্পতিবার রাতে প্রিয়াঙ্কা হত্যাকান্ডের পুনর্নিমাণ করতে প্রথমে চার ধর্ষককে ৪৪ নাম্বার জাতীয় সড়কের ওপর সেই টোলপ্লাজায় নিয়ে যায় পুলিস। সেখান থেকে ধর্ষকদের নিয়ে যাওয়া হয় আন্ডারপাসের সেই জায়গায়, যেখানে ধর্ষকরা পুড়িয়ে মেরেছিল প্রিয়াঙ্কাকে। ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা চল্লিশ। আচমকাই চার ধর্ষক তাদের ওপর হামলা করে বসে বলে পুলিসের অভিযোগ। নেহাত বাধ্য হয়েই, তাঁরা গুলি চালাতে বাধ্য হয় বলে পুলিসের দাবি। প্রিয়াঙ্কার থেকে হাত কয়েক দূরেই পুলিসের গুলিতে লুটিয়ে পড়ে প্রাণহীন চার ধর্ষকের দেহ।

খুন কা বদলা খুন। ধর্ষকরা আদালতের রায়ে নাকি পুলিসের গুলিতে মারা গেল, সাধারণ মানুষের কাছে সেই প্রসঙ্গ অবান্তর। মানুষ চেয়েছিল অপরাধীদের চটজলদি মৃত্যদণ্ড। আর তাই পুলিসের এনকাউন্টারে ধর্ষকদের মারা যাওয়ার খবর পেয়েই, উল্লাসে ফেটে পড়লো সাধারণ মানুষ। হায়দরাবাদের প্রিয়াঙ্কার পাশবিক হত্যার পর, বারেবারে প্রশ্ন উঠেছিল দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ডের পরিনতি নিয়ে। ওই নৃশংস গণধর্ষণে অপরাধীদের প্রাণদণ্ড দেয় আদালত। কিন্তু সাত বছর পরেও অপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানো যায়নি। নির্ভয়াকাণ্ডের পরিনতি দেখে শুক্রবারের এই ঘটনা যেন অনেকটাই প্রত্যাশিত। মানুষের মনে দীর্ঘদিন ধরে জমা থাকা ক্ষোভের খোলাখুলি প্রকাশ দেখলো দেশ।

কিন্তু প্রশ্ন  থেকেই যায়। মৃত চার খুনী, ধর্ষকের দেহ ঘটনাস্হলে প্রায় দশ ঘণ্টা ফেলে রাখা হলো কেন? ঘটনার পরেই তা ময়নাতদন্তে পাঠানোর কথা। পুলিস কমিশনার অবশ্য জানিয়েছেন আইনি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতেই মৃতদেহ সরানো হয়নি। পুলিসের হাতে গ্রেপ্তার ওই চারজনই যে প্রিয়াঙ্কাধর্ষণ আর খুনের খলনায়ক, তা কিন্তু প্রমাণ হলো না। ঘটনার সঙ্গে আর কেউ জড়িত ছিলো কিনা, বোঝা গেলো না তাও। ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
আজ গোটা দেশ হাসলো ঠিকই। অন্তরালে ঘাপটি মেরে আরও কেউ হাসলো নাতো?


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours