জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

সংবাদে প্রকাশ, 'জামিনে মুক্ত হয়ে ধর্ষিতাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা অভিযুক্তদের'। যদি সংবাদটি সত্য হয়, তবে এ বীভৎসা স্তম্ভিত করছে। কী নিঃসীম নারকীয় স্পর্ধা!

না, তবুও গণধোলাই চাই না। কখনও না। চাই অতি দ্রুত বিচার।পারলে এক সপ্তাহের মধ্যে। খুব বেশি হলে এক মাসের মধ্যে। তারপর আইনসম্মত শাস্তি।

নীতিগতভাবে মৃত্যুদন্ডের বিরোধী। তাই বাঁচিয়ে রেখেই এই ধরণের (ধর্ষণ করে হত্যা বা জামিন পেয়ে ধর্ষিতাকে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা) অপরাধের জন্য নৃশংস শাস্তির সংস্থান আইনেই থাকা উচিত। এক্ষেত্রে আইন নির্মমতম হোক।

ধর্ষণকে বিরল ঘটনা মনে করি না। ধর্ষণে একজন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতা মেয়ের মনে ধর্ষিতা হলে তার জীবন শেষ হয়ে গেছে, এই ভাবনা আসা উচিত নয়। আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলিও একজন নিরপরাধ ধর্ষিতাকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা দেয়। তবে নারীর সম্মানহানির জন্য ধর্ষকের অবশ্যই শাস্তি প্রাপ্য। আগে কোনও অপরাধের রেকর্ড না থাকলে ধর্ষককে ভীষণ কঠিন শাস্তির পক্ষপাতী আমি নই। দশ বছরের সশ্রম কারাদন্ডের পর একজনের জীবনে আর কিছু পড়ে থাকে না। যেহেতু এখন জেলখানার নাম সংশোধনাগার তাই প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে সংশোধনের সুযোগ থাকা উচিত। সেক্ষেত্রে (শুধুমাত্র ধর্ষণ, এবং যার পরবর্তীতে ধর্ষিযার পক্ষে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনযাপনের সম্ভাবনা আছে) দশ বছর কারাবাস যথেষ্ট, হয়ত বেশিই। কেউ কেউ ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে প্রাণদন্ডের সুপারিশ করছেন। ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে যদি অপরাধীর প্রাণদন্ড হয় তবে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ আনলে অভিযোগকারিণীরও প্রাণদন্ড হওয়া উচিত। অপরাধটির যা শাস্তি, মিথ্যা অভিযোগ এনে ফাঁসানোর চেষ্টা করলে বিপরীতেও সেই শাস্তি থাকা উচিত। কারণ সেক্ষেত্রেও সেই পুরুষটি কার্যত ধর্ষিত হয়। Biologically হয়ত একজন নারী একজন পুরুষকে ধর্ষণ করতে পারে না কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই পুরুষও নারী কতৃক অত্যাচারিত হয়। তবে সেগুলি এতটাই নিরুচার্য ও অচর্চিত থাকে যে সেই সব অব্যক্ত সমস্যা প্রচারের আলো পায় না। ব্যতিক্রম বাদ দিলে কেউ বা কোন সংগঠন সে সব নিয়ে মাথাও ঘামায় না। কিন্তু এই সব ক্ষেত্রেও সুবিচার দরকার।

তবে ধর্ষণের সঙ্গে হত্যার মতো অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতেই পারে। কারণ তখন সে খুনী। খুনের অপরাধ ধর্ষণের চেয়ে অনেক অনেক মারাত্মক বলে মনে করি। কারণ খুন করে একজনের জীবন চিরকালের জন্য শেষ করে দেওয়া হয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের কিছুটা সম্ভাবনা থাকে কিন্তু হত্যার ক্ষেত্রে সেটি থাকে না। এবং মুখে এসিড ছোড়ার ঘটনা এর চেয়েও ভয়ংকর অপরাধ।সে ক্ষেত্রে সেই মেয়েটিকে সারাজীবন অসহায়ভাবে এক দুঃসহ জীবনকে মৃত্যু অবধি টেনে নিয়ে যেতে হয়।

একই সঙ্গে বলব,একাধিকবার এই ধরণের অপরাধ করলে কিন্তু আইন তার প্রতি নির্মম হোক।এবং, এই ধরণের অপরাধের ক্ষেত্রে 'নাবালক' নামক ছাড়পত্রটি তুলে দিয়ে এক গোত্রে বিচার হোক। 'নাবালক' কখনোই ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘটিত করে না।

একজন সমাজবিদ্যার ছাত্রী পৃথিবীর বহুদেশের কারাগারগুলি ঘুরে ধর্ষকদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তিনি দেখেছেন যে শতকরা নব্বই ভাগ ধর্ষক তাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত বা অনুতপ্ত নয়। এই সমীক্ষা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে কী ধরণের সমাজে আমরা আছি। সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে এর কারণ খুজতে হবে। নৈতিক শিক্ষা দরকার। নারী পুরুষের উভয়ের দরকার। উভয়ের সহজ মেলামেশা দরকার। সমাজ ব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি না হলে এটি হবার নয়। যে শ্রেণির পুরুষদের মধ্যে নারীকে অসম্মানের প্রবণতা স্বাভাবিক ও সহজাত, তারা সংখ্যায় মোটেই কম নয়। তাদের অনেকেই বেশ ধোপদুরস্তও বটে। পকেটে ডিগ্রি টিগ্রিও রাখেন। তবে অসভ্যতাটুকু অতিক্রম করতে পারেন না। কেউ ধর্ষিতা হলে, মানুষ হিসেবে এরা মর্মাহত বা লজ্জিত বা ভাবিত না হয়ে আদি রসাত্মক মস্করায় মেতে ওঠেন।বাবা-মা, পরিবার, স্কুলস্তর থেকে নৈতিক শিক্ষা না পেলে এই ধরণের ছদ্মধর্ষকদের সংখ্যাও কমার নয়।

কোনও নারী পুরুষ বহির্ভূত নয়। কোনও পুরুষও নারী বহির্ভূত নয়। উভয়ে উভয়ের পরিপূরক। শরীর ও মনের গঠনের ভিন্নতাটুকু বাদ দিলে মনুষ্যত্বই উভয়ের একমাত্র পরিচয়।

লিঙ্গ,জাতি,বর্ণভেদের প্রচলিত আদিম প্রথাগুলি আসলে এক একটি ছোটো ডোবা যা সমগ্র মানবজাতি ও সভ্যতাকে আজ পর্যন্ত সমুদ্র হতে দেয়নি। তাই আক্রান্ত হয় বা প্রতিবাদে সোচ্চার হয় হিন্দু বা মুসলিম বা অন্যধর্মভুক্তরা, নারী বা পুরুষরা, তপশিলি জাতিভুক্ত বা উচ্চবর্ণভুক্তেরা। আদালতে ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে জবানবন্দি, সরকারের তরফে তপশিলি বা সংখ্যালঘু বা নারীদের জন্য পৃথক দপ্তর। অর্থাৎ ঘরের মধ্যে ঘর। শুধু মানুষ ও মানবতার পরিচয় চলবে না। সাদাকে লাল, নীল, হলুদ, সবুজে ভেঙে বর্ণালি তৈরি করো। 'Devided' হলে 'Rule' করা সহজ হবে।

স্পষ্ট করে বলা যাক, নারীবাদ বা পুরুষবাদও আসলে বিচ্ছিন্নতাবাদ। এবং মানবতাবাদ ব্যতিরেকে সবকিছুই তাই। এবং, নারী ও পুরুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র, আইন ও সচেতনতাকে কাধে কাধে মিলিয়ে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। এই ঘৃণ্য অপরাধের সংখ্যা কমাতে কমাতে শূণ্যে নামিয়ে আনাই হোক লক্ষ্য। (ক্রমশ)



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours