নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেট, অস্ট্রেলিয়া:

আজ মৃত্যুবার্ষিকী
নি:শব্দে একজন রফিক ভাইয়ের দীপের আলো
নিভে গেল। আর আমি হারালাম একজন মেন্টর!

আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি আপনাকেই  ভাবতাম !
তারাদের কেন ভাবছি না আপনাকেই কেন ভাবছি ,
তবু তেমনি আছে সবকিছু, সবাই ভালো আছে যার যার মতো ব্যস্ততা , জীবনের যুদ্ধে ঝেপে পড়ছে দিন রাত এক করে । তবুও বিষণ্ণ রাত আছে, হঠাৎ কালো হওয়া আকাশ আছে,
আপনি নেই আপনার পরামর্শ গুলো মনে নিয়ে চলি চলছি , নাজ মানুষ চেনো ! মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেই বা, আপনার একান্ত বাধ্যগত হলেই কিন্তু মানুষ ভালো হয় না । সহজেই কাউকে বলো না এ ভালো সে ভালো ! মানুষের সাথে মেশার পর আসলে বুঝবা , মানুষটা কেমন .. তিতা না মিঠা ! সত্যি রফিক ভাই , আমি বড্ড ভোলা মানুষ চিনি না , চিন্তেই করি যত ভুল ।
অদৃশ্য আপনি আরো কাছে এসে আমাকেই যেন কেমন করে জানিয়ে দেন  নাজ সাবধান । এতো এতো মিষ্টি কথায় ভুলছো তো গ্যাছো ! আমি
ডাকলেই চলে যান, দূরে ডাকি রফিক ভাই
এই টা কি জানেন ? এই বইটা পড়ছেন ? আরেহ মিয়া আপনে কবিতা পড়েন না , সাহিত্যের ঘন্টা জানেন !
রস কষহীন ব্যক্তি , পড়ে আছেন আকবরী নামা নিয়ে । এখনো আপনার হাসির শব্দ ঘরময় গম গম করে উঠে । এখন যখন ডাকি মহা সংকটে পড়ি , অনেক কিছুর মানে বুঝি না , তখন আনমনে বলি , রফিক ভাই এইটা জানেন? কোন শব্দ নেই সব দিকে ফাঁকা । আমার বড় ভাইয়ের জায়গাটা , আমাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখার স্নেহটা বড্ড মিস করি।
অদৃশ্য আপনাকে কি ডেকে সাড়া পাওয়া যায় রফিক ভাই ? কতগুলো বই শেষ  করলেন? পড়া হলে প্লিজ আমার জন্য নিয়ে আসবেন।

জীবন দর্শন এবং সমাজ দর্পণ যে মানুষটির কাছে শিখেছিলাম, জেনেছিলাম জীবন উত্তরণের পথে কতো লোকই তো বলে আয়ুস্মতী হও, আয়ুস্মান হও, হায়াতে তায়েবা দানের আর্তি করে- আদতে কি মানুষ কারো প্রার্থনায় ফিরে পায় আয়ু ? সব বোগাস, কিচ্ছু ফিরে পায় না মানুষের যতটুকু ধার্য করা দিন থাকে তাতেই হাসে কাঁদে খেলে । সময় হাত ঝাঁকায় আদেশ তার । কোথায় চলতে হবে কোথায় থামতে হবে। 
রফিক ভাই এমন করে আপনার নিভে যাওয়া আলোতে আমার হৃদয় অন্ধকার সকালেরই-মেইলে লাল সিগন্যাল পেতে হবে তা কোনদিন কি ভেবেছিলাম ! আজ যেন স্মৃতি উছলে আপনার সমস্ত চলাচল হাসি বসার ভঙ্গি ছায়া ছায়া স্বতন্ত্র সংলাপ গুলো ফিরে ফিরে মনে ভাসছে । খুব সহজভাবে সময়ের ঘাত প্রতিঘাত উত্থান পতনেরে আলেখ্য গুলো কতো সহজেই না উচ্চারণ করে যেতেন, আপনার উপদেশ স্নেহ শাসন ও স্বপ্ন দেখার সমস্ত স্মৃতি গুলো নিজস্ব অনুভবের জায়গা থেকে ছুঁয়ে ছেনে দেখছি আজ সুদূরে বসে বসে । ব্যস্ত জীবনের একটা সকাল আমি শব্দ করে কাঁদছি, তবুও হালকা হয় না তবুও বুকের উপর থেকে পাথর সরে না । এ কোন সকাল এলো আজ , রাতের চেয়েও অন্ধকার ! জানি পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে যাবে, কিছুটা দার্শনিক কিছুটা প্রতিদিনের দেখা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আশা নিরাশার চোরা স্রোতে । আপনার কথাই বলি, বলেছিলেন কোন শোকই দীর্ঘস্থায়ী নয়, হয়তো সত্য কিন্তু তারপরেও বলবো একজনই তো রফিক ভাই সকলেই নয়।
আজ সামনের জীবনে এসে পিছনের জীবনে উঁকি দিয়ে দেখছি । আমি আপাদমস্তক ঋণী, যে সময় সামনে বসিয়ে বলতেন ' নাজ জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করতে জানতে হবে । জানিনা  বুঝিনা পারিনা শব্দগুলি ডিলিট করো জীবন থেকে । ব্যতিক্রমী হও হতে হবে'। শেষবার যখন দেখা হলো বললাম বিদেশ চলে  যাচ্ছি ভাই, মনে পড়ে বলেছিলেন 'আবার একটা ভুল করবা, কারণ সব মানুষের জন্য বিদেশ না, নাজ তুমি বৈষয়িক না, তুমি উদাসীন, যারা আয়েশ চায় জৌলুস চায় তারা অট্টালিকায় ঘুমায় । তুমি তো উদাসীন আপনভোলা, সৃজনশীল তোমার জন্য বিদেশ  বনবাস। যাও বইসা বইসা কাঁদবা আর লেখবা 'নাজের বনবাস' । তারপর আপনার অবশিষ্ট হাসিটুকু মনে আছে, চোখে ভাসছে।

আজ ইশান যখন ডাকলো বুকের ভেতরটা হঠাৎ ছ্যাঁত করে উঠলো । যেন রফিক ভাই ডাকল, এই নাজ কি করো ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখো ? কি মুশকিল  মেধা পচায়া ফেলবা তো দেখি, টিভি অফ করে দিয়েছেন দেখে অন্যরুমে গিয়ে কটমট করে রেগে কতো যে খাটাশ বলে বকেছি, আপনি শোনেননি রফিক ভাই, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। 
আপনি আমাকে সম্বৃদ্ধ করেননি শুধু মানসিক  গঠনের প্রথম ক্লে টা ভালভাবে ছেনে দিয়েছিলেন । থেমে গেল একটা চেনা ডাক একটা শাসনে স্নেহ ভরা আবদার, আপনি ছিলেন আমার রোল মডেল আপনার না জানা বিষয় নিয়ে গাই গুঁই না করা  না বুঝে পণ্ডিতি ভাব না দেখানো আমি রপ্ত করেছিলাম । রফিক ভাই আমি সারাদিন তিনপাতা হলেও পড়ি যা পাই তাই । গয়না কিনি না বই কিনি । বই পড়ার পর পছন্দের লাইন গুলো পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে রাখি । বলতেন বই পড়ে শেষ পৃষ্ঠায় মন্তব্য লিখবা । আপনি কি দেখেছেন ভাইয়া আপনার সংগ্রহ শালার ১০০০ বইয়ে আমার মন্তব্য আছে।  বইগুল আণ্ডার লাইন করতে করতে ছ্যাড়াব্যড়া করে দিয়েছি , জানি আপনি দেখতেন আর মনে মনে খুশী হতেন ইশানের জন্য । ইশান যদি পুরো বইগুলো না পড়ে তবুও আণ্ডারলাইন গুলো পড়বে । জানিনা ইশান আপনার মতো বই পাগল কিনা । আমাকে বই পড়ার অভ্যাস করে দিয়েছেন আমার লেখক জীবন আপনাকে কুর্নিশ করে । রফিক ভাই আমি কার সাথে বই নিয়ে তর্কে মেতে উঠবো?
আপনার ছেলে আমার মেয়ে আমাদের ঝগড়া দেখলো না , আপনার অনেক বছর বাঁচা উচিত ছিল। কেন এমন হয়, আপনার ধুসর পাণ্ডুলিপি বিদেশে বসে আমাকেই লিখতে হবে ভাবিনি, আমার কান্না অশ্রুফোটা আপনার বরই পাতা গরম জলে মিশিয়ে দিলাম।
আপনার আত্মা শান্তি পাক, আপনি ঘুমিয়ে থাকুন। আপনার জন্য জারীগান গাইবো আমৃত্যু। ২৬/১২/২০১৭ ।চলে গেলেন বলে কি ভেবেছেন আপনাকে ভুলে যাবো , মোটেও না এমন কোন দিন নেই মনে হয় না , আমি রাসেল যে আপনার বলা কথা গুলো আজও আওড়ে যাই । মতের মিল হলে বলে উঠি একসাথে - রফিক ভাই বলতো !
ভালো থাকুন নক্ষত্রের দেশে । খুব বই পড়ুন এসে শুনবো কত কত বই পড়ে শেষ করলেন!
আমার লিষ্টটাও কিন্তু কম লম্বা নয়!



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours