কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

কথায় বলে চোর চৌকিদার হলে পাড়া নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। আর কোনও বাড়িতে চুরি হয় না।
কিন্তু চোর, চৌকিদার সব মিলেমিশে যখন একাকার, তখন অবস্থাটা কী দাঁড়ায়? সেটা বুঝতে হলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে পরিষ্কার চোখে তাকাতে হবে।
ধর্ষণ ধর্ষক নিয়ে সংসদ, বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভা উত্তাল। ঠিক তখনই দলের নামাবলী গায়ে চাপিয়ে গলা ফাটাচ্ছে জন-প্রতিনিধিরূপী নারী নির্যাতন, এমনকি রেপ কেসের অভিযুক্তরাও।

আবার আরেকটা ধর্ষণ। এবার বধ্যভূমি হায়দরাবাদ। পুলিস, আদালত, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা। সাত বছর পেরিয়ে গেলেও মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয় না নির্ভয়াকাণ্ডের আসামীদের। এদিকে দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে, ষোল মিনিট অন্তর অন্তর ধর্ষিতার সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সে সব আওয়াজ আমাদের কানে তেমন ভাবে পৌঁছয় না। এরইমধ্যে ফের ঝড় উঠলো হায়দরাবাদে। নির্ভয়াকাণ্ডের মতোই আরও একবার পুলিসের নিষ্ক্রিয়তা। গণধর্ষিতা তরুণী। ফের নৃশংস হত্যা ধর্ষিতার।

আবার উত্তাল সাধারণ মানুষ। ক্ষোভের বিস্ফোরণ। শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে নাতো? আবার ফিরে আসবে নাতো 2004 সালের 13 অগাস্ট? ধর্ষিতা মহিলা নাগপুর জেলা আদালত চত্বরে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ধর্ষকের ওপর। প্রায় শ'দুয়েক মহিলা সেরেফ পিটিয়েই মেরে ফেলেছিলো ভরত কালীচরণ ওরফে অক্কু যাদবকে। সেদিন ওই মহিলারা ভয় পেয়েছিলেন, আদালতের রায়ে জামিনে খালাস হতে পারে অক্কু। ফের শুরু হতে পারে ধর্ষণরাজ। ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়াটা গণতন্ত্রের পক্ষে খুব শুভকর নয় মোটেই। পনেরোবছর পর, হায়দরাবাদেও কিন্তু তৈরি হয়েছিল একইরকম উত্তেজক পরিস্থিতি। একটা স্ফূলিঙ্গের ছোঁয়া লাগলেই অনর্থ হতো।

আবার আরও কিছু মোমবাতি মিছিল। মোমবাতি গলে শেষ। প্রতিবাদও শেষ। ফের অন্ধকার। এদিকে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস(এডিআর)- এর রিপোর্ট ওই অন্ধকারকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। দেশের স্বঘোষিত চৌকিদার নরেন্দ্র মোদির দলই গত পাঁচ বছরের মধ্যে নারী নির্যাতন মামলায় জড়িয়ে থাকা মোট সাতচল্লিশজনকে বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থী করেছিল।
যে কংগ্রেস প্রতি পদক্ষেপে পদ্ম শিবিরের ভুল ধরে, সেও ওই নারী নিগ্রহে অভিযুক্ত মোট চব্বিশজনকে দলের টিকিট দেয়। যারা লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভায় গাঁধিজির আদর্শের কথা শুনিয়ে, ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল।

যে দলে এক মহিলাই সর্বেসর্বা, সেখানেই বা অবস্থাটা কেমন?
উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর দল বহুজন সমাজ পার্টিরও ওসব বাছবিচার নেই। নারীনিগ্রহে অভিযুক্ত মোট পঁয়ত্রিশজনকে প্রার্থী করেছিল 'বহেনজি'র দল। আর অন্যান্য দলগুলি ভোটে নামিয়েছিল ওই একই মামলায় জড়িয়ে থাকা মোট ছাব্বিশজনকে। এতো মাত্র গত পাঁচ বছরের হিসাব- কিতাব। তবে এ ব্যাপারে যে কোনও দলের কাছে জবাবদিহি চাওয়া হলেই, একেবারে 'মেড ইজি' টাইপের জবাবও ধরাই থাকে। অভিযোগ থাকা মানেই দোষী না।

দেশের রাজনৈতিক অভিভাবকদের যখন এই হাল, তখন দেশের হালটা কী? ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলছে, 2017 সালে ধর্ষিতার সংখ্যা ছিল বত্রিশ হাজার পাঁচশো উনষাট। এর বাইরেও যে ধর্ষণের কত ঘটনা ঘটেছে কে জানে। সেসব ঘটনা ধরা নেই পুলিসের খাতায়। প্রিয়াঙ্কার বাবার কথাতেই তার খানিকটা আভাস মেলে। মেয়ের বাড়ি না ফেরার ঘটনাকে পুলিস উড়িয়ে দিয়েছিল। খানিকটা আদিম উল্লাসেই উদগ্রীব পিতাকে বলেছিল, "দেখুন মেয়ে পালিয়ে গেছে কিনা!"

ওদিকে হায়দরাবাদে পুলিস বেশ চটজলদি কোমরে দড়ি পরিয়েছে চার নৃশংস ধর্ষকের। তদন্ত চলছে। চার্জশিট। আদালতের মামলা গড়াতে পারে হাইকোর্ট পর্যন্ত। আইনজীবীদের লড়াই। সব লড়াই ডিঙিয়ে ধর্ষককে শাস্তি দেওয়া? বড় কঠিন সে কাজ। কারণ ধর্ষিতাকে খুন করে ফেলা হয়েছিল ধর্ষণের পরেই। গোটা মামলা দাঁড়িয়ে পুলিসের তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ আর আদালতে আইনজীবীদের লড়াইয়ের ওপরে। তারপর আদালতের রায়।
গড়পরতার হিসেবে, প্রতি একশো অভিযুক্তের মধ্যে দোষ প্রমাণিত হয় মাত্র বত্রিশজনের। তারপর শাস্তিদান। দীর্ঘ এক পথ। এতকিছুর পরেও, শাস্তিদান থেকে যায় ভবিষ্যতের গর্ভে। 2012 সালের নির্ভয়া কাণ্ডের ফাঁসীর আসামী আজও আমাদের করের টাকায় খেয়েপড়ে দিব্য বেঁচে আছে। পাবলিকও বেশিদিন কোনও ধর্ষিতার কথা মনে রাখে না। কারণ ততদিনে ওরকম, বা তারচেয়েও আরও বেশি নৃশংস কয়েকটা ধর্ষণের ঘটনা হয়ে যায়।
ওদিকে ততদিনে সন্তানশোকে মা বাবার চোখের জলও শুকিয়ে কাঠ।

হায়দরাবাদের ঘটনার ঢেউয়ে ভেসেছিলো বাংলাও।
এ রাজ্যেও যে নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে থাকা খলনায়কদের জনপ্রতিনিধি হতে বাধা নেই, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এডিআর রিপোর্ট। নির্বাচনী লড়াইয়ের জন্য জমা দেওয়া এফিডেবিটেই তার প্রমাণ। কোনও না কোনও ভাবে নারী নির্যাতনে অভিযুক্ত, এমন অন্তত এগারোজন প্রার্থী রাজ্যের বর্তমান শাসকদলের হয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছিলেন। সংখ্যার হিসেবে এ ব্যাপারে বাংলা দ্বিতীয় সেরা। ঠিক তার আগের জায়গাটা মহারাষ্ট্রের। ভারতের বাণিজ্য নগরীতে ওই অঙ্কটা ছিল বারো।
এরপরেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ। ওই দুই রাজ্যের নির্বাচনী ময়দানে নেমে পড়েছিলেন পাঁচজন করে অভিযুক্ত।
গোটা দেশের নিরিখে এই কলঙ্কিত প্রার্থীর সংখ্যাটা ছিল তিনশো সাতাশ। পরিসংখ্যানের হিসেবে এ ব্যাপারে পদ্ম শিবিরকেই এক নাম্বারে রেখেছে এডিআর।
এরপরেও সংসদে 'ধর্ষণমুক্ত' ভারত গড়া নিয়ে গলা ফাটাতে দেখা যায় দেশের রাজনৈতিক অভিভাবকদের। দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করেন সংসদের স্পিকার। সংসদ চাইলে ধর্ষকদের শায়েস্তা করতে, আরও কড়া আইন নিয়ে আসার কথা শোনান খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তবে দেশের আইন কানুনের ওপর যে মানুষের আস্থা শিথিল হচ্ছে, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিললো রাজ্যসভায়। "ধর্ষকদের প্রকাশ্যেই পাবলিকের সামনে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত," বললেন সমাজবাদী পার্টির সাংসদ জয়া বচ্চন। কিন্তু এই তালিবানি ব্যবস্থা নৃশংসতার সংক্রমণ ঘটাবে নাতো? সমাজবিজ্ঞানীরা মনে হয় এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করবেন না।
তাহলে আগামিদিনের পরিস্থিতিটা কী হতে চলেছে? যে নির্ভয়া, প্রিয়াঙ্কারা বেঁচে রইলেন, তাঁদের জন্য বিপদ ওত পেতে নেই তো? বলা মুশকিল। কারণ সর্ষের মধ্যেই লুকিয়ে ভূত। চৌকিদার তা দেখতে না পেলে ভূত তাড়ানোর উপায় হবেই বা কোন ঝাড়ফুঁকে?



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours