শামা আরজু, লেখক, বাংলাদেশ:

বিজয় দিবসের জন্য কেউ কেউ লেখা চাইছেন, কিন্তু কি এক অভিমানে লিখতে ইচ্ছে করে না। সেটা কাউকে বোঝানো যাবে বলেও আমি মনে করি না।  বিজয় দিবসের নামে বিজয়মেলা করার মানে কি এই শহরের সবাইকে শব্দদূষণে রেখে এক রকমের অসুস্থ করে ফেলা? মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক কিংবা সিনেমা অথবা ডক্যুমেন্টারী যাই হোক আমাকে খুব টানে। এইতো তিন-চার কি দিন পাঁচেক আগে যে কোনো একটা চ্যানেলে এ জাতীয় একটা টেলিফিল্ম দেখার জন্য শুয়ে আছি, কিন্তু শোনার উপায় নেই। পাশেই ওয়াজ চলছে। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে চিৎকার কেন মানুষ দেয়, আমি বুঝতে পারিনা। শরীরে তাদের এমন জোশ চলে আসে মনে হয় যেন, একটা এলাকায় ওয়াজ করে,তারা গোটা পৃথিবীর সব মানুষকে মুসলমান বানিয়েই ছাড়বে!  এর বাইরে কিছু নয়।
একটা এলাকায় মানুষ অনেক ধরনের অসুস্থ থাকতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা থাকতে পারে। হার্টের অসুখ থাকতে পারে। ঘুমের সমস্যা থাকতে পারে এমনকি ডিপ্রেশনের সমস্যাও থাকতে পারে, যাতে এরকম শব্দে তার খুবই সমস্যা হয়। হার্টবিট বেড়ে  গিয়ে শ্বাস কষ্ট লাগে।। এমনকি তাকে হাসসপাতালে নিয়ে অক্সিজেন দেয়া লাগে । এই সমাজ এমন সমাজ যোটা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করতে এক পায়ে খাড়া কিন্তু অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করতে একটা পদক্ষেপ ও দেয়না না তারা। এখনই আমার পোস্টে হুমড়ি খেয়ে পড়ার দরকার নাই। আমি জীবন দেখেছি খুব কাছে থেকে। আমি হতাশ তো ইচ্ছে করে হইনি। অনেক ভেবেচিন্তে, দেখেশুনে নিতান্ত অনিচ্ছায় আমার পুঁজি করেছি হতাশাকে আমি। তাই এই বিজয় দিবসে আমি  আপাতত একটি চরম হতাশার কথা লিখবো। আমার স্কুল এলাকায় এক পাগলের বসবাস। বাড়িতে তার পাশেই, কিন্তু সে বাড়িতে থাকবে না। তার গায়ে একটা সুতাও রাখবে না। সঙ্গে রাখবে কয়েকটি লাঠি, মোটা লাঠি। ওগুলি দেখে ভয় লাগে। তাকে দেখতেও ভয় লাগে। কুচকুচে কালো, ভয়ঙ্কর চেহারা। কিন্তু তাই বলে কি  এই সমাজে তাকে পীর মানার মতো মানুষের অভাব আছে!তাতেও আমার সমস্যা ছিলো না, যদি না সে এসে আমার ইস্কুলে বসতি গাঁড়তো। যদি না সে একগাদা বিরিয়ানি আর ফল খেয়ে দুর্গন্ধ ময়লা ছড়াতো। ইস্কুল আঙ্গিনায় যদি না এসব পরিষ্কার করার মতো কেউ না থাকতো। অনেক যুদ্ধ  করে একটা ভালো দপ্তরী পেয়েছি,এ আমার সৌভাগ্য, যদিও দুর্ভাগ্যও অনেক আছে।  কিন্তু সেটা আজ বলতে বসি নি। আজ আমি কেবল  এক পাগলের সঙ্গে তিন পাগলের গল্প বলবো পাগলের জন্য তার মুরিদরা বিরিয়ানির প্যাকেট এনে রাখে। তখন আমের সিজন। আমি নিজেই আম কিনি না কয়েক বছর হলো। বাবার গাছের আমের খবর রাখি না। পাগলের জন্য কেজি কেজি আম, বিরিয়ানি কিনার লোকের অভাব নেই। কিন্তু তার এসব খেয়ে ট্যাগ করা ময়লা গুলি পরিষ্কার করবে কে! এসব নিয়ে খুব ভাবনা চিন্তায় পড়ে গেলাম। তারপর এলাকার লোকজনের কাছে শুনলাম তার এসব লাঠির  আঘাতে একজন মুরিদই মারা গেছে, যে কিনা তাকে খাবার দিতে এসেছিলো।  আহত হয়েছে আরো দুজন। এর মধ্যে সে আমার স্কুলের শিশুদের কেও লাঠি নিয়ে তাড়া করে। শিশুরা ভয়ে স্কুলে আসতে চায় না।

অভিভাবকদের সাথে কথা বলে কিছুই সমাধান পেলাম না। অগত্যা এলাকার জন প্রতিনিধি একজনকে ফোন করলাম।ওমা, তার কাছে কি সাহায্য চাইবো উল্টো আমারই তাকে সাহায্য দেয়ার কথা! তিনি বললেন, "ম্যাডাম জানেন তো এসব সেনসিটিভ ব্যাপার, ডিসি মহোদয়ের অফিস থেকেও লোকজন এসে এই খাবার দাবার দিয়ে যায়। সুতরাং যাই করেন খুব কৌশলে করবেন। চেষ্টা করে দেখুন, না পারলে আমাকে বলবেন।" কলিগ দের মধ্যে বলাবলি করলাম কেউ কিছু না করলে আমিই লাঠি দিয়ে ব্যাটাকে এমন মাইর দিবো যে দৌড়ে পালাবার পথ পাবে না। পাগলের জন্য সুস্থ মানুষ মারা যাবে সেটা তো হয়না। আমি জানি পাগল শব্দটি ব্যবহার করা একটি সামাজিক অপরাধ। জেনেশুনে সে অপরাধ করেছি, তাই বলে আমি কিছুটা অনুতপ্ত। কিন্তু শব্দটা বাদ করলাম না এজন্য যে, আমার লেখাটির মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পাঠকের সমস্যা হবে। পাগলের বাড়ির পাশে তার বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলে দেখলাম। অনুরোধ করে দেখলাম  বেঁধে রাখার জন্য। তারা রাখবে না। তাদের কথা পাগলকে নাকি বেঁধে রাখা যায় না। এক্ষেত্রে আমার আর কি করার আছে বলুন! দু-তিনদিন এভাবেই গেলো। তৃতীয় দিন যা দেখলাম, তাতে করে আমার হতাশা আরো খানিকটা বাড়লো বই কমলো না। মোটরসাইকেলে করে দুজন পোশাকি লোক,  নামলেন এবং পাগলের বিষ্ঠা গুলি দুহাত দিয়ে খিঁচে তুলে নিয়ে পাশের পুকুরে ফেলে দিলেন। স্কুলের কলে কল চেপে হাত ধুয়ে চলে গেলেন। সাবান ছাড়াই। আমার দুইজন কলিগ এসব দেখে বমি করে দিলো। আমি সারা জীবন এরকম অনেক বমি গেলা মানুষ। আমি বমি করি লেখার মাধ্যমে। আমার লেখা দিয়ে আজ বিজয় দিবসের লেখায় আমি একটু বমিই করবো। ভাবনা-চিন্তা সেটাই করলাম, কেউ কিছু না করলে আমিই মার দিবো। কারন আমার শিশু মরবে তার লাঠির আঘাতে এমনকি আমরা শিক্ষকরাও মরবো সেটা কি করে সম্ভব! যাইহোক, এটা আমার ক্ষোভের কথা। আমি অন্য পথ খুঁজছিলাম। চতুর্থ দিন স্কুলে গিয়ে দেখি পাগল নেই। স্কুলে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, তার জন্য একটা ঘর করা হয়েছে স্কুল এলাকায়। নতুন টিন দিয়ে।  মজবুত করে একটা ঘর করা হয়েছে। টিন যেন নষ্ট না হয় তাতে রংও লাগানো হয়েছে। ভেতরে একটা চৌকি পাতা আছে আর আছে গোটা ৫/৬ কেরোসিন তেলের বড়ো বড়ো কুপি, যাকে আমরা ছোটবেলায় চেরাগ বলতাম। সঙ্গে দেখলাম বোতলে ভরা সম্ভবত কেরোসিন তেল।২ প্যাকেট বিরিয়ানি তখনও বাঁধা অবস্থায়। খোলা হয়নি। প্যাকেট দেখলেই বুঝা যায়।দিন চারেক সে ঘরে থাকলেও এরপর থেকে আর সে ঘরে থাকেনা। আবার সে বাইরে। তবে আপাতত আমার স্কুলে নয়। আবার আমরা খুব চিন্তা ভাবনায় পড়ে যাবো আসল কথা বলাই হয়নি। আমার স্কুলের এক শিক্ষার্থীর মা পাগল থাকে বছরের প্রায় ছ মাস। ওষুধ খেলে ভালো থাকে। কিন্তু তার ভাই তাকে ওষুধ কিনে খাওয়ানোর মতো আর্থিক ক্ষমতা রাখেনা। তাই তখন তার ভাই  তাকে ঘরের এক কোনায় দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। বাঁধা অবস্থায় ময়নার মা মাটিতে শুয়ে পড়ে। এই শীতকালেও সে মাটিতেই শুয়ে থাকে। তাকে ওষুধ কেনার বা কিনে দেয়ার মতো কেউ নেই। মেয়ে মানুষ কখনো মুরিদ হতে পারে না। মেয়েরা পাগল হলে  বিরিয়ানির প্যাকেট ও পায়না। হয়তো তার ভাই তাকে বেঁধে না রাখলে সে বারকয়েক প্রেগনেন্ট হতে পারতো। পাগল শব্দটা কেন ব্যবহার করেছি আশা করি পাঠকদের বুঝতে সমস্যা হবেনা। হ্যাঁ এই বিজয় দিবসে আমি একটা পাগল বিষয়ক লেখা প্রসব করলাম।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours