পারমিতা দাস, লেখিকা, কলকাতা:

প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে যখন পৃথিবী সৃষ্টি হয় তখন কাঁটাতার ছিল না। দু লাখ বছর আগে যখন প্রথম মানুষের(হোমো সেপিয়েন্স) আবির্ভাব হয় তখনও কাঁটাতার ছিল না। ধীরে ধীরে মানুষ যাযাবর (হান্টিং এন্ড ফুড গ্যাদারিং) জীবন ছেড়ে ফসল ফলাতে শুরু করল, ঘরবাড়ি বানাল, তখন এলো জমির দখলদারির প্রশ্ন। এলো গোষ্ঠী, গোষ্ঠীপতি থেকে রাজা, রাজ্য, দেশ। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র। পৃথিবীর কিছুটা অংশ দখল করে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে সেই জমিকে “আমাদের দেশ” বলে দাবী করতে শুরু করল কিছু মানুষ। সেই কাঁটাতার ঘেরা ভূখন্ডে তারাই হয়ে উঠল শাসক, ভূখন্ডের সর্বময় অধিকর্তা। কিন্তু কিছুটা জমি কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে আলাদা করে নিলেই তো জল, হাওয়া, বায়ুমণ্ডল, সূর্যরশ্মি সবই আলাদা করে নেওয়া যায় না। অতএব আমরা, পৃথিবীর সমস্ত দেশের মানুষ একে অপরের সঙ্গে জুড়ে রইলাম। কিন্তু চরম ঔদ্ধত্য কিংবা অজ্ঞানতা আমাদের সে কথা ভুলিয়ে দিল। আমরা শিল্পবিপ্লব করলাম, বিদ্রোহ করলাম, যুদ্ধ করলাম, বিশ্বযুদ্ধ করলাম, পরমাণু বোমা ফাটালাম, পৃথিবীকে একটু একটু করে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিলাম। বিজ্ঞানীরা বললেন বায়ুমণ্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাস বাড়ছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, ওজোন স্তরে ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে, সমুদ্র, নদী খাল বিল দূষিত হয়ে যাচ্ছে রাসায়নিক বিষে, আমরা শুনলাম না। আমরা কৃষি বিপ্লব করলাম, নদীতে বাঁধ দিয়ে তাকে বশ করতে চাইলাম, ভূগর্ভের জল যথেচ্ছ ব্যবহার করলাম, ইচ্ছামত সবুজ বিনষ্ট করে বসতি বানালাম, নিত্য নতুন ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট বানালাম, প্লাস্টিকের লাগাম ছাড়া ব্যবহার করলাম, জেনেটিক্যালি মডিফায়েড শস্য বানালাম, পৃথিবীকে দ্রুত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিলাম। বিজ্ঞানীরা বললেন সমুদ্রের তাপমাত্রা প্রতিবছরই বাড়ছে, সামুদ্রিক প্রাণীরা মারা যাচ্ছে, প্রতিবছর শয়ে শয়ে প্রজাতির প্রাণ অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে, খনিজ সম্পদ ফসিল ফুয়েল শেষ হয়ে আসছে, বায়ুমণ্ডলের দূষণ এমন অবস্থায় গেছে যা আর পূর্বাবস্থায় ফেরানো যাবে না (ইররিভার্সেবল), হিমবাহ গলছে, সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে, আমরা এখনও শুনছি না। আমরা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থরক্ষায় মেতে আছি। ধর্মের নামে এক দেশ অন্য দেশের সঙ্গে বছরের পর বছর যুদ্ধ করছি অথবা ছায়াযুদ্ধ করছি। কিছু মানুষকে ঘর থেকে বেঘর করছি, দেশে দেশে তাদের শরণার্থী বানিয়ে রাখছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি কেউ নিজের চেনা অভ্যেস ছেড়ে, শৈশবের পেয়ারা গাছ ছেড়ে, নিজস্ব কাঁথা কম্বলের ওম ছেড়ে, সারা জীবনের জমানো স্মৃতির চিলেকোঠা ছেড়ে স্বেচ্ছায় অন্য দেশে পাড়ি দিতে চায় না। আমরা ভুলে যাচ্ছি মানুষ ধর্ম সৃষ্টি করেছে, দেশ সৃষ্টি করেছে। দেশ বা ধর্ম মানুষকে সৃষ্টি করেনি। তাই ধর্মের আগে, দেশের আগে মানুষের অধিকার। আমরা ভুলে যাচ্ছি মানুষের প্রাথমিক ধর্ম মানবতা। এই পৃথিবীর জল মাটি হাওয়া থেকে সৃষ্ট প্রতিটি মানুষ। প্রকৃতি মানুষে মানুষে ভেদ করেনি, বিভেদ সৃষ্টি করেছে মানুষ নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য।
আজ যখন মানুষের ক্ষুদ্রতর স্বার্থের সাথে বৃহত্তর স্বার্থের সংঘাত উপস্থিত হয়েছে, যখন সব মানুষের আশ্রয়স্থল পৃথিবীর অস্তিত্ব বিপন্ন, তখন সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর। সভ্যতার নামে, উন্নয়নের নামে, যুদ্ধের নামে, ক্ষমতা দখলের নামে, দেশ রক্ষার নামে,  ধর্মের নামে, প্রতিবাদের নামে, প্রতিরোধের নামে আর পৃথিবীর সামান্যতম ক্ষতিও হতে দেওয়া যাবে না। সেটা তখনই সম্ভব যখন আমরা কাঁটাতার ঘেরা ক্ষুদ্র ভুখন্ডকে নয় এই বিশাল পৃথিবীকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব। পৃথিবী জুড়ে যেসব গণতান্ত্রিক শাসকেরা ক্ষমতার দম্ভে কাঁটাতারকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে চায় তাদের নামিয়ে আনব ক্ষমতার প্রাসাদ থেকে উন্মুক্ত রাজপথে, যেখানে পৃথিবীবাসী সাধারণ মানুষ একে অপরের পাশাপাশি শান্তিতে বাস করতে চায়, এই পৃথিবীর জল মাটি হাওয়া শস্য ভাগ করে নিতে চায় একে অপরের সঙ্গে। আমরা প্রশ্ন করব, দেশ শাসনের নামে কিছু মানুষ কেন পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করবে? কেন তারা বেশি নিরাপত্তা পেয়ে অন্যের জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে? কেন একদল মানুষকে আর একদল মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবে ধর্মযুদ্ধের নামে, দেশ রক্ষার নামে? আমরা উত্তর দাবী করব কিন্তু আগুন জ্বালিয়ে আমাদের নিঃশেষিত হয়ে আসা অক্সিজেনের বিনিময়ে নয়, আমাদের নিঃশেষিত হয়ে আসা ফসিল ফুয়েলের বিনিময়ে নয়, আমাদের উষ্ণ পৃথিবীকে আরও উত্তপ্ত করে নয়, মানুষের প্রাণের বিনিময়ে নয়, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়ে নয়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours