প্রশান্ত ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর নোটবন্দির করে দিয়ে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী যেমন দেশের সব মানুষকে প্রায় বিনা বাক্য ব্যয়ে এটিএম আর ব্যাঙ্কের বাইরে দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই অমানবিক শারীরিক কষ্ট মানসিক উদ্বেগে যেমন বেশ কয়েকজন শহিদ হয়েছিলেন, আর বাকিরা সেই তাণ্ডব সহ্য করেছিলেন, মোদীর বিশ্বাস ছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসি'র ক্ষেত্রেও দেশসুদ্ধ লোক তাই করবেন। কিন্তু হিসেব গোলমাল হয়ে গিয়েছে। নাগরিকত্ব বিল নিয়ে অরাজনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে বিভিন্ন রাজ্য। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া থেকে সাধারণ নাগরিক সমাজ আজ রাস্তায়। আসমুদ্রহিমাচল আজ উত্তাল। মানুষ ধরে ফেলেছে নোটবন্দির মতো নতুন নাগরিকত্ব আইন হলো গেরুয়া শিবিরের আরও একটি ফ্যাসিস্ট পদক্ষেপ। বিশেষ করে অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি'র ভয়াবহ পরিণতির পর ভারতবাসী আর মোদী-শাহর ফাঁদে পড়তে নারাজ। সাধারণ মানুষ ধরে ফেলেছেন, নয়া নাগরিকত্ব আইন এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি তৈরির আগের ধাপ। যার মাধ্যমে ভারতের ৩টি প্রতিবেশী দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা যাঁরাই ধর্মীয় বিদ্বেষের শিকার হয়ে এই দেশে এসেছেন, তাঁরা সহজে এদেশের নাগরিক হয়ে যেতে পারবেন। এই আইন যে মুসলমান সংখ্যালঘুদের জন্য নয়, তা ভারতের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার বা শ্রীলঙ্কা বা চিনকে এই আইনে অন্তর্ভুক্ত না করার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এর পরের ধাপে দেশের নাগরিকদের প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা ও তাঁদের বাপ-ঠাকুরদা-প্রপিতামহরা এদেশেই জন্মেছিলেন। অসমের মডেল যদি অনুসরণ করা হয় তাহলে এনআরসি-তে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করা দুরূহ ও বিস্তর হাঙ্গামার ব্যাপার।
আগে থেকেই বলেছিল এরাজ্যে এনআরসি হবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় থেকে বলে আসছেন, 'নো এনারসি'। এইবার নয়া নাগরিকত্ব আইন আসতেই রাজ্যের শাসক দল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদকে মূল রাজনৈতিক স্রোতে নিয়ে আসে। এর পাশাপাশি
পশ্চিমবঙ্গে কিছু অরাজনৈতিক প্রতিবাদ অসমের মতোই হিংসাত্মক আকার নেয়। কোথাও কোথাও হিংসাও হয়েছে। তবে ১৯ ডিসেম্বর দেশের অনেকগুলি রাজ্যের সঙ্গে কলকাতাও গর্জে উঠেছে। রাজনৈতিক-পতাকা বিহীন নাগরিক সমাবেশ থেকে ধর্মীয় বৈষম্য সৃষ্টি করা নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন এ রাজ্যের নাগরিকরাও।
আমরা এক নতুন ভারতকে দেখলাম। প্রতিবাদে-প্রতিরোধে মুখরিত ভারত। কলকাতা দিল্লি লখনউ কানপুর বারাণসী বেঙ্গালুরু মেঙ্গালুরু চেন্নাই তিরুবনন্তপুরম পটনা ভুবনেশ্বর আহমেদাবাদ মুম্বই --- সবাই এখন এক বন্ধনীতে। স্লোগান উঠছে, 'আমরা কি।/ নাগরিক।' 'নো এনআরসি, নো ক্যা, নো এনপিআর’। হিন্দু-মুসলমান গলা মিলিয়ে বলছে, 'হিন্দু মুসলিম রাজি/ কেয়া করেগা নাজি।' তরুণ সমাজের মুখে বুলি, 'নরেন্দ্র মোদীর দুই গালে/ জুতো মারো তালে তালে', 'অমিত শাহর দুই গালে/ জুতো মারো তালে তালে', 'তুম না দোগে আজাদি/হাম ছিন লেঙ্গে আজাদি'। জাগ্রত তরুণ সমাজের জেহাদ, 'নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য কেনো কাগজ দেখাব না'। বহু দিন পর  ভারত দেখল কোনো একটা ইস্যুতে গোটা দেশ এক সঙ্গে পথে নেমেছে। দেশের এমন কোনো রাজ্য বা শহর নেই যেখানে প্রতিবাদী জনতার পদভারে রাজপথ বা ময়দান উদ্বেলিত হচ্ছে না। আর তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ বা ক্যা ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি'র বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটা গ্রান্ড ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে। একটা ভারতব্যাপী চরিত্র পেয়েছে এই প্রতিবাদ। আর প্রতিবাদের রূপেও এসেছে বৈচিত্র্য। কোথাও প্রতিবাদ হিংস্র আকার নিচ্ছে কোথাও বা একেবারে সুশৃঙ্খল গণতান্ত্রিক চেহারা। মোদী-শাহর শাসক জোটের শরিকদের মধ্যেও তাই মতভেদ আজ চওড়া হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই আন্দোলন আরো একবার এ দেশের চলমান ধর্মের বিভাজনকে নস্যাৎ করে সমস্ত ধর্ম-বর্ণের মানুষকে এক মঞ্চে সমবেত করেছে।
দেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে তাঁরা পথে নেমেছেন। যা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে ইন্দিরা গান্ধীর ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালে বিহার থেকে শুরু হওয়া জয়প্রকাশ নারায়ণের 'টোটাল রেভল্যুশন' বা 'সামগ্রিক বিপ্লব' এক গণ আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল জরুরি অবস্থার সময় এবং তার ফলে সরকারও বদল হয়েছিল। যা আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে এবারের ভারতজোড়া বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ আন্দোলন। এছাড়া আমাদের স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল ২০০৮ সালের নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর নিয়ে নাগরিক সমাজের রাস্তায় নামা এবং জনমতে বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছিল। যার ফলে ২০০৬ সালে ২৩৪টি আসনে জিতে আসার দম্ভে সতেজ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সরকারকে বিদায় নিতে হল ২০১১ সালে। তবে নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশজুড়ে নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠলেও তার নির্বাচনি ফয়দা মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলগুলি কতটা তুলতে পারবে তা নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ আছে।  যদিও বা স্বতঃস্ফূর্ত বিরোধিতায় রাজ্যে রাজ্যে বিরোধী দলগুলি বিজেপির বিরুদ্ধে ভাল ফল করল, তাতেও দক্ষিণপন্থার সবচেয়ে আগ্রাসী রাজনীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিরোধী শক্তি তৈরী করা কঠিন কাজ। এ সমস্যা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে। শুধু একটা নাগরিকত্ব আইন বা একটা এনআরসির ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করে বিজেপির মতো শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা সম্ভব নয়। এই নাগরিক আন্দোলনে তাই একটি জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো সর্বজনগ্রাহ্য শক্তিশালী রাজনৈতিক মাথা চাই। চাই তীব্র  মতাদর্শগত লড়াই। সরকার নাগরিকরা চালায় না, চালায় নাগরিকদের ভোটে জিতে আসা রাজনীতিকরা। তাই এই গণআন্দোলনের আবেগকে ইভিএমে ট্রানস্লেট করার জন্য চাই মেধাবী ও গ্রহণযোগ্য রাজনীতিকদেরই। একমাত্র এইরকম রাজনৈতিক নেতৃত্বই নরেন্দ্র মোদীর অতিনাটকীয় মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে এক বিকল্প রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours