আহসান হাবিব, লেখক, বাংলাদেশ:

মানুষের সভ্য হয়ে ওঠার জার্নিটা দীর্ঘ। বিবর্তনের কোন একটা সময় যখন তার মস্তিষ্ক অন্য প্রাণীদের চেয়ে আলাদা হয়ে গেল এবং পরিব্যাপ্তির ফলে মানুষ নামক প্রজাতি হয়ে উঠলো, তখন তার নাম হলো 'হোমো সেপিয়েন্স' মানে বুদ্ধিদীপ্ত' প্রাণী। 
মানুষ যে বুদ্ধিমান প্রাণী এটার প্রধান মানদণ্ড কি? আমার বিবেচনায় ‘যুক্তি’ । কোনকিছু নির্মাণ বা আবিষ্কার করার প্রথমেই যে জিনিসটা তাকে এগিয়ে দেয় বা সহায়তা করে তা হল তার যুক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা । এই ক্ষমতা সে প্রকৃতি থেকে পেয়েছে । তার মস্তিষ্ক এই বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে এবং এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই সে এতকিছু আবিষ্কার করেছে, প্রকৃতিকে জয় করার পথে এগিয়ে গেছে এবং মনুষ্য সৃষ্ট মানব পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে । এসব প্রায় সকলের জানা কথা।

মানুষ যে সভ্যতা নির্মাণ করেছে, যুক্তি হচ্ছে তার প্রধান শক্তি । এই যুক্তি একটি বিমূর্ত শক্তি, এটা মানব দেহ থেকে প্রাপ্ত এক চেতনা যা আর শারীরিক থাকে না, হয়ে ওঠে আর এক বিমূর্ত ক্ষেত্র বুদ্ধিবৃত্তির অংশ । এই বুদ্ধিবৃত্তির পরিমাণ এবং রূপ মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে । মানুষ আর শারীরিক থাকি না, হয়ে উঠে বুদ্ধির অনুগত । এমনকি যে শারীরিক শ্রমে গড়ে ওঠে সভ্যতার উপাদানগুলি, সেগুলিতেও বিমূর্ত শক্তি লুকায়িত থাকে এবং সেসব মুল্যায়িত হয় বুদ্ধিবৃত্তির নিরিখে । বস্তুর একটা গুণ হচ্ছে এক শক্তি থেকে আর এক শক্তিতে রুপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা । ভৌত শক্তি আনবিক শক্তিতে রুপান্তর হয়ে সভ্যতা কোথায় চলে গিয়েছে, সামান্য তাকালেই দেখতে পাওয়া যায় । যদিও এটা বোঝার মত বুদ্ধি আবার সব মানুষ অর্জন করতে পারে নাই, কিছু মানুষ পেরেছে যা সমগ্র মানুষকে আলোকিত এবং সাহায্যপ্রাপ্ত করেছে। মানুষের দেহও একটি বস্তু, দেহের ভেতরে উতপাদিত চেতনা বাইরে এসে বুদ্ধিবৃত্তিতে রুপান্তর হয়, তখন তা আর আগের শক্তি থাকে না, হয়ে ওঠে তার চেয়েও শক্তিশালী । এটাও বস্তুর একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। আমরা যে কথা বলি, তার কম্পাঙ্ক প্রথমে থাকে খুবই কম কিন্তু প্রথম ধ্বনি যখন সে এগিয়ে চলে, ততই তীব্র হতে থাকে, কারণ যত সে এগিয়ে চলে তত সে মাধ্যম পরিবর্তন করে এবং প্রতিটির মাধ্যমের কম্পাঙ্ক নিয়ে গুণিতক আকারে বেড়ে চলে ।এইভাবে বুদ্ধিবৃত্তিও সামাজিক বুদ্ধিতে রুপান্তরিত হয়ে বেড়ে চলে । প্রথমে ছিল যা সামান্য শারীরিক, তা হয়ে ওঠে সামাজিক এবং তার চালিকা শক্তি।
এটাই বিকাশের নিয়ম । কিন্তু দেখা যায় সকলেই একই রকম ভাবে বিকশিত হয় না । শারীরিক শক্তিকে বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিতে রুপান্তর করতে সবাই পারে না । এটা একটা মানুষের বেলায় যেমন সত্য, একটা গোষ্ঠী, জাতি বা সম্প্রদায়ের জন্যও সত্য । এটা যারা যত অর্জন করতে পেরেছে, তারা তত বেশি সভ্যতা নির্মাণে ভুমিকা রেখেছে । আদিম মানুষের প্রধান শক্তিই ছিল শারীরিক শক্তি । বুদ্ধি ছিল সেই তুলনায় কম, তাই তারা শরীর দিয়েই জয় করতে চেয়েছে, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে । শারীরিক মানে নিছক তার বলপ্রয়োগের কথা বলছি । কোনকিছু নিজের অধিকারে আনতে মানুষ এই বলপ্রয়োগ করে এবং যার যত শক্তি অধিকার তার তত বেশি । কিন্তু বুদ্ধি বিপ্লবের ফলে এই শক্তির পরাজয় ঘটতে থাকে, তখন শরীর কেবল বল প্রয়োগের বিষয় থাকে না, বুদ্ধি দিয়ে আধিকারে আনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় । ক্রমে শারীরিক শক্তির উপর বুদ্ধিব্রিত্তিক শক্তির বিজয় ঘটে । কিন্তু সম্পূর্ণ বিজয় ঘটে না, এর অবশেষ রয়ে যায় । কোথাও কোথাও বেশি রয়ে যায় । এখনো মানুষের মধ্যে এই শারীরিক শক্তির আধিক্য দেখতে পাই । যান্ত্রিক শক্তিও একটা বলপ্রয়োগের মাধ্যম, সেখানে যুক্তির চেয়ে জোর বা ক্ষমতার প্রয়োগই বেশি । পৃথিবীতে এইসব দেখা যাচ্ছে । অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক বা যুক্তির জয় এখনো নিরঙ্কুশ তো নয়ই, বরং খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে।

কোনকিছু আবিস্কারেই শুধু নয়, বুদ্ধিবৃত্তি বা যুক্তির প্রয়োগ হয় সবচাইতে বেশি রাজনীতিতে । কারণ এখানে শারীরিক বিষয়ের চাইতে মনস্তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক বিষয়গুলি নিয়েই সমাজে বা রাষ্ট্রে সংগ্রাম জারি থাকে । এখানে যুক্তির শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়ে । কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, রাজনীতি ব্যর্থ হয় শারীরিক শক্তির আদিমতার কাছে, তখন মানুষ আর যুক্তিশীল থাকে না, হয়ে ওঠে শারীরিক বর্বর । ইতিহাসের যা কিছু অসংগতি, সেটিও দূর করতে হবে যুক্তির শ্রেয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে । যখনই এটা ঘাটতি পড়বে, শরীর এগিয়ে আসবে এবং নিজেকে আদিম পর্যায়ে ফেলে দেবে । এটা সভ্যতা নির্মাণের অন্তরায় । চিন্তার দিক থেকে যারা আদিম বা অবিকশিত তাদেরও সংঘবদ্ধতা থাকতে পারে, যা যুক্তি দিয়ে জয় করাই সেরা পথ । সমাজ যসব সময় প্রগতির পথে চলে, তবে তাকে লড়াই করতে করতে যেতে হয়, এখানে শারীরিক অংশগ্রহণে বুদ্ধি বা যুক্তির প্রয়োগেরই জয় হয়।

যা কিছু জয় করার তার প্রধান হাতিয়ার হোক বুদ্ধিবৃত্তির সেরা উপাদান ‘যুক্তি’ । শারীরিক আঘাত নিপাত যাক । ভিন্নমত দমনের যে আদিম শারীরিক আঘাতের প্রয়োগ তা মানব প্রজাতির নিজেরই লজ্জা।  সভ্যতা নির্মিত হোক এবং দাঁড়িয়ে থাকুক যুক্তি এবং মননশীল ভিত্তির উপর।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours