সন্দীপ চক্রবর্তী, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

শিরোনাম দেখে অনুগ্রহ করে বিভ্রান্ত হবেন না। এই ধ্বনিগুচ্ছ তৈরিতে বর্তমান নিবন্ধকারের কোনও হাত নেই। স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী সম্প্রতি শ্লোগান দিয়েছেন, ছি ছি ক্যা ক্যা ছি ছি! ছি ছি মানে ছিছিক্কার। আর ক্যা হল Citizenship Amendment Act বা CAA-র সংক্ষিপ্ত বাংলা সংস্করণ। সব মিলিয়ে ছি ছি ক্যা ক্যা ছি ছি। অস্বীকার করার উপায় নেই, ক্যা-র বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তিনি চান কেন্দ্র অবিলম্বে এই আইন বাতিল করুক। নয়তো, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গে আসা মুসলমানদেরও বৈধ নাগরিক বলে স্বীকার করুক। মমতা কেন এমনটি চাইছেন তা আজ আর কারও কাছে অস্পষ্ট নয়। বামপন্থী ঘরানার যে রাজনীতিতে তিনি হাত পাকিয়েছেন তাতে বিরোধী দলের অস্তিত্ব থাকলে চলে না। বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারাও বিরোধী শিবিরকে পুরো নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অপরিমেয় শক্তিবৃদ্ধি ঘটেছে। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এখন প্রধান বিরোধী দল এবং একুশের বিধানসভা নির্বাচনে মমতার কঠিন চ্যালেঞ্জার। মমতা বিলক্ষণ জানেন একুশের নির্বাচনে তার দলের জয় মোটেই সুনিশ্চিত নয়। তাই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত রোধ করার জন্য তিনি অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছেন। মোদী সরকারের যুগান্তকারী সংস্কারগুলির বিরুদ্ধে মানুষকে ক্রমাগত ভুল বুঝিয়ে, বিজেপির নেতাকর্মীদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা করে, তাদের একের পর এক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে এবং নরেন্দ্র মোদীকে লাগাতার ব্যক্তিগত আক্রমণ করে তিনি আসলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির গতি রোধ করতে চেয়েছেন। কিন্তু পারেননি। তিনি যে পারেননি তার প্রমাণ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আঠারোটি আসনে জয়লাভ। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলিতে বিজেপি হারলেও ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় তাদের ভোট বেড়েছে। ক্যা-র বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুদ্ধঘোষণাও একুশের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে।
 কিন্তু প্রশ্ন হল, বাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ নেতারা যেমনটি বলছেন, ক্যা কি সত্যিই মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী আইন? অমিত শাহ স্পষ্টই বলেছেন, ক্যা-র সঙ্গে ভারতের নাগরিক মুসলমানদের কোনও সম্পর্ক নেই। তারা এ দেশে যেমন সুরক্ষিত ছিলেন তেমনই থাকবেন। পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে যেসব হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে এসেছেন এই আইন তাদের জন্যই। ভারতে তারা শরণার্থী এবং ভারত তাদের নাগরিকত্ব দিয়ে সসম্মানে বেচে থাকার অধিকার দিতে চায়। এই আইনের সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানদের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না থাকলেও তিন প্রতিবেশী ইসলামিক দেশের মুসলমানদের সঙ্গে আছে। আইনে বলা হয়েছে, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের কোনও মুসলমান যদি জাতি বর্ণ এবং ধর্মের কারণে অত্যাচারিত হয়ে বা অত্যাচারের আশঙ্কা করে ভারতে চলে আসেন এবং তিনি যদি ভারতের নাগরিকত্ব প্রার্থনা করেন, তা হলে ভারত তা্র প্রার্থনা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবে।
ভারতের বাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদদের অশিক্ষিত ভাবার কোনও কারণ নেই। তারা জানেন এই আইন মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী নয়। তারা এটাও জানেন, ভারতের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে কেউ কখনও নিরাশ হয়নি। আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে আগ্রাসী ইসলামের থাবায় ক্ষতবিক্ষত পার্সিরা আরাধ্য অগ্নিদেবতার সম্ভ্রম রক্ষা করতে ভারতের পশ্চিম উপকূলে উপস্থিত হয়েছিল। গুজরাটের হিন্দু রাজা তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। কালক্রমে পার্সিরা এ দেশের ভূমিপুত্র হয়ে গেছে। ভারতের আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন দলাই লামা, তারেক ফতে, আদনান সামি এবং তসলিমা নসরিনও। ভারত কাউকে ফেরায়নি। বাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ নেতানেত্রীরা জানেন নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন শরণাগতকে আশ্রয় দেবার ভারতের যে প্রাচীন পরম্পরা তাকেই অনুসরণ করেছে মাত্র। তবুও তারা এই আইনের বিরোধিতা করছেন। তবুও তারা বিরোধিতা করবেন। আরও আগুন জ্বালবেন। তাদের ইন্ধনে একদল জহ্লাদ রেললাইন উপড়ে ফেলবে। রেলস্টেশন ভাঙচুর করে টিকিট কাউন্টার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা লুট করবে। প্রতিবাদের নামে তাদের ছোড়া পাথরে মাথা ফাটবে দুধের বাচ্চার।
 সব থেকে মজার ব্যাপার হল, যদি কোনও প্রতিবাদীকে জিজ্ঞাসা করা হয় কেন তারা এরকম করছেন, বেশিরভাগই উত্তর দিতে পারেন না। যারা উত্তরটা জানেন তারা বলেন, হামে ইয়ে সব করনে কে লিয়ে কাহা গ্যায়া হ্যায়। অর্থাৎ আমাদের এসব করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কে বলেছে? ওই নেতারা। বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতারা। কেন বলেছে? কারণ তাদের ভোট চাই। তার জন্য তারা গরিব অশিক্ষিত মানুষগুলোকে নির্বিচারে ব্যবহার করবেন। ততক্ষণ ব্যবহার করবেন যতক্ষণ না রক্তপাতে রক্তপাতে ভারতের জীর্ণ হতমান চেহারাটি আন্তর্জাতিক দুনিয়ার দৃষ্টিগোচর হয়। যতক্ষণ না আন্তর্জাতিক চাপের কাছে ভারত নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়।
বস্তুত, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই দেশজুড়ে তাণ্ডব চালানো হচ্ছে। উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট। এই তাণ্ডবের যারা হোতা তারা চাইছেন ক্যা-র বিরুদ্ধে সারা দেশে তথাকথিত স্বতঃস্ফূর্ত এই প্রতিবাদের প্রসঙ্গটি রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে উঠে আসুক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই পরিকল্পনা অনুসারেই রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে গণভোটের দাবি জানিয়েছেন। চীন বা পাকিস্তান ভারতের মতো একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারে না। তাই দাবিটি উঠেছে দেশের ভেতর থেকে। যদিও মমতা পরে এমন দাবি করার কথা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তার ভাষণের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সারা দেশ দেখেছে। সুতরাং এখন অস্বীকার করেও কোনও লাভ হবে না।
সবমিলিয়ে মনে হয়, দেশ দারুণ এক সংকটের মুখোমুখি। একদিকে ছি ছি ক্যা ক্যা ছি ছি, অন্যদিকে ক্ষমতা দখলের জন্য দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র। প্রাপ্তি বলতে একটাই। প্রতিবাদের নামে এই তাণ্ডব অনেক নেতার মুখোশ খুলে দিয়েছে। আগামীদিনে এভাবে বমাল সমেত ধরা পড়ে যাওয়ার দাম তাদের দিতেই হবে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours