গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

অনুজ্জ্বল তামাটে গায়ের রঙ, শারীরিক ভাবে সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও নেই, উচ্চতাও কম, অতি সাধারণ পোশাক, বলতে গেলে চোখে পড়ার মতো সেরকম কোনো কিছুই নেই, বলা ভালো গ্ল্যামারের ছিটেফোঁটাও নেই!  দীপ্ত ভঙ্গিতে ফ্লাইট থেকে নেমে হেঁটে বেরিয়ে আসছিলেন এক মহিলা, চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস, তিনি মুম্বাই এর কোনো ফিল্ম স্টার নন তবু এয়ারপোর্টের বাইরে প্রচুর মানুষ অপেক্ষা করছিল, শুধু তাকে এক ঝলক চোখের দেখা দেখবে বলে। তিনি ছিলেন ‘ফুলন দেবী’,  এই নামটার সাথে আমরা হয়তো সবাই কম বেশি পরিচিত, গব্বর সিং এর ফিমেল ভার্সান! মারকুটে দস্যু রাণী ফুলন দেবী!  হ্যাঁ স্বচক্ষে দেখেছিলাম, হাসতে হাসতে সবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাথা উঁচু করে দ্রুত হেঁটে আসছিলেন এক নির্যাতিতা বারংবার গণ ধর্ষিতা নারি!  দেখে কে বলবে যে এই মহিলাই নিজের হাতে দিয়েছিলেন একের পর এক বিকৃতকামী অত্যাচারী   পুরুষদের শাস্তি 'মৃত্যুদণ্ড' ! যেমন সারা ভারতবর্ষ উত্তাল করা 'বেহমাই হত্যাকাণ্ড' বা 'বেহমাই গণহত্যা',  যাতে বেশ কিছু নির্দোষ এবং দোষী ঠাকুরকে হত্যা করেছিলেন ফুলন দেবী, যার ফলে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ভি.পি.সিং পদত্যাগ করতে পর্যন্ত বাধ্য হন!  কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের সবটুকু ইতিহাস সত্যিই কি আমরা জানি!  হয়তো রোমাঞ্চকর ডাকাতির গল্পই শুনেছি, কিন্তু ঠিকঠাক জানাই নেই যে ভারতের নিচু সম্প্রদায় বলে পরিচিত মাল্লা বর্ণের  একটি সাধারণ হতদরিদ্র মেয়ের মর্মান্তিক কাহিনী! যে বাঁচতে চেয়েছিল আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই!  কিন্তু মাত্র এগারো বছর বয়স থেকেই তার শরীরে নেমে এসেছে একের পর পুরুষাঙ্গের নির্মম আঘাত!  পুরুষ তন্ত্রের অধিকার কায়েম করার চিরাচরিত পথে অত্যাচার, সারা জীবনে মোট কতবার ধর্ষিত হতে হয়েছে এই ফুলন দেবীকে হয়তো তিনিও মনে রাখতে পারেননি বা নিজের আত্মজীবনীতে পরিস্কার করে বলে যেতে চাননি! বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত যে কয়েকজন ভারতীয় নারি যুদ্ধ করে বিজয়ী হতে পেরেছেন, তাদের তালিকায় অবশ্যই বেশ উপরের দিকে থাকবে এই ফুলন দেবীর নাম! আইনের চোখে হতে পারেন তিনি সন্ত্রাসী কিন্তু নিচু জাতের মাল্লাদের কাছে তিনি সয়ং দেবী দূর্গা, মানুষ  রূপি অসুর নিধনকারী এক রক্ত মাংসের দেবী। ভন্ড মুখোশধারী মানুষের কটাক্ষ আর তাচ্ছিল্যকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে যিনি নিজের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারের গল্প বদলে দিয়েছিলেন, সমাজের ভদ্র আর শিক্ষিত উচ্চ বর্ণের কাছে তীব্র বিতর্কিত হওয়া সত্তেও একাই এক দুর্ধর্ষ যুদ্ধের গল্প রেখে গেছিলেন।  জীবনে একাধিক বার পুরুষ নিষ্ঠুরতার বলি হতে হতে আর পুলিশ বা প্রশাসনের কাছ থেকেও কোনো ন্যায় বিচার না পেয়েই হয়তো তিনি বাধ্য হয়ে বেছে নিয়েছিলেন ডাকাত জীবন!   সত্যিই এই অসহ্য যন্ত্রণার কাহিনী কি করে লেখা সম্ভব জানি না !  উত্তরপ্রদেশ পুলিশের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া এই ডাকাত রাণীর প্রথম জীবনের গল্প শুনলে প্রত্যেকটা বিবেক সম্পন্ন মানুষের চোখে জল আসতে বাধ্য।  আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাড়িয়ে সেই গল্পেই নাহয় আজ জেনে নেয়া যাক!
1963 তে আগস্ট মাসে ভারতের উত্তর প্রদেশের জালাউন জেলার গোহারা-কা-পুরওয়া নামের এক অজ-পাড়াগাঁয়ে হিন্দু ধর্মের নিম্ন বর্ন মাল্লার সম্প্রদায়ের অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় এক কন্যা শিশুর। যার নাম রাখা হয় ফুলন। সেদিন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি এই ফুলের মতো শিশুই একদিন কিংবদন্তি হয়ে যাবে। তাদের পারিবারিক পেশা ছিল নৌকা চালানো, ফুলন দেবীর পিতার মাত্র এক একর জমি ছিল, সেখানে তিনি কিছু নিমগাছ লাগিয়েছিলেন, তার পিতার স্বপ্ন ছিল সেই গাছ বিক্রি করেই দুই কন্যার বিয়ের যৌতুকের টাকা জোগাড় করবেন। সে সময়ে পিছিয়ে থাকা প্রত্যন্ত এই গ্রামে, মেয়েদের সমাজের বোঝা বা পণ্য ছাড়া আর কিছুই ভাবা হতো না!  অদৃষ্টের পরিহাসে ফুলনের যখন এগারো বছর বয়স, তখন তার নিজের দাদার মৃত্যু হলে ফুলনের বড় জ্যাঠা ও এক জ্যাঠতুতো ভাই 'মায়াদীন' মিলে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সমস্ত সম্পত্তি থেকে ফুলনের পিতাকে বঞ্চিত করে সামান্য জমিটুকুও নিজেদের নামে করে নেয়।   ফুলনের পিতা সেভাবে প্রতিবাদ না করলেও কিন্তু সেই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করে ছোট্ট থেকেই অসীম সাহসী ফুলন।  ওই মায়াদীন কে চোর ও প্রতারক বলে সারা গ্রামে একাই প্রচার করতে শুরু করে, তার সঙ্গে প্রকাশ্যে নানান গালিও দিতে থাকে,  সে সময়ে ওইসব পিছিয়ে থাকা সমাজে কোন নারী এইভাবে উচ্চস্বরে কোনো পুরুষকে সাধারণত আক্রমণ করার সাহস দেখায় নি!  এমনকি অবিশ্বাস্য মনে হলেও মায়াদীন ও ফুলনের মধ্যে মারামারির বা হাতাহাতির ও ঘটনা ঘটে অনেকবার !  এর ফলে ফুলনের প্রতি সমাজের মোড়ল বা অন্যরা খারাপ মন্তব্য করতে শুরু করে!  অন্যায় ভাবে ফুলনের পরিবারের ওপর চাপ শৃষ্টি করতে থাকে, এই পরিস্থিতিতে মাত্র এগারো বছর বয়সে কন্যাপণ হিসেবে গরুর বিনিময়ে ফুলনের বিবাহ দেয়া হয় তার থেকে তিন গুণ বয়সে বড়ো পুট্টিলাল নামের এক অসৎ চরিত্রের পুরুষেরসাথে!  এই বিকৃতিকামী পুট্টিলাল অপ্রাপ্তবয়স্ক ফুলনকে, স্বামীর অধিকারের সুযোগ নিয়ে, বিকৃত কাম চরিতার্থ   করার জন্য প্রতিদিন জোর করে ধর্ষণ ও নানান শারীরিক নির্যাতন করা শুরু করে!  স্বামীর এই পাশবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নাবালিকা ফুলন বাধ্য হয়ে আবার তার পিতার কাছে ফিরে আসে।  কিন্তু তাতেও নিস্তার মেলে না, পিতৃগৃহে ফিরেই এবার সেই জ্যাঠতুতো ভাই মায়াদীন এর পুরোনো জমে থাকা রোষানলে পড়তে হয় তাকে। এরপর অতীতের অপমান ও সম্পত্তির ব্যাপারে পথের একমাত্র কাঁটা দুর করতে, মায়াদীন ফুলনের বিরুদ্ধে মিথ্যা চুরির অভিযোগ এনে থানায় অভিযোগ দায়ের করে, এবং থানার পুলিশ-কর্তাদের ঘুষ দিয়ে ফুলনকে বিনা দোষে গ্রেফতার করায়।  একদম হিন্দী সিনেমা! শুধু অসংখ্য খলনায়ক আছে কিন্তু কোনো নায়ক নেই এই চিত্রনাট্যে! এরপর থানায় গিয়েও নির্মম নির্যাতনের শিকার হয় ফুলন, আইনরক্ষকদের হাতেই ধর্ষিতা হতে হয় একাধিক বার ফুলনকে !  শুধু তাই নয় তিনি ধরে নির্যাতনের পর তাকে রীতিমতো শাসানি দেওয়া হয় বাইরে গিয়ে সে আর কখনো এইসব বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না করে!  আর পাঁচটা সাধারণ নারীর মত যেন চুপচাপ জীবন যাপন করে!  পুলিশের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নিরুপায় ফুলনের পরিবার আবার ফুলনের শশুর ও তার স্বামীকে পীড়াপীড়ি করতে থাকে, যাতে তারা আবার ফুলনকে শ্বশুরবাড়িতে ফেরত নিয়ে নেয়!  স্বাধীন ভারতে এটাই কিন্তু সার্বিক চিত্র দরিদ্র মেয়েদের!  তখন তার বয়স ষোলো হয়ে গেছে।  ফুলনের শশুর বাড়ীর লোকজনকে বলা হয় ফুলন এখন বড়ো হয়ে গেছে, সব বুঝতে শিখে গেছে,  তাই একবার যদি ফুলনকে একটা সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে সে এবার মুখবন্ধ রাখবে আর শ্বশুরবাড়িতে ঠিক মানিয়ে নেবে! অদৃষ্টের কি পরিহাস!  তবুও কিন্তু ফুলনের শ্বশুরবাড়ি কোনভাবেই রাজি না হওয়ায়, আবার কিছু যৌতুক দেওয়ারা শর্তে শেষপর্যন্ত তাদের রাজি করানো হয়। স্বামীর ঘরে আবার ফিরে যায় কিশোরী ফুলন দেবী।  কিন্তু শান্তি ফিরল না ফুলনের জীবনে, আবারও শুরু হয়ে যায় একই যৌন-নির্যাতন!  বিকৃতকামী স্বামীর লালসা নিবারণে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগের মাত্রা বাড়াতেই থাকে রাতের পর রাত! শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনাও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে! পাকাপাকিভাবে এবার স্বামীর ঘর ছেড়ে পিতৃগৃহে চলে আসতে বাধ্য হয় ফুলন।  শশুড় বাড়ি থেকেও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়, এরপর তারা আর কোনভাবেই ফুলনকে গ্রহণ করবে না।  সেসময়  ভারতীয় সমাজ স্বামীগৃহ থেকে ফেরত আসা কোন নারীকে ভাল চোখে তো দেখাই হোতো না বরং নানান গঞ্জনা আর প্রতি পদে লাঞ্ছনা দেওয়া হতো। ফুলনকেও তাই ঘরে বাইরে নানান গঞ্জনা আর লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছে পদে পদে!  এরপরই বিতর্কিত ভাবে 1979 এ এক ডাকাত দলের সাথে জড়িয়ে যায় ফুলনের জীবন!  কিভাবে সে জড়িয়ে গেল এ নিয়ে রয়েছে অনেক রহস্য! কেউ বলেন সেই ডাকাত দল ফুলনের অগ্নিমূর্তি ও সাহসী স্বভাবের কারণেই তাকে অপহরণ করে! আবার কেউ বলেন ফুলন সেচ্ছায় নিজের ওপর ঘটে যাওয়া ক্রমাগত অন্যায় নির্যাতন ও অপমানের প্রতিশোধ নিতেই ডাকাত দলের সাথে যোগ দেয়।  এ বিষয়ে নিজের আত্নজীবনীতেও পরিষ্কার করে কিছু বলেননি ফুলন দেবী,  শুধু লিখেছেন "এটা ছিল ভাগ্যের লিখন"...কিন্তু হতভাগ্য ফুলনের ভাগ্যে যেন লেখাই আছে বারবার নির্যাতনের শিকার হওয়ার যন্ত্রণা !  যে ডাকাত দলে ফুলন আশ্রয় নেয়, অচিরেই তার দলনেতা বাবু গুজ্জর এর কুনজরে পড়ে যায় ফুলন,  বাবু গুজ্জর নানাভাবে ছলে বলে কৌশলে চেষ্টা শুরু করে ফুলনকে তার শয্যা সঙ্গনী করার, শেষে সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে, নিয়তির সেই একই পরিহাসে বাবু গুজ্জরও ফুলনকে ধর্ষনের চেষ্টা করে!  কিন্তু তখনই ফুলনের জীবনে প্রথম নায়ক হিসেবে আবির্ভাব হয় এক পুরুষের!  সে ছিল  ডাকাত দলের দ্বিতীয় দলনেতা বিক্রম মাল্লা, সেই যাত্রার বাবু গুজ্জরকে হত্যা করে ফুলনকে রক্ষা করে এই বিক্রম এবং তারপর বিক্রম মাল্লা হয়ে যায় সেই ডাকাত দলের নেতা। ফুলন জীবনে প্রথমবার আকৃষ্ট হয় কোনো এক পুরুষের প্রতি,  তাঁর সন্মান রক্ষা করা বিক্রম মাল্লার প্রেমে পড়ে যায় ফুলন।  অবশেষে বিক্রম ফুলনকে বিবাহ করে স্ত্রীর মর্যদা দেন।  ধীরে ধীরে ফুলন স্বামী বিক্রম মাল্লার কাছ থেকে থেকে বন্দুক চলানো শিখে নেয়।  প্রথমে স্বামীর সাথে উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশের অত্যাচারী সব উচ্চ বর্নের লোকদের গ্রামে ডাকাতি, লুন্ঠন, অপহরন শুরু করে, তারপর রেল ডাকাতি ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযানেও সঙ্গী হিসেবে নিজের সাহসিকতা পরিচয় দিতে থাকে ফুলন।  এইভাবেই দলের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফুলন, হয়ে ওঠে দস্যুরাণী ফুলন দেবী।  এরকমই এক সময় ফুলন দেবী দলীয় সদস্যদের সাথে নিয়ে একদিন ফুলনের প্রথম স্বামী পুট্টিলালকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য তার গ্রাম আক্রমণ করে, সেখানে পৌছে,  পুট্টিলালকে খুঁজে বের করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসে প্রকাশ্য জনসমক্ষে তাকে নিজের হাতে শাস্তি দেওয়ার জন্য, প্রথমে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে বন্দুক দিয়ে বেদম প্রহার করে পুট্টিলালকে, তারপর মৃতপ্রায় পুট্টিলালকে গ্রামের মানুষের সামনে ফেলে রেখে চলে যায়। এখানেই শেষ নয়, যাওয়ার আগে কম বয়সী মেয়েদের বিবাহ ও নির্যাতন বন্ধ করার জন্য  পুরুষদের উদ্দেশ্যে এক সাবধানবানী সহ একটি খোলা চিঠি রেখে যান। তারপর সময় পেরিয়ে গেছে, ফুলনের ডাকাত রাণী হিসেবে পরিচিত বেড়েছে ক্রমশ, এরপরই সেই বিতর্কিত বেহমাই হত্যাকাণ্ড! যে ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়ে যায় সারা দেশ।  অবস্থাপন্ন এবং উচ্চবর্ণের ঠাকুর সম্প্রদায়ের একজন 'শ্রী-রাম' ছিলেন দুর্ধর্ষ ডাকাত আর ঘটনাচক্রে ফুলনের স্বামী বিক্রম মাল্লার গুরু। সেই শ্রী-রাম ও তাঁর ভাই লালা-রাম সেই সময় জেলে আটক ছিল, ফুলনের স্বামী বিক্রম আশি হাজার টাকা খরচা করে তাঁদের জামিনে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনে।
এখানেই মস্ত বড় এক ভুল করে বসে বিক্রম,  শ্রী-রাম জেল থেকে বেরিয়েই ডাকাত দলের নেতৃত্ব নিজের হাতে নেয়ার প্রস্তাব জানায়, কিন্তু সেসময় দলের মাল্লা সম্প্রদায়ের সদস্যরা এই প্রস্তাবের তিব্র বিরোধিতা করে। এরপরই ফুলন ও বিক্রমের ডাকাতদল দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পরিস্কার বিভেদরেখা তৈরী হয় ঠাকুর ও মাল্লা সম্প্রদায়ের মধ্যে,  ডাকাত দলের ঠাকুর সম্প্রদায়ের সদস্যরা শ্রী রামের আর মাল্লা সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিক্রমের পক্ষ নেয়।  এই অবস্থা চরমে পৌছোয়, অকৃতজ্ঞ  শ্রী-রাম ষড়যন্ত্র শুরু করে, বিক্রেমকে হত্যা করার সুযোগের খুজতে থাকে।  একবার তো একটি বিবাহের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে কোনো এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি বিক্রমকে লক্ষ্য করে গুলিও চালায়, কিন্তু সেবার ভাগ্যক্রমে সামান্য আহত হলেও বিক্রম বেঁচে যায়।  এরপর আবার চেষ্টা করা হয় এবং  সেই দ্বিতীয় চেষ্টায় সফল হয় শ্রী-রাম, বিক্রমকে হত্যা করে সেই হত্যার জন্য ফুলনকে দায়ি করে, মিথ্যে অপবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয় ফুলনের নামে, সুকৌশলে প্রচার করে দেওয়া হয় দলনেতা হওয়ার লোভে ফুলনই বিক্রমকে হত্যা করেছে।  বিক্রমকে সরিয়ে দেওয়ার পর শ্রী-রাম ফুলনকে আটক করে, তারপর প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় ফুলনকে ঠাকুরদের গ্রাম বেহমাই এ নিয়ে যায়।  সেখানেই বিচারসভা বসানো হয়, বিক্রমকে হত্যা করার অপরাধে ফুলনকে শাস্তি দেওয়ার জন্য স্থানীয় গ্রামবাসীদের আহবান করা হয়, শাস্তিস্বরূপ প্রথমে শ্রী-রাম নিজেই ফুলনকে ধর্ষণ করে, তারপর একে একে ঠাকুর সম্প্রদায়ের অনেকেই ফুলনের ওপর যৌন ও শারীরিক নির্যাতন চালায় ও ধর্ষণ করে!  লাগাতার তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ফুলনের ওপর চলে এই পাশবিক অত্যাচার, একাধিকবার ধর্ষণ ও যৌন অত্যাচার করে তেইশ দিন পর মৃত ভেবে অজ্ঞান ফুলনকে  ফেলে রেখে যাওয়া হয়!  কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়তো অর্ধমৃত ফুলনের জ্ঞান ফিরে আসে, এরপর  ফুলন এক সহৃদয় ব্রাহ্মণের সহায়তায় বেহমাই গ্রাম থেকে পালাতে সক্ষম হয়।  আবার নতুন করে শুরু হয়ে যায় প্রতিশোধ নেওয়ার লড়াই, ফুলনের তখন ডাকাত হিসেবে একটা পরিচিত তৈরী হয়েছে, অন্য একটি ডাকাত দলের সাথে যোগাযোগ করে ফুলন এবং তাদের কাছে নিজের জীবনের নির্যাতন ও অত্যাচারের কাহিনী শোনায়,  সেই ডাকাত দলের কাছে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেন।  ফুলনের ওপর এই নৃশংস ও পাশবিক নির্যতনের কাহিনী শুনে ওই ডাকাত দলের নেতা বাবা মুস্তাকিন ফুলনকে নতুনভাবে একটি ডাকাতের দল গঠন করতে সাহায্য করে।  প্রতিশোধের আগুন বুকে নিয়ে জেদী ফুলন শুধু অপেক্ষা করতে থাকে, দিন গুনতে থাকে একটা একটা করে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একদিন ফুলন পৌছে যায় তার নতুন ডাকাত দল নিয়ে বেহমাই গ্রামের উদ্দেশ্যে, 1981 এর 14  ফেব্রয়ারী শ্রী-রাম ও তার ভাই লাল রামকে হত্যা করার জন্য ফুলন বেহমাই গ্রামে প্রবেশ করে,  সেই সময় বেহমাই গ্রামে ঠাকুরদের একটি পারিবারিক বিবাহ উৎসব চলছিল,  ফুলন ও তার ডাকাতদল ঘিরে ফেলে সেই গ্রাম, তারপর সম্পূর্ণ গ্রাম তন্নতন্ন করে খুজেও ওই শ্রী-রাম ও তার ভাই কে খুঁজে পাওয়া যায় না, এরপর ফুলন রাম ভাতৃদ্বয়কে তাঁর হাতে তুলে দেয়ার জন্য ঠাকুর সম্প্রদায়ের উপস্থিত অন্যদের সদস্যদের আদেশ করেন, ফুলনের মনে হয়েছিল ঠাকুররা হয়তো ইচ্ছে করেই রাম ভাতৃদ্বয়কে লুকিয়ে রেখেছে, কিন্তু উপস্থিত ঠাকুররা সেই আদেশ মানতে অস্বীকার করলে ডাকাত দল অত্যন্ত ক্রোধে, ঠাকুর সম্প্রদায়ের যুবকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়, এর ফলে  ঠাকুর সম্প্রদায়ের বাইশ জন যুবক ওখানেই মারা যায়।  যদিও পরবর্তী কালে যেকোনো কারণেই হোক ফুলন দেবী নিজহাতে ওই গুলি করে হত্যার কথা অস্বীকার করেছেন ! তার বক্তব্য ছিল ডাকাত দলের অন্যান্য সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়েই গুলি চালিয়ে ফেলেছিল!  এবং অনিচ্ছাকৃত ভাবে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল বলে দাবী করেন!  যাইহোক এই ঘটনায় ঠাকুরদের হাতে অত্যাচারিত নির্যাতিত গরিব মানুষের চোখে ফুলনদেবী অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন দস্যুরাণী ফুলন দেবী হয়ে যান মায়া রাণী।  রূপকথার মতো ছড়িয়ে গেছিলো সেই সময় ফুলনের বীরত্বের কথা, নিম্ন দলিত সম্প্রদায়ের চোখে ফুলন দেবী হয়ে ওঠেন সাক্ষাত্  দূর্গা দূর্গতিনাসিনি!  উত্তর প্রদেশের গ্রামে গঞ্জে দুর্গার বেশে ফুলনের মূর্তি বিক্রিও শুরু হয়ে যায় বলে শোনা যায়।  এই ভয়ানক বেহমাই হত্যাকাণ্ড সারা ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল,  নেতা মন্ত্রী থেকে শুরু করে ওপর থেকে নিচুতলার পুলিশ কর্মীদের রাতের ঘুম উড়ে যায়!   সরকারের একদম শীর্ষ পর্যায় থেকে পুলিশের উপর প্রচন্ড চাপ শৃষ্টি করা হয়, যে কোনো মূল্যে, যে কোনো ভাবেই, জীবিত বা মৃত দস্যুরাণী ফুলন দেবীকে গ্রেপ্তার করতেই হবে।  ফুলনের মাথার দাম ঘোষণাও করা হয়, লাগনো হয় বিভিন্ন গুপ্তচরদের ফুলনের খবর জোগাড় করার জন্য, এতো কিছুর পরও ফুলনকে গ্রেফতার করতে না পেরে, এবার মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ ও প্রশাসন,  ফুলনের উপর মানসিক চাপ তৈরি করতে ফূলনের গ্রামের বাড়ী ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়, তারপর ফুলনের মা-বাবাকে পর্যন্ত পুলিশ গ্রেপ্তার করে!  পুলিশের ক্রমাগত হামলায় ফুলনের দলের বহুসংখ্যক ডাকাত সদস্যের মৃত্যু ঘটে।  ফুলন ক্রমাগত রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে লড়াই করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়ে।  শেষপর্যন্ত   ফুলন দেবী আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু অবিচল ফুলন এরপরও ভেঙে না পড়ে বেশ কয়েকটি শর্ত রাখেন সরকার পক্ষের কাছে, ফুলনের শর্ত গুলো অনেকটা এরকম ছিল:-  ফুলন ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গীরা কেবল মধ্যপ্রদেশেই আত্মসমর্পন করবে, আর বিচারের জন্য তাঁদের কোনো ভাবেই উত্তরপ্রদেশে নিয়ে যাওয়া যাবে না। বিচারে কিছুতেই ফাঁসীর আদেশ দেওয়া যাবে না এবং সর্বোচ্চ আট বছরের বেশি কারাদণ্ড দেওয়া যাবে না।  ফুলনের সেই জ্যাঠতুতো ভাই মায়াদীন এর অন্যায় ভাবে দখল করে নেওয়া সব জমি আবার ফুলনের পিতাকে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।  ফুলনের পিতা মাতাকে উত্তরপ্রদেশে নয় মধ্যপ্রদেশে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।  সরকার ফুলনের প্রত্যেকটা শর্ত ই মেনে নিতে সন্মত হয়, বলা ভালো পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়!  কারণ সরকারের কাছে সে সময় ফুলনকে যে কোনো মূল্যে গ্রেপ্তার করার একটা অসম্ভব চাপ তৈরি হয়েছিল!  বলা যায় সরকারের prestige issue!  এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন সরকারের চোখে কিন্তু দস্যু রাণী ফুলন দেবী।  1983 তে ফেব্রুয়ারি মাসে শেষপর্যন্ত আত্মসমর্পন করেন ফুলন দেবী।  অসংখ্য মানুষের ভীড়ে, খাকী পোশাক পরে, গায়ে একটি লাল চাদর জড়িয়ে, মাথায় লাল কাপড়ের ফেট্টি বেঁধে, কাধে একটি বন্দুক নিয়ে ধীর পায়ে মঞ্চে উঠলেন ফুলন দেবী, শান্ত এবং স্থির ভঙ্গিতে হাতজোড় করে জনসাধারনকে নমস্কার জানিয়ে, মহাত্মা গান্ধীর ছবির সামনে তার দীর্ঘদিনের প্রতিবাদের সঙ্গী বন্দুকটি নামিয়ে রেখে আত্মসমর্পণ করলেন!  শেষ হলো একটা অধ্যায়!  শেষ করে দেওয়া হলো নিম্ন দলিত সম্প্রদায়ের ওপর উচ্চ শ্রেণীর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী নারীর অসম লড়াই!  শেষ করে দেওয়া হলো নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা এক ডাকাত রাণীর অবিস্মরণীয় লড়াই!  ইতিহাস সাক্ষী আছে গণ-ধর্ষণের শিকার হয়ে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে গিয়ে, তার বদলা নেওয়া এক জেদী নারীর ডাকাত জীবন! আত্মসমর্পণের পর ফুলন দেবী সরকারের রাখা সবরকম শর্ত মেনে নিলেও সরকার কিন্তু ফুলনের একটি শর্ত ভঙ্গ করেছিল।  তাঁকে আট বছরের বদলে এগারো বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়!  দীর্ঘ এগারো বছর কারাবাসের পর 1994 এ ফুলন দেবী  কারাগার থেকে মুক্তি পায়। এরপর শুরু হয় ফুলনের নতুন রাজনৈতিক জীবন, দস্যু-রাণী থেকে জন-নেত্রী হয়ে ওঠা, ভারতীয় সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিং যাদব এর হাত ধরে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন ফুলন দেবী। 1996 এ বহু বিতর্ক আর অপপ্রচার সত্তেও সমাজবাদী পার্টি থেকে ফুলন দেবীকে মননোয়ন দেওয়া হয়, তারপর উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর আসন থেকে সংসদ নির্বাচিত হন ফুলন দেবী।  তবে ফুলনকে ওই নির্বাচনে হারানোর জন্য রাজনৈতিক ভাবে ও  বেহমাই হত্যাকাণ্ডে নিহত হওয়া ঠাকুরের পরিবারের শক্তিশালী বিরোধিতার সামনে পড়তে হয়েছিল।  তবু আম-জনতার অকৃপণ ভালোবাসা আর দলিতদের আশীর্বাদ ও ভরসায় নির্বাচনে ফুলন দেবী শেষপর্যন্ত বিজয়ী হন, প্রমাণ করে দেন সাধারণ মানুষ ফুলন দেবীকে ভুল বোঝেননি, দস্যুরাণী ফুলনকে নির্বাচনে জিতিয়ে প্রমাণ করে দেয় ফুলন দেবী ডাকাতি করলেও তা ছিল নিছকই উচ্চ বর্গের অন্যায় অত্যাচারের যোগ্য জবাব!  এরপর যদিও 1998 এ মধ্যবর্তী নির্বাচনে ফুলন পরাজিত হন, কিন্তু আবার 1999 এ মির্জাপুর লোকসভা নির্বাচনে তিনি পুনরায় বিজয়ী হন। ডাকাত হয়েও এত জনপ্রিয়তার কারণ অবশ্যই গবেষণার জন্য একটি আদর্শ বিষয়, তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যেতেই পারে,  ফুলন দেবী সারাজীবন সমজের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে থেকেছেন, বিশেষত নির্যাতিতা নারীদের পক্ষে তো অবশ্যই প্রবল ভাবে থেকেছেন।  অনেক নির্যাতিত মানুষকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন। আর গরিব অত্যাচারিত মনুষও মন থেকে বিশ্বাস করেছিল ফুলন দেবীর ডাকাত হওয়ার পেছনে রয়েছে তার নির্মম অতীত, বারংবার গণধর্ষণের শিকার হওয়ার চরম যন্ত্রণা!  হয়তো এই কারণেই তিনি পেয়ছিলেন সাধারন মানুষের দ্বিধাহীন সহানুভূতি, দস্যুরানী হয়েও তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনেকের হৃদয়ে রানী, এমনকি অনেকের চোখে অসুর নিধনকারী দেবী দুর্গা!   25 জুলাই 2001,  ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে, ফুলন দেবী সংসদ  থাকা অবস্থায় সংসদীয় অধিবেশন চলাকালীন, শেষপর্যন্ত তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়! লোকসভার অধিবেশনে যোগ দিয়ে তিনি যখন দিল্লির অশোকা রোডে নিজের বাড়িতে ঢুকতে যাবেন, তখন বাড়ির সামনেই তিনজন মুখোশধারী এলোপাতাড়ি গুলি করে, চির-হতভাগ্য ফুলন দেবীকে শেষপর্যন্ত নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করে। শের সিং রানা এবং তার সহযোগী ধীরাজ রানা ও রাজবীর নামের আরও দুজন পরে এই খুনের কথা স্বীকারও করে নেয়।  তারা ছিল সেই অত্যাচারী ঠাকুর বংশের সন্তান এবং তারা নাকি তাদের বিধবা মায়েদের অশ্রু মোছানোর জন্যই ফুলনকে হত্যা করেছে!!  পরবর্তী সময়ে 'ক্ষত্রিয় স্বাভিমান আন্দোলন কমিটি' নামক এক সংগঠন ক্ষত্রিয়ের মর্যদা অক্ষুন্ন রাখা ও বেহমাই হত্যাকাণ্ডের বিধবাদের অশ্রুর মর্যদা দেওয়ার জন্য শ্বের সিং কে সন্মানিতও করে!  কি বিচিত্র এই মহামানবের দেশের এই বীর 'ক্ষত্রিয় স্বাভিমান আন্দোলন কমিটি' !  আত্মমর্যাদা কি শুধু ক্ষত্রিয়দের একচেটিয়া আর দলিতদের কোনো আত্মমর্যাদা থাকতে নেই! দলিতদের মেয়েদের বিচারের নামে ধর্ষণ করা তাদের চোখে ন্যায়সঙ্গত! তারা বিচার পাবে না! কোনো প্রতিবাদ করা যাবে না!  দলিতদের শুধু লালসার শিকার হতে হবে, ধর্ষিতা হতে হবে!  যাইহোক সেই বীর ক্ষত্রিয় শের সিংহ রানা, যাকে ফুলান দেবী হত্যার জন্য দায়ী করা হয়, ধরা পড়ার পর তিনি একবার  তিহার জেল থেকে পালিয়ে যেতেও সক্ষম হন, পরে যদিও এই কলকাতারই ধর্মতলা থেকে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল তাকে আবার গ্রেপ্তার করে।  রনাকে দীর্ঘ বিচারের পরে ফুলন দেবীকে হত্যা এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দণ্ডিত করে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত,  যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এক লক্ষ টাকা জরিমানাও করা হয়েছিল।   এই ফুলন দেবী হত্যাকাণ্ডে আবার এক নতুন চাঞ্চল্যকর তথ্যও উঠে এসেছে, ফুলনের বোন মুন্নি দেবী এই ঘটনায় আবার  অভিযুক্ত শের সিং এর সমর্থনে এগিয়ে এসে এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, আসল তথ্য গোপন করে নাকি শের সিং কে ফাঁসানো হয়েছে! তিনি সরাসরি ফুলনের দ্বিতীয় স্বামী উমেদ সিং কেই ফুলন হত্যার আসল অপরাধী হিসেবে দায়ী করেন!  শুধু তাই নয় এই ঘটনায় তৎকালিন সরকারের গভীর ষড়যন্ত্র আছে বলেও দাবি করেছিলেন!
ফুলন দেবীকে নিয়ে নানান প্রচলিত কাহিনী শোনা যায়, সত্যি মিথ্যে সব কথা হয়তো ফুলনের আত্মজীবনী থেকেও কোনোদিন জানা সম্ভব নয়।  বিভিন্ন ভাষায় ফুলন দেবীকে নিয়ে গল্প, নাটক, যাত্রা এবং সিনেমা তৈরী হয়েছে, আর সবকিছুই বানিজ্যিক ভাবে সফল হয়েছে, এর মধ্যে  সবথেকে সাড়া ফেলে দিয়েছিল, 'ব্যান্ডিট কুইন' নামের একটি হিন্দী সিনেমা। ফুলন দেবীর জীবদ্দশায় মুক্তিপ্রাপ্ত এই  সিনেমায় তাঁকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার অভিযোগে আবার একটি মামলাও করেন ফুলন দেবী,  সেইা মমলায় ফুলন দেবী জয়ী হন এবং প্রায় চল্লিশ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপুরন দিতে বাধ্য করেন প্রযোজনা সংস্থাকে।
ছোটবেলা থেকেই নির্যাতিত হয়ে এসেছেন একটি হতদরিদ্র দলিত মেয়ে যার নাম ফুলন দেবী।  তার গ্রামেই ছিল ঠাকুর বংশের জমিদারদের বসবাস, তাদের লোকেরা যখনতখন এসে তাদের ক্ষেতের ফসল কেটে নিয়ে যেত, গরিব দলিত মানুষদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালাত।  ফুলন ই প্রথম এইসব অন্যায়ের প্রতিবাদে সাহস করে গর্জে ওঠেন।  নিশ্চিত করে বলা যেতেই পারে, এর ফলেই তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার, ধর্ষিতা হতে হয় তারপর স্বামী পরিত্যক্তা ফুলনকে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তিও করতে হয়! তারপর ধীরে ধীরে একসময় পুরোদস্তর ডাকাত হয়ে যান তিনি।আমারা অজ্ঞতা বসত যে কোনো দুরন্ত বা দস্যি মেয়েকে দেখলেই 'ফুলন দেবী' বলে বসি!  এটা হয়তো আমরা ঠিক কাজ করি না!  সত্যিই তো কতটুকুই বা জানি আমরা এই ফুলন দেবীর জীবন সম্পর্কে!  ফুলন দেবী একজন ডাকাতরাণী এইটুকুই তার পরিচয় হতে পারে না!   তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক নির্ভীক দলিত নারী, সমাজের নির্যাতিত নারীদের প্রতিনিধি।    রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দুবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও হলেও, সেটা কখনোই তার আসল পরিচয় হতে পারে না !  ডাকাত রাণী হওয়ার পেছনে ছিল তার নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়ানোর অনন্য প্রয়াস, অপরাধ জীবনের বেশিরভাগ অপরাধই তিনি সংঘটিত করেছেন নির্যাতিত নারীদের প্রতিনিধি হয়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য।  দস্যু হওয়া সত্ত্বেও তাই অনেকের কাছে আজও তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, এমনকি তার মুখের আদলে একসময় দেবী দুর্গার প্রতীমাও গড়া হয়েছে!  বিতর্ক কখনও ফুলন দেবীর পিছু ছাড়েনি, তার ছবি নিয়েও জন্ম নেয় আরেক বির্তক! ঘটনাটি ইন্দোরের এক রেল স্টেশনের, সরকারি ভাবে আঁকা হয়েছিল তাঁর ছবি স্টেশনের দেওলে, সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রকল্পে ওই স্টেশনে মোট পঁয়ত্রিশটি ছবি আঁকা হয়। সেখানে ছিলেন মাদার টেরিজা, রানী লক্ষ্মীবাইরাও আর তাদের ছবির সঙ্গে ছিল ফুলন দেবীর ছবি,  এরপরই রাজপুত সম্প্রদায়ের পক্ষ  থেকে শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ!  কেন ফুলন দেবীর ছবি দেওয়ালে থাকবে!  শুরু হয় প্রশ্ন তোলা, একজন দস্যু হিসেবে ভারতীয় সামাজিকতায় তার কি ভূমিকা বা অবদান থাকতে পারে!  এরপরই তড়িঘড়ি মুছে ফেলা হয় ফুলনের ছবি স্টেশনের দেওয়াল থেকে!  কিন্তু তারপরই তৈরি হয় আর একটি বিতর্ক, ফুলন দেবী যেহেতু মাল্লা সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন, তাই স্থানীয় মাল্লা সসম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে দেখা দেয় চরম ক্ষোভ।   দস্যু হলেও কিন্তু সাধারণ মানুষের মন জয় করতে পেরেছিলেন ফুলন দেবী,  তাই একাধিক বার গণ-ধর্ষিতা এক অভিমানী নারীর সম্পূর্ণ জীবনকাহিনী না জেনেই অনায়াসে শুধু এক দুর্ধর্ষ ডাকাত রাণীর গল্প বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না !  উচ্চ শ্রেণীর মানুষের কটাক্ষকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে যিনি নিজের হাতেই নিজের দুর্দশার গল্প বদলে দিয়েছিলেন!  ভদ্র সমাজের চোখে কিংবা সমাজের উচ্চ বর্ণের বিরুদ্ধে এক তীব্র বিতর্কিত সংগ্রামের গল্প রেখে গেছেন!  আজকের ভারতবর্ষে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও আজও গণ ধর্ষণের মতো নৃশংস ঘটনা ঘটেছে, বিচারের নামে প্রহসন চলছে!  বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে! তাই হয়তো এই ফুলন দেবীর মতো নারীদের আজ খুব প্রয়োজন!  যাঁরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই বদলে দিতে জানেন!  নিজের পরিচয় নিজেই গড়ে নিতেন জানেন!  ধর্ষণের যথাযোগ্য বদলা নিতে জানেন!  তাই ভাবার সময় এসেছে, আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে  ফুলন দেবীকে ঘৃণার চোখে দেখবেন, নাকি তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত করবেন, এটা অবশ্যই আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত! তবু ভেবে দেখবেন বিশেষত নারীদের তো ভেবে দেখতেই হবে...

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours