গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

নাম ছিল তার 'অক্টারলোনি মনুমেন্ট' ভারতবাসী তথা বাঙালীর লজ্জা আর গ্লানির প্রতিক এক সুউচ্চ স্মৃতি সৌধ! কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সদম্ভে বৃটিশদের অত্যাচারের কাহিনী মনে করিয়ে দিত যুগ যুগ ধরে!  1947 এ স্বাধীনতা  পাওয়ার পরও আমরা লজ্জার বাইশটা বছর কাটিয়ে দিয়েছি অক্টারলোনি মনুমেন্টকে বুকে নিয়েই!, শেষপর্যন্ত 1969 এ অবশেষে তার নাম পালটে করা হলো 'শহীদমিনার', কলকাতার ধর্মতলা বা এসপ্ল্যানেড অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি সুউচ্চ ও সুবিশাল স্মৃতিসৌধ, আর এই সৌধটির উচ্চতা যেন মাথা উঁচু করে ব্রিটিশদের অত্যাচার আর দম্ভের আস্ফালন প্রচার করে এসেছে প্রায় দেড়শ বছর ধরে!  1828 এ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কম্যান্ডার মেজর জেনারেল স্যার ডেভিড অক্টারলোনির স্মৃতিতে এই সৌধটি নির্মিত হয়, এরকম আরও অনেক সাধের সৌধ ই ব্রিটিশরা আমাদের উপহার হিসেবে দিয়ে গেছে আমাদেরই রক্তের বিনিময়ে!  থাক সে কথা, তা কি মহান কাজটি করেছিলেন এই ডেভিড অক্টারলোনি! যার জন্য তার স্মৃতিতে এই মনুমেন্ট তৈরী করতে হয়েছিল! অবশ্যই জানতে হবে, 1804 এ ভারতবর্ষের বীর মারাঠাদের আক্রমণের হাত থেকে তিনি সফল ভাবে ব্রিটিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে রক্ষা করতে পেরেছিল, তৎকালিন ব্রিটিশদের অধীনস্থ দিল্লি কে!  তার গৌরবের এখানেই শেষ নয় তিনি ইঙ্গ-নেপাল যুদ্ধেও গোর্খাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সফল ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে একই ভাবে ব্রিটিশ বাহিনীকে জয়ী করেন!  আহা!!  আর এই ভারত বিরোধী 'বীরত্বকে' স্মরণীয় করে রাখতে ব্রিটিশরা গর্বের আর দম্ভের এই অসাধারণ সৌধটি নির্মাণ করে ফেলেছিলেন খোদ কলকাতার বুকে,  অবশ্যই সরকারি কোষাগারের টাকায়, মানে আপামর ভারতবাসীর চোখের জলের বিনিময়ে লুণ্ঠন করা টাকায় তৈরী করা হয়েছিল ভারতবাসীর লজ্জার আর অপমানের সৌধ 'অক্টারলোনি মনুমেন্ট'।  সেই সময়ে এই সৌধটি নির্মাণ করতে খরচ হয়েছিল পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা, আজকের সময়ে হয়তো সেটা পঁয়ত্রিশ কোটি টাকার ও অনেক বেশী! অথচ ভাবতে অবাক লাগে স্বাধীনতা পাওয়ার পরও লজ্জা আর অপমানের এই সৌধটির নাম বদলের কোনো আগ্রহই দেখায়নি তৎকালিন ভারত সরকার বা বাংলার সরকার, উল্লেখ করা যেতেই পারে, কেন্দ্র-রাজ্য দু যায়গায়ই তখন ছিল কংগ্রেসের সরকার!  অথচ নেহেরুর নামে শুয়ে শুয়ে রাস্তা-ঘাট, পার্ক, সেটডিয়াম, স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি তৈরী হয়েছে এই সময়কালে!  1969 এ অগস্ট মাসে তদনীন্তন যুক্ত-ফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেই এই স্মৃতি-সৌধটিকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নিহত শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে, অবশেষে যথার্থ ভাবে এই সৌধের নতুন নামকরণ করেন "শহীদ মিনার"।
আজ হয়তো কলকাতায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে এই মিনার অত্যন্ত আকর্ষণীয় এক দ্রষ্টব্য স্থাপত্য, কারণ সত্যিই এর স্থাপত্য কিন্তু নজরকাড়া, সৌধটির নকশা তৈরীর ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা পালন করেছিলেন বিখ্যাত স্থপতি জে. পি. পার্কার। তিনটি ঘরনার শিল্পকলার মিশ্রণে তৈরী হয়েছিল এই মিনার, যেমন এই সৌধের   নিম্নাংশের গঠনে মিশরীয় স্থাপত্য লক্ষ্য করা যায়, আবার স্তম্ভের মাঝের অংশে সিরীয় স্থাপত্য আর শীর্ষে তুর্কি স্থাপত্যর আদলে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়, অর্থাৎ বিভিন্ন শ্রেষ্ঠ শিল্পের সমন্বয়ে তৈরী এই আটচল্লিশ মিটার (157 ফুট) আর দুশো আঠারোটি সিঁড়ি বিশিষ্ট সুউচ্চ এই  মিনারটি।  সবুজ ময়দানের মধ্যে কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই মিনারটিতে  আগে ওপরে চড়ার অনুমতি মিললেও আজকাল সাধারণ দর্শকদের জন্য আর সেই সুযোগ নেই।  এই শহিদ মিনার এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আন্দোলন মিটিংয়ের জন্যও বিখ্যাত বা সমাদৃত হয়ে গেছে, এখন তো রাস্তাঘাটে পোস্টার হোর্ডিং এ চোখে পড়ে শহিদ মিনার থেকে নানান রাজনৈতিক কর্মসূচি বা আন্দোলন ঘোষণা করার ডাক দিচ্ছেন নেতা মন্ত্রীরা,  তবে এ বিষয়েও একটা ইতিহাসের কথা অবশ্যই বলতেই হবে, তা হলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ই প্রথম এই মিনারের পাদদেশ থেকে হিজলি জেলে ব্রিটিশদের বর্বরতা আর অত্যাচারে নিহত দুই শহিদকে স্মরণ করে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন সেই ব্রিটিশ শ্বাসিত বাংলায়, তাই বারবার মনে হয় এই শহিদ মিনার থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার ব্যাপারেও সেই কবিগুরুই পথিকৃত।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours