রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:
চারবছরের বাচ্চামেয়েটার বুকে পিঠে আঁচড়ের দাগ ছিল। দগদগে যোনিক্ষত নিয়ে একদিন মাকে বলতে গিয়েছিল নিকটাত্মীয়ের আদরের স্বরূপ। মা শোনেননি, উলটে তাকে বুঝিয়েছিল এতে তারই ভুল। বন্ধ হয়েছিল খেলাধূলা, নিজের ঘর নামক গরাদের অন্দরে দাঁড়িয়ে অন্ধকার মাখতে মাখতে অবসাদগ্রস্থ মেয়েটা বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছিল, " আমার দোষ কোথায়?"
ছেলেটার বয়স তেরো, পড়াশুনায় তেমন করিৎকর্মা নয় মোটেই, বড্ড সাধারণ। গুণ বলতে ছিল তার আঁকার হাতখানা, অসাধারণ সব ছবি যেন কথা বলত অতর্কিতে। বাবা - মায়ের মতে এটা সময়নষ্টের খেয়াল, অগত্যা বাড়ানো হল প্রাইভেট টিউটরের সংখ্যা, আবর্জনাবাক্সে লুটোপুটি খেল রঙ তুলি। সারাদিনের পড়া নামক যুদ্ধের শেষে ক্লান্ত সৈনিককে যখন তার বাবা পড়া ধরতেন সামনে বসিয়ে, ঢুলত সে ক্লান্তিতে। স্কেলের আদরের কালশিটে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, কখনো রান্নাঘর থেকে গরম খুন্তি মায়ের রূপ নিয়ে এসে চুমো খেত গালে। বড়মানুষ হতে হবে ছেলেকে, বড় চাকরি করে টাকা কামাতে হবে অনেক, বাবা - মাকে রাজার হালে রাখতে হবে৷ কত দায়িত্ব, অবহেলা করলে চলে! ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে গতবছর, মালা টাঙানো তার ফটোগ্রাফের দিকে চেয়ে যখন তার মা নাটুকে বিলাপ করেন তখন হয়ত ঘরের কড়িকাঠগুলোও দুয়ো দেয় তাঁকে।
আটবছরের শিশুটি দিনদিন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিল। বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল পড়াশুনা - খেলাধূলা। ঘরের লোক গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানাতে চেষ্টার কসুর করেননি, এমনকি অন্ধকার বন্ধ ঘরে তাকে আটকে রেখে শাস্তি দিতেও ভোলেননি। কিন্তু ফল হয়েছিল উলটো। শিশুটি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে যখন হাসপাতালে আনা হয় তার কাউন্সিলিং এর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। তারসঙ্গে বন্ধুত্ব করে একটু খোঁচাখুঁচি করতেই যে সত্য বেরিয়ে এসেছিল শুনে গা গুলিয়ে উঠেছিল আমার। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে বমি করে ফেলেছিলাম। গত দুইবছর ধরে পুরুষশিশুটি তার নিজের মাসির বিকৃত কামনার শিকার। মাকে বলে লাভ হয়নি, বরং অল্পবয়সে পাকার অপরাধে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল তাকে। বাচ্চাটির যৌনাঙ্গে কামড়ের দাগ ছিল, সে নিজেই দেখিয়েছিল আমায়। জীবনে প্রথমবার একঘর লোকের সামনে নিজের চেয়ে অনেক বড় একজন মহিলাকে সপাটে চড় মেরেছিলাম। মা শব্দের অর্থ যারা জানেনা তাদের সন্তান জন্ম দেওয়ার জৈবিক ও সামাজিক তাড়নার ফল যে কত শিশু ভোগ করে তার উদাহরণ দিতে শুরু করলে শেষ হবেনা।
আমার মা শিশুকালে আমায় পান থেকে চুন খসলে এই বলে ধমকাতেন যে " সোনাগাছিতে বিক্রি করে দেব"। তিনি আমায় শাসিয়েছিলেন তাঁর কথামতো না চললে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের দ্বারা নষ্ট করাবেন আমায়। আমার আর আমার বাবার ভেতরের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল তাঁর জন্যই, বাবা কুসন্তান ভাবতেন আমায়। বহুদিন লেগেছিল তাঁর ভুল ভাঙতে এবং মা নামক মহিলাটির আসল স্বরূপ চিনতে। আজও " মা" শব্দটা আমার কাছে ট্রমার মতো, অনাত্মীয়ের টানটা তাই হয়ত আত্মীয়দের চেয়েও অনেক বেশি।
আপনারা যারা " কুসন্তান যদ্যপি হয়, কুমাতা কভু নয় " বা " পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম " এই থিয়োরিতে বিশ্বাসী তারা দয়াকরে লেখাটি পড়ুন, পারলে গুগল সার্চ করুন৷ চাইল্ড টর্চারের কি নিদারুণ নমুনা পাবেন সহ্য করতে পারবেন না। জন্ম দিয়ে বা সন্তানের পেছনে টাকাকড়ি ঢেলেই প্রকৃত মা - বাবা হয়ে ওঠা যায় না, তারজন্য মানবিক মন আর হৃদয় লাগে। সন্তান আপনার ইনভেস্টমেন্ট পলিসি নয়, যে এখন জমা করবেন ভবিষ্যতে টার্নওভার পাবেন বলে। সে একজন আলাদা মানুষ, তার ভাবনাচিন্তাকে সম্মান করতে শিখুন। তার কথা মন দিয়ে শুনুন, বুঝতে চেষ্টা করুন৷ এমনিতেই এযুগে সম্পর্ক তার মূল্য হারাচ্ছে, আপনাদের আচরণগুলো যেন সন্তানের মনে আপনাদের মনে বিদ্বেষ না তৈরী করে। তার বন্ধু হয়ে উঠুন, প্রতিপক্ষ নয়। সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত হলে আগামীতে বৃদ্ধাবাস বলে কোনো শব্দ থাকবে না দেশে৷ ভয় দেখিয়ে প্রভু হওয়া সম্ভব, মা - বাবা নয়।।
চারবছরের বাচ্চামেয়েটার বুকে পিঠে আঁচড়ের দাগ ছিল। দগদগে যোনিক্ষত নিয়ে একদিন মাকে বলতে গিয়েছিল নিকটাত্মীয়ের আদরের স্বরূপ। মা শোনেননি, উলটে তাকে বুঝিয়েছিল এতে তারই ভুল। বন্ধ হয়েছিল খেলাধূলা, নিজের ঘর নামক গরাদের অন্দরে দাঁড়িয়ে অন্ধকার মাখতে মাখতে অবসাদগ্রস্থ মেয়েটা বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছিল, " আমার দোষ কোথায়?"
ছেলেটার বয়স তেরো, পড়াশুনায় তেমন করিৎকর্মা নয় মোটেই, বড্ড সাধারণ। গুণ বলতে ছিল তার আঁকার হাতখানা, অসাধারণ সব ছবি যেন কথা বলত অতর্কিতে। বাবা - মায়ের মতে এটা সময়নষ্টের খেয়াল, অগত্যা বাড়ানো হল প্রাইভেট টিউটরের সংখ্যা, আবর্জনাবাক্সে লুটোপুটি খেল রঙ তুলি। সারাদিনের পড়া নামক যুদ্ধের শেষে ক্লান্ত সৈনিককে যখন তার বাবা পড়া ধরতেন সামনে বসিয়ে, ঢুলত সে ক্লান্তিতে। স্কেলের আদরের কালশিটে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, কখনো রান্নাঘর থেকে গরম খুন্তি মায়ের রূপ নিয়ে এসে চুমো খেত গালে। বড়মানুষ হতে হবে ছেলেকে, বড় চাকরি করে টাকা কামাতে হবে অনেক, বাবা - মাকে রাজার হালে রাখতে হবে৷ কত দায়িত্ব, অবহেলা করলে চলে! ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে গতবছর, মালা টাঙানো তার ফটোগ্রাফের দিকে চেয়ে যখন তার মা নাটুকে বিলাপ করেন তখন হয়ত ঘরের কড়িকাঠগুলোও দুয়ো দেয় তাঁকে।
আটবছরের শিশুটি দিনদিন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিল। বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল পড়াশুনা - খেলাধূলা। ঘরের লোক গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানাতে চেষ্টার কসুর করেননি, এমনকি অন্ধকার বন্ধ ঘরে তাকে আটকে রেখে শাস্তি দিতেও ভোলেননি। কিন্তু ফল হয়েছিল উলটো। শিশুটি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে যখন হাসপাতালে আনা হয় তার কাউন্সিলিং এর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। তারসঙ্গে বন্ধুত্ব করে একটু খোঁচাখুঁচি করতেই যে সত্য বেরিয়ে এসেছিল শুনে গা গুলিয়ে উঠেছিল আমার। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে বমি করে ফেলেছিলাম। গত দুইবছর ধরে পুরুষশিশুটি তার নিজের মাসির বিকৃত কামনার শিকার। মাকে বলে লাভ হয়নি, বরং অল্পবয়সে পাকার অপরাধে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল তাকে। বাচ্চাটির যৌনাঙ্গে কামড়ের দাগ ছিল, সে নিজেই দেখিয়েছিল আমায়। জীবনে প্রথমবার একঘর লোকের সামনে নিজের চেয়ে অনেক বড় একজন মহিলাকে সপাটে চড় মেরেছিলাম। মা শব্দের অর্থ যারা জানেনা তাদের সন্তান জন্ম দেওয়ার জৈবিক ও সামাজিক তাড়নার ফল যে কত শিশু ভোগ করে তার উদাহরণ দিতে শুরু করলে শেষ হবেনা।
আমার মা শিশুকালে আমায় পান থেকে চুন খসলে এই বলে ধমকাতেন যে " সোনাগাছিতে বিক্রি করে দেব"। তিনি আমায় শাসিয়েছিলেন তাঁর কথামতো না চললে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের দ্বারা নষ্ট করাবেন আমায়। আমার আর আমার বাবার ভেতরের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল তাঁর জন্যই, বাবা কুসন্তান ভাবতেন আমায়। বহুদিন লেগেছিল তাঁর ভুল ভাঙতে এবং মা নামক মহিলাটির আসল স্বরূপ চিনতে। আজও " মা" শব্দটা আমার কাছে ট্রমার মতো, অনাত্মীয়ের টানটা তাই হয়ত আত্মীয়দের চেয়েও অনেক বেশি।
আপনারা যারা " কুসন্তান যদ্যপি হয়, কুমাতা কভু নয় " বা " পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম " এই থিয়োরিতে বিশ্বাসী তারা দয়াকরে লেখাটি পড়ুন, পারলে গুগল সার্চ করুন৷ চাইল্ড টর্চারের কি নিদারুণ নমুনা পাবেন সহ্য করতে পারবেন না। জন্ম দিয়ে বা সন্তানের পেছনে টাকাকড়ি ঢেলেই প্রকৃত মা - বাবা হয়ে ওঠা যায় না, তারজন্য মানবিক মন আর হৃদয় লাগে। সন্তান আপনার ইনভেস্টমেন্ট পলিসি নয়, যে এখন জমা করবেন ভবিষ্যতে টার্নওভার পাবেন বলে। সে একজন আলাদা মানুষ, তার ভাবনাচিন্তাকে সম্মান করতে শিখুন। তার কথা মন দিয়ে শুনুন, বুঝতে চেষ্টা করুন৷ এমনিতেই এযুগে সম্পর্ক তার মূল্য হারাচ্ছে, আপনাদের আচরণগুলো যেন সন্তানের মনে আপনাদের মনে বিদ্বেষ না তৈরী করে। তার বন্ধু হয়ে উঠুন, প্রতিপক্ষ নয়। সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত হলে আগামীতে বৃদ্ধাবাস বলে কোনো শব্দ থাকবে না দেশে৷ ভয় দেখিয়ে প্রভু হওয়া সম্ভব, মা - বাবা নয়।।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours