কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

আর কিছু করার ছিলো না। তাই সেদিন বিক্রি করে দিয়েছিলাম বাইকটা।
অনেক ভিক্টরির সাক্ষী ছিলো আমার ওই টিভিএস ভিক্টর। অনেক দিনের সঙ্গী। ঝাঁ চকচকে রুপোলি রং। বেশ গাবদা-গোবদা। একটা আদুরে ভাব। ওই কন্ঠা বার করা, জিরো ফিগার বরাবরই আমার অসহ্য।

মেজাজটাই সেদিন ছিল একেবারে বাদশাহী। কোনও এক সকালে, শোরুম থেকে ওই বাইক নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ফাটাফাটি ব্যাপার। বেশ কমবয়স থেকেই স্কুটার চালানো অভ্যাস ছিলো। তাই ওই বড়সড় বাইককে বাগে আনতে বেগ পেতে হয়নি। ভিক্টরও বুঝে ফেলেছিলো, ঠিক কতটা ওর প্রেমে মজেছিলাম আমি। প্রথম দর্শনেই প্রেম। ভাগ্যিস আমার ভিক্টর মানব প্রজাতির না। তাই অমন নিঃশর্ত মন দেওয়া নেওয়া। আমাদের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল প্রায় রাতারাতি।

বাইপাস ধরে কখনও ঝড়ের গতিতে, আবার আশপাশের রাস্তায় গদাই লস্করি চালে বাইক আমায় নিয়ে ছুটে বেড়াত। এমনিতে কুঁড়ে স্বভাবের হলেও, বাইকের ব্যাপারে আমার কোনও আপোষ ছিল না। যত্ন করে আমার 'ভিক্টর'কে সাজিয়ে গুজিয়েই রাখতাম। ওর গায়ে দাগ সহ্য হতো না। প্রায় রোজ ধুলো ময়লা ঝেড়ে দিতাম ওর শরীরের। আর অসুস্থতা তো দূরের কথা, শরীর খারাপের লক্ষণ দেখা দিলেই ডাক্তারের গ্যারেজে নিয়ে ছোটা। সবকিছু মনে রাখতো আমার সেই 'মনের বাইক'। তাই রাতবিরেতে মাঝরাস্তায় ও কখনও আমাকে বিপাকে ফেলেনি।

কিন্তু মুশকিল হলো কলকাতায় এসে। ছোট্ট ফ্ল্যাট। তার ছোট্ট বারান্দা। সবকিছুই ছোটখাটো। চিন্তাভাবনাগুলোও। সমস্যা দেখা দিলো বাইকের জায়গা সংকুলানে। আমি মানিয়ে নিতে পারলেও, ও পারলো না। বারান্দা থেকে আমরা দুজন একসঙ্গে বেরোতে গেলেই আমি অথবা ও জখম। গায়ে আঁচড়ের গভীর ক্ষত।
একসময় অনিবার্য ভাবেই আলাদা হলাম আমরা। আমি পড়ে থাকলাম কলকাতায়। ভিক্টরকে রেখে এলাম আসানসোলে। সেখানে কোনও অসুবিধা ছিলো না। দিব্য ফ্ল্যাটের নিরাপদ আশ্রয়েই ছিল ওর বাস। দু-তিন মাস পর পর আমাদের দেখা হত। ফ্ল্যাটে ঢোকার আগেই একবার ওকে আদর করতাম। গায়ে হাত বোলাতাম। মনে হত, ও যেন আমার হাতের ছোঁয়াটুকুর জন্যই অপেক্ষা করে থাকত।

ভিক্টরের রূপালি গায়ে হাত লাগালেই মনে হত শীতের ত্বক। ধুলো ময়লায় খসখসে। দাগ পড়ত। বন্দিজীবন কাটানোয় কেমন যেন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ছিল ও। অসুস্থ। জিয়নকাঠির ছোঁয়াতেও সাড়া দিতে সময় লাগত। কোথাও যেতে চাইত না। টেনে- টুনে বের করলেও প্রথমেই শুশ্রুষা করতে হত। তারপর ধীরে ধীরে আমার পক্ষীরাজ ফিরতো তার পুরনো ছন্দে।

বুঝতে পারলাম, এভাবে অবহেলায় ভিক্টরকে ফেলে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না। দিনের পর দিন জুবুথুবু বসে থেকে ও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ক্ষয় হচ্ছে ওর জীবনীশক্তির। মন শক্ত করলাম। বিচ্ছেদের লগ্ন সমাগত। ওকে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া গতি ছিল না।
যতদূর মনে পড়ে, দিনটা ছিল রবিবার। এক খরিদ্দার এল। নির্লজ্জের মতো আমার সামনেই আমার ভিক্টরের সর্বাঙ্গে হাত বোলাতে লাগল। কত শত স্মৃতি মাখানো ওর গাময়। ইচ্ছে হলো ঠাস করে একটা চড় কষাই খরিদ্দারের গালে। কেমন যেন গোল্লা-গোল্লা চোখ করে ভিক্টরের শরীরের জরিপ করে চলেছে তো চলেছেই। উপচে পড়ছে এক রাশ লোভ।

দরদামের পর নগদ টাকা সাবধানে গুনে নিলাম। অভিমানী ভিক্টর কিন্তু এবার এক কিকেই স্টার্ট হল। ভাবখানা এরকম, দেখলে তো আমি কেমন সুস্থই ছিলাম! সাইলেন্সরের পাইপ দিয়ে যেন স্পষ্ট ভাষায় ছিটকে বেরিয়ে এলো- ছি ছি ছি। বাইকের নতুন মালিক ওর পিঠে সওয়ার হয়ে অ্যকসিলেটরে হাত ছোঁয়াতেই তাকে যেন ছিটকে ফেলে দিতে চাইলো ঘেন্নায়। এরপর আত্মসমর্পণ। কিই বা করার ছিলো ওর? এবার উদভ্রান্তের মতো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ভিক্টর। বেড়িয়ে এলো সাইলেন্সরের মসৃণ আওয়াজ। তারপরেই ছুট, দে ছুট!

আর একবারও পেছন ফিরে তাকালো না ভিক্টর। অভিমান? আমি হলপ করে বলতে পারি, তাই। আমার রূপালি সঙ্গী এক ছুটে চলে গেল নজরের বাইরে। বাইক না, বিক্রি হয়ে গেল আমার কত মধুমাসের স্মৃতি। তখন আমি টাকা হাতে দাঁড়িয়ে। নিশ্চুপ।
আকাশ বাতাসে তখন আগমনির সুর। সেই সুন্দর শরৎ সকালে আমার এতদিনের ভিক্টর, অন্যের ভিক্টর হয়ে গেল। এও এক বিসর্জন।

বাইক রাখার জায়গাটা তখন শূন্য। মনটা কেমন ফাঁকা নীল আকাশের মতো। ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতির সাদা মেঘ। চিৎকার করে উঠলাম মনের মানুষ হারানোর যন্ত্রণায়। কিন্তু গলা দিয়ে এতটুকুও আওয়াজ বেরলো না। যন্ত্রণাটাকে শ্লেষ্মার মতো গলার নলি দিয়ে চালান করে দিলাম পাকস্থলীতে।

মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে যাওয়া আমার যান্ত্রিক বাইকটা, কেমন যেন অযান্ত্রিক হয়ে গেল।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours