স্বপন দাস, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

আমার নিজের জীবনের একটা গল্প দিয়ে এইলেখা শুরু করি। আমার মেয়ে তখন সবে জন্মেছে। বয়েস একমাস। আমার শ্বশুর বাড়িতেই থাকে। বসার ঘরের মেঝেতে ওকে বিছানা করে শুইয়ে দেওয়া হত। কয়েকদিন ওঁর মা পাশ থেকে সরে গেলে কেদে উঠত। একদিন দেখা গেল, ও সামনে রাখা টেলিভিশনের আলোটাকে আবিষ্কার করে ফেলেছে। সেই রঙ্গীন আলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক ভাবে। পলক আর পড়ে না। আমার স্ত্রী খুব খুশি। যাক ওকে চুপ করিয়ে রাখার একটা ব্যবস্থা হল। দিন যায় , ও বড় হতে থাকে। ওকে থামিয়ে রাখার জন্য , টম অ্যান্ড জেরির কার্টুন চালিয়ে দেওয়া হতে থাকল। কেননা সেই সময় জনি সোকও ও ফ্লাইং রোবট ও দেখানো হত। কিন্তু ওঁর যেহেতু ভালো লাগত তাই ওটাই চালানো হত। আরো অবাক ব্যাপার , ওই কার্টুনের সময়টা অর জীবনের সঙ্গে অনেকটাই জড়িয়ে গেল। ওঁর খাওয়ার সময়টা ওই কার্টুনের সময় কেন্দ্রিক হয়ে উঠল। এক সময় এমন হল ওকে চুপ করিয়ে রাখার জন্য আমাকে টম ও জেরির সি ডি নিয়ে আসতে হল।
শিশুমনে কার্টুন সেই সময় থেকে আজ একটা ভয়ংকর নেশার মত জড়িয়ে গেছে। এটাকে মনোরগের  চিকিৎসকরা মাদকের নেশার থেকেও আরো ভয়ংকর বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মতে মাদকের নেশা বাইরে থেকে বোঝা যায়। সেই নেশা বাহ্যিক ভাবে দেখতেও পাওয়া যায়। তার চিকিৎসাও করা যায় সেইভাবে। কিন্তু এই নেট অ্যাডিক্সন ও কার্টুন অ্যাডিক্সনের কোন চিকিৎসা নেই। কেননা এটা আমাদের স্নায়ু ও মস্তিস্কের এমন এক জায়গায় আঘাত হানে যেখান থেকে ওই শিশুমন নিজেকে বের করে আনতে পারে না।
কয়েকদিন আগে উত্তর ২৪ পরগনার একটি শিশু কার্টুন দেখতে দেখতে নিজের গলায় ফাস লাগিয়ে ফেলে। ার তাকে বাঁচানো যায়নি। কখনো শিশু মনে সুপারম্যান বা স্পাইডারম্যান হয়ে ওঠার স্বপ্ন বাসা বেঁধে ফেলে , তা সে নিজেই বুঝতে পারে না।
মনস্তত্ববিদদের কথায় , আজকের দিনে একটি শিশু নিজেকে বড় একা ভাবে চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে। তার পড়ার চাপ, তার পারিপার্শ্বিকতার চাপ তাকে স্বভাবিক পরিবেশ থেকে আলাদা করে দেয়। সে ছোটবেলা থেকেই ওই কার্টুন চরিত্রগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলে। একসময়ে আকর্ষণ থেকে নেশায় পরিনত হয়ে ওঠে এই অভ্যাসটা।
যেমন , লক্ষ্য করে দেখা গেছে, একটি শিশু তার প্রতি দিনের জীবনে কার্টুনের সব বিষয়টাকেই জড়িয়ে নিয়েছে। সে নিজের আদর্শ হিসাবে ওই চরিত্রকেই ভাবছে। সে ওই কার্টুনএর মত খার খাচ্ছে, হাঁটছে, নিজেকে ব্যস্ত রাখছে, নিজের চলাফেরায় নিয়ে আসছে। এমনকি ভাষার ব্যবহারেও সেই কার্টুনের প্রভাব বেশি মাত্রায় থাকছে।
সারা বিশ্বে এখন এই কার্টুন এর শিশুমনে প্রভাব নিয়ে চিন্তা ভাবনা নেশি করে শুরু হয়েছে , তার কারণ , এই নেশা ক্রমেই ভয়ংকর একটা চেহারা নিয়েছে। আর সেই কারণে বহু শিশু মানসিক রোগে যেমন আক্রান্ত হচ্ছে। তেমনি হারিয়ে ফেলছে অনেক কিছুই। এমনকি প্রাণ হানির নিরিখে ক্রমেই বাড়ছে সংখ্যা পর সংখ্যা।
কি ভাবে একটি শিশু মন শেষ হচ্ছে ?
১। একজন শিশু ,সে সারাক্ষণ কার্টুন দেখলে তার স্বাভাবিক ভাবে মানসিক বৃদ্ধিতে আঘাত হানে। সে একেবারেই পড়াশোনায় মন দিতে চায় না। তাদের চিন্তাশক্তির ক্ষমতাকেও ছিনিয়ে নেয় এই কার্টুন।
২। কার্টুন দেখার মধ্যে দিয়ে একটি শিশু হারিয়ে ফেলে বাস্তব পৃথিবীর সব কিছুকে। সে কোন স্বাভাবিকতাকেই মানতে চায় না। সে ওই অলীক জগতে হারিয়ে যায় নেশাগ্রস্তের  মত।
৩। কার্টুনে চরিত্রগুলি যে ভাষার কথা বলে, সেগুলি থেকে কোন ভালো ভাষার শিক্ষার ক্ষেত্রে তৈরি হয়না। ফলে একটি শিশুর কাছে ওই কার্টুন চরিত্রের মুখেরর ভাষাটি জনপ্রিয়তার কারণে মাথার মধ্যে বসে যায়। সে ওই ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করে, বিশেষ করে কিছু শব্দ শিশুরা করে থাকে, যেগুলি কার্টুন চরিত্রগুলি করে। এটা একটা সময় শ্রুতিকটু হয়ে পড়ে সবার কাছেই।
৪। কার্টুন এর উজ্জ্বল রঙ আর আলো। একটি শিশুর চোখের  সমস্যাকে কয়েক হাজার গুন বাড়িয়ে দেয়। আর যে সব শিশু সারাক্ষণ কার্টুন দেখে , তাদের চোখের সমস্যা ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জনের হয় বলে জানিয়েছেন চক্ষু বিশেষজ্ঞরা।
৫।সারাক্ষণ ঘরে বসে কার্টুন দেখার ফলে, একটি শিশু শারীরিক ও কায়িক পরিশ্রম একেবারেই করেনা।ফলে সে বাইরের খেলাধুলার জগত, সেখানের উত্তেজনাকে উপভোগ করা , বাইরের জগতকে জানা, বাইরের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে চলার শিক্ষা থেকে নিজেকে বঞ্ছিত করে। আর সঙ্গে নানা শারীরিক সমস্যা ও অক্ষমতা তার শরীরের দিক থেকে আসতে থাকে।
৬। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব শিশু সারাক্ষণ কার্টুন দেখার মধ্য নিজেকে ডুবিয়ে দেয়, তাদের ব্যবহার খুব একটা স্বাভাবিক হয় না। অন্য বাচ্ছাদের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে যে এরা মারা মারি করতে ভালো বাসে, নিজেকে হিরো ভাবতে ভালো বাসে, সুপারম্যান ইমেজ তৈরি করতে ভালো বাসে, আবার পড়াশোনা না করে কোন গ্যাজেটের মাধ্যমে পাশ করার বা সমাধান করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। একসময়ে সে এই ব্যবহারের ফলে নিজেই নিজেকে আর পাঁচ জনের কাছে অপ্রিয় করে তোলে।
৭।যে সব শিশু খুব কার্টুন দেখে , দেখা গেছে ,তারা নিজেদের জন্য খাবার অভ্যাসটাকেও নস্ট করে ফেলে। আরো দেখা গেছে , তারা কার্টুনের চরিত্রের মত খেতে গিয়ে অস্বাস্থ্যকর একটা অভ্যাস নিজেদের মধ্যেই তৈরি করে ফেলে, যেটা তার দীর্ঘ জিবনে বেশ প্রভাব ফেলে।
৮। গবেষকরা দেখেছেন , যে সব শিশু কার্টুন দেখে, তারা তাদের সামাজিক জীবন ও পরিবেশ থেকে বেশ দূরে সরে যায়। একটা অসামাজিক বিষয় তার মধ্যে ঢুকে পড়ে।
৯। যে সব শিশু কার্টুনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, তাদের চরিত্রে অনেক সময় একটা ভায়োলেন্ট বিষয় ঢুকে পড়ে। আর প্রতিহিংসা নেবার মানসিকতা বাসা বাঁধে তার মনে।
১০। সব চেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় , কার্টুন চরিত্রকে অনুকরণ করার মানসিকতা তার মধ্যে তৈরি হয়। তার মত আচরন করার জন্য সে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শিশুর অভ্যাস আমরাই তৈরি করি। আমাদের পরিবেশ তৈরি করে দেয়, আর আমরা মানে বাবা-মা অভিভাবকরা তাকে ভালো করে তোলার শিক্ষা দিয়ে থাকি। সেই শিক্ষার ক্ষেত্রে যদি কোন খামতি থেকে যায়, তার ফল হয় সুদুর প্রসারি। আর ভোগ করতে হয় বাব- মা’কেই।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বিশেষজ্ঞদের দেওয়া কিছু উপায়, যেটা কিনা আমাদের শিশুকে এই নেশা থেকে দূরে রাখতে পারে ?
১। প্রথমেই শিশুটির মাথার মধ্যে ঢোকারবার চেষ্টা করুন যে  কার্টুন দেখা ভালো নয়।
২। টেলিভিশন দেখার সময় নির্দিস্ট করে দিন।
৩। শিক্ষামুলক চ্যানেল দেখতে বাধ্য করুন।
৪। বেশি করে সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবার চেষ্টা করুন।
৫। বাবা- মা নিজেদের মধ্যেকার দুর্বলতাকে শিশুর থেকে দূরে রাখুন। ওর
ঝগড়া কম করুন।
৬।খুব ছোটবেলা থেকেই রাইমস এর সি ডি বা এই জাতীয় সি ডি বেশি করে শিশুকে দেখান বা শোনান।
৭।কার্টুন যদি দেখতে দিতেই হয়, তাহলে শিক্ষামুলক কার্টুন দেখতে উৎসাহ দিন।
৮। যে সব কার্টুনে পশু পাখির চরিত্র আছে সেগুলি বেশি করে দেকবার চেষ্টা করুন।
৯। সব সময়ে যে সব কার্টুনে পজিটীভ চিন্তা ভাবনা দেখায় , সেগুলিই দেখান।
১০। মজার কার্টুন , বিশেষ করে যে কার্টুনের পশু বা পাখির চরিত্রগুলি মুখে কথা বলে মজা করছে , সেগুলি দেখতে দিন।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours