কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

একাই একশো অনু দুবে।
নীরব অনুকে দেখেই কেঁপে গেলো দিল্লি পুলিস।
কে এই অনু?
কোনও মন্ত্রীকন্যা বা হাই প্রোফাইল, প্রভাবশালী বাপের বেটিও নয়। এক দিল্লিদুহিতা। নিছক এক 'সাধারণ মেয়ে'। প্রতিবাদী কন্ঠ। যাকে দেখে শাসকও ডরায়।
আগামিদিনে আর যেন একটিও প্রিয়াঙ্কা, নির্ভয়া না হয়। সেই লড়াইয়ের দায়িত্ব একার ঘাড়েই তুলে নিয়েছিলো। দিল্লির এক তরুণী।
"রেপের প্রতিবাদ করতে বসিনি," গোড়াতেই উৎসাহী সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছিলো সেই 'সাধারণ মেয়ে'। "it is something more। এত ভয় নিয়ে কেন বেঁচে থাকতে হবে মেয়েদের।"

প্রিয়াঙ্কা রেড্ডির নিজের শহর হায়দরাবাদ তখন উত্তাল। সোশ্যাল মেডিয়া যখন অতি বিপ্লবীদের বিপ্লবে মুখর, ঠিক তখনই অনুকে ঘাড় ধরে তুলে নিয়ে চলেছিল অতি সক্রিয় দিল্লি পুলিস।
শনিবারের সকাল। খানিক দূরেই গণতন্ত্রের প্রহরীদের পিঠস্থান- সংসদ ভবন। 'বেটি বঁচায়ো' যজ্ঞের পুরোহিতদের মসনদ। সেই রাস্তার ধারেই বসে পড়ল এক তরুণী।
কবিগুরুর সেই 'সাধারণ মেয়ে'। গলায় জড়ানো ওড়না। গায়ে কালো ব্লেজার। পিঠে ঝোলানো ব্যাগ। আর হাতে এক প্ল্যাকার্ড। তাতে এক ছোট্ট প্রশ্ন-  "why i can't feel safe at my own ভারত"!
অতি সাধারণ দেখতে সেই তরুণী যেন হয়ে উঠেছিল অনন্যা। তার মনে হয়েছিল, ওই জায়গাতে বসলেই ভারতেশ্বর, তাঁর পারিষদদের নজর কাড়তে সুবিধা হবে।

কিছু মানুষ আবার নাটকের খুশবু পেয়ে গেছিলেন অনুর প্রতিবাদে। ঢাল নেই তরোয়াল নেই, সবচেয়ে বড়ো কথা কোনও সংগঠন বা দলের ঝান্ডাও হাতে নেই। নিধিরাম সর্দার নাকি? মেডিয়ার ফোকাস অনুর দিকে। বাস্তবে যেন হায়দরাবাদের প্রিয়াঙ্কাও সে মুহূর্তে অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছিল দিল্লির অনুর কাছে। মানুষ অপেক্ষা করছিলো অনুর কথা শুনতে।
কী বললো অনু?
- "ট্রেনে বাসে মেট্রোতে চড়লেই হলো। পেছনের লোকটা প্যান্টের চেন খুলে গায়ের সঙ্গে লেপটে দাঁড়ায়। মাতাল লোকটা বসে পড়ে গাঘেঁষে। মা-বাবাকে এসব কথা জানালে তাঁরা বলে, বাইরে বেরোসনা। ফিরতে একটু দেরি হলেই ভাইয়ের ফোনের পর ফোন। কোথায় তুই? কী করছিস? এতো জবাবদিহি ভালো লাগে না। সবার মনে আতঙ্ক।"
এরপরেই অনুর ছোট্ট প্রশ্ন।
- "ভারত তো আমার দেশ। আমার ঘর। আমার ঘরেই আমি 'সেফ' না হলে কী করবো?"

ঠিক কতটা হতাশ হলে এক তরুণীর মুখ থেকে ওই কথা বেরিয়ে আসে তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। তবে জীবনের এই মোড়ে পৌঁছেই অনু প্রমাণ করলো সে সাধারণ হয়েও অসাধারণ।
সোশ্যাল মেডিয়ার প্রতিবাদীরা যখন ধর্ষককে ধিক্কার জানিয়ে কর্তব্য সেরেছেন। তৈরি হচ্ছেন শনিবারের সান্ধ্য আসর জমানোর। অনু তখন প্ল্যাকার্ড হাতে সংসদের রাস্তায়। না, তার চোখে কোনও আগুন জ্বলছিলো না। ঠান্ডা, জেদি একরোখা মেয়েটা অবিচল। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই সে ছাড়বে। তার প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে সরকারকে।

ওদিকে মেয়ের জেদ দেখে ততক্ষণে টনক নড়েছে দিল্লি নগর কোটালের। বলতে দেওয়া যাবে না অনুকে। তা যতোই বাক স্বাধীনতার পবিত্র শপথ নেওয়া হোক না কেন, হাত কয়েক দূরের ভারতীয় গণতন্ত্রের মন্দিরে। তড়িঘড়ি তরুণীকে বোঝাতে ছুটে গেলেন দিল্লি পার্লামেন্ট স্ট্রিটের পুলিস অফিসাররা। নরমে- গরমে জোর চেষ্টা চালালেন অনুকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে। বলা হলো, যন্তর- মন্তরের সামনে ধর্নায় বসতে।

অনড় অনু। ভারতের পাহারাদারদের কাছ থেকে, এ প্রশ্নের জবাব নিয়েই ছাড়বে সে।
আবার কখনও, কোনও এক অসতর্ক মুহূর্তে ভেঙে পড়ে অনু।
- "ভয় পেতে পেতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর কত ভয় পাব?" প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে সেই মেয়ে। টিভি নিউজ চ্যানেলের দৌলতে অনু তখন বিশ্বময়। সবাই হাঁ করে শুনছে সেই সাধারণ মেয়ের কথা।

আসলে ঘাড় নুইয়ে পড়া মানুষটা আজও প্রতিবাদের ভাষা শুনতে চায়। প্রিয়াঙ্কা নির্ভয়ারাও অলক্ষ্য থেকে কান পেতে রাখে। আকুল হয়ে থাকে, তাদের ছেড়ে আসা প্রিয় পৃথিবী নামের গ্রহটার অন্তস্থল থেকে প্রতিবাদের সুর শোনার জন্য। তাই সবার চোখ জুড়ে শনিবার শুধুই অনু। আর প্রিয়াঙ্কাকে ছুঁয়ে অনুও সেদিন দিল্লির রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা- নহি সামান্যা নারী।

এমন এক মেয়েকে সংসদের আশপাশেও ঘেঁষতে দেওয়া যায় নাকি? তার ওপর আবার মেয়ের ধনুর্ভঙ্গ পণ ! সমস্যা না মেটা পর্যন্ত সে ওই সংসদ ভবনের সামনেই ধর্নায় বসে থাকবে। মুখে কিছু তুলতে নারাজ সেই জেদী অতি 'সাধারণ মেয়ে'। অফিসাররা ব্যর্থ। কিছুতেই রণেভঙ্গ দেবে না অনু। অগত্যা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো দিল্লি পুলিসের মহিলা বাহিনী। চললো তর্কাতর্কি।
- এখানে বসা মানা।
- রেপ করাও তো মানা।
পুলিস বুঝতে পারলো এ মেয়ে কথায় টলবে না। অগত্যা বলপ্রয়োগ। টেনে হিঁচড়ে অনুকে পুলিস গাড়িতে ওঠানোর চেষ্টা হলো। রাষ্ট্রশক্তির কাছে হেরে গেল জেদ। ঠিক এমনিভাবেই কি কয়েক ঘণ্টা আগে, শুক্রবার রাতের অন্ধকারে হেরে গেছিল প্রিয়াঙ্কাও ? হায়দরাবাদের সেই তরুণী পশু চিকিৎসক। সেই চার ট্রাক ড্রাইভার, খালাসি প্রিয়াঙ্কাকে এভাবেই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছিলো জাতীয় সড়কের পাশের ফাঁকা জায়গাটায় ? তারপর গণধর্ষণ। তসলিমা নাসরিনের ভাষায় এক ফোঁস, দুই ফোঁস! পরপর চার ধর্ষকের বিষে নীল হয়ে গেছিল প্রিয়াঙ্কার শরীর। প্রমাণ লোপাট করতে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো ধর্ষিতার নিথর, নিস্পন্দ শরীর।

অন্যদিকে প্রতিবাদের গলা টিপে ধরতে কম গেলো না দিল্লি পুলিসও। মহিলা কমিশনের সদস্যরা পৌঁছনোর পর প্রতিবাদীকে ছেড়ে দেওয়া হলো ঠিকই। তবে তার আগেই লিখিয়ে নেওয়া হয়েছিলো মুচলেকা। সংসদ ভবনের রাস্তায় প্রতিবাদে বসা যাবে না। থানা থেকে অনু বেরলো শরীরে আঁচড়ের দাগ নিয়ে। আর এই আঁচড়ের দাগ এঁকে দিয়েছিলো থানার তিন 'মহিলা' কনস্টেবল।

ওদিকে সোশ্যাল মেডিয়ার বুকে তখন তুমুল ঝড় তুলেছেন আট থেকে আশির নারীরা। প্রতিটি ধর্ষকই একজন পুরুষ। পুরুষের মুণ্ডপাতে ব্যস্ত। প্রতিযোগিতা জ্বালাময়ী ভাষণের। কেউ আবার অন্য নারীদের সাবধান করে দিতে জানালেন, রাতে বাড়ি ফেরার সময় ফুটপাথের কুকুরটাকে বিশ্বাস করবেন। পুরুষমানুষটিকে নয়।

কেউ আবার আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলেন। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালেন, "হে ঈশ্বর, বাঁজা করো আমাকে।" কারণ ছেলে হলে ধর্ষক। মেয়ে হলে ধর্ষকের শিকার। এমনই কতশত অকাট্য যুক্তি। যার দুটি উদ্দশ্য, আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া। এবং পুরুষকে ধর্ষকের জায়গায় নামিয়ে আনা। অতি উৎসাহীদের অনেকে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন- প্রিয়াঙ্কা কি সে রাতে ছোট পোশাক পড়েছিলেন?
এই জেহাদী ফেসবুক নারীদের সঙ্গে গলা মেলাতে, একটুও দেরি না করে এগিয়ে গেলেন একদল পুরুষ।  নিজেদের মুক্তমনা সাব্যস্ত করতে উঠেপড়ে চেষ্টা চালালেন তাঁরা। ধর্ষকদের এখনই ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে হবে। এমন তালিবানি আওয়াজও উঠলো। তারপর হাতমুখ ধুয়ে কেউ গেলেন নন্দন চত্বরে। কেউ কবিতা পাঠের আসরে। তখনও অনুর কবিতা তাঁদের কানে পৌঁছয়নি।
তবে সেই কবেই 'সাধারণ মেয়ে'র কথা শুনতে পেয়েছিলেন বাংলার ঋষিকবি।
"কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে
তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে।"
নির্ভয়া প্রিয়াঙ্কারা হেরে গেছিলেন। কিন্তু শনিবারের লড়াইয়ে জিতে গেল অনু।

অনেকেই অনুর এই প্রতিবাদে 'নাটুকেপনা' দেখতে পেয়েছেন। তাঁদের তীক্ষ্ণ সমালোচনায় মানসিক ভাবে ধর্ষিতা হয়েছে অনু। হেফাজতের নামে থানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রেখে অনুকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল দিল্লি পুলিস।
তবে কে কাকে শায়েস্তা করলো ঠিক বোঝা গেলো না। পুলিসকে অনু দুবে সাফ ভাষায় জানিয়ে এলো- "আমি এখনও রেপড হইনি। অপেক্ষা করছি রেপড হওয়ার জন্য।"




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours