পারমিতা দাস, লেখিকা, কলকাতা:

সম্প্রতি দুটি ঘটনা প্রকাশ্যে এলো। একটি ঘটনা আমাদের এই শহর কোলকাতার। অন্যটি হায়দ্রাবাদের। হায়দ্রাবাদের নৃশংস ঘটনাটি সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অপরাধীদের শাস্তি বিষয়ে যা কিছু বিধান দেওয়া হচ্ছে তাতে শিউড়ে উঠছি প্রতিক্ষণেই। শাস্তি বিধানকারীদের অকাট্য যুক্তি অপরাধ যেমন নৃশংস শাস্তিও তেমনই নৃশংস হওয়া উচিৎ। এই জনরোষ এবং তার ধরণ বিষয়ে অন্যসময় আলোচনা করা যাবে। আপাতত এই ঘটনা থেকে চোখ সরিয়ে একটু দ্বিতীয় ঘটনায় আসি। ঘটনাটি হয়ত অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে। গত শনিবার নাগের বাজার এলাকায় দুই তরুণ তরুণী প্রথমে একটি বারে বসে মদ্যপান করেন তারপর ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন। এইসময় এলাকার কিছু যুবক এসে তাদের মারধোর করে। তরুণীকে যৌন হেনস্তাও করা হয়। এলাকার কিছু লোকজন (মহিলারাও ছিলেন)ও এই ঘটনায় মদত দেয়। তাদের অপরাধ তারা দুজনে একসাথে প্রকাশ্যে সিগারেট খাচ্ছিলেন। পুলিশ প্রথমে ওই তরুণ তরুণীর অভিযোগ নিতে চায়নি। গত বুধবার তাদের ডেকে অভিযোগ নেওয়া হয়।
আপাত দৃষ্টিতে দুটি ঘটনার কোন মিল নেই। প্রথম ঘটনাটি সভ্যতার নিকৃষ্টতম অপরাধ। দ্বিতীয় ঘটনাটি নীতি পুলিশি। কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে ভাবুন তো। সত্যিই কি এই দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি একই ঘটনার এপিঠ ওপিঠ?
ধর্ষণ কেন হয়? প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতার দূর দূর পর্যন্ত কোন সম্পর্ক নেই। ধর্ষণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজের এমন একটি অস্ত্র যে অস্ত্র যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রতিপক্ষকে চরমতম শাস্তি দিতে। ইতিহাস সাক্ষী, এক রাজা যখনই অন্য রাজার রাজ্য জয় করেছে তখনই বিজয়ী রাজার সৈনিকরা বিজিত রাজ্যে লুঠতরাজের সঙ্গে সঙ্গে লাগামহীন ধর্ষণেও লিপ্ত হয়েছে। আমাদের দেশভাগ বা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও হাজার হাজার লাখ লাখ মেয়ে এই নৃশংসতার শিকার হয়েছে। এখনও যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশগুলিতে এই ঘটনা কত ঘটে চলেছে কে তার খোঁজ রাখছে!
এবার আসি আমাদের সমাজে। আমাদের দেশে এখনও, এই ২০১৯ সালেও মেয়েদের পড়াশোনা, মেয়েদের চাকরি করা, মেয়েদের জীবনযাপন, সবটাই আতশকাচের তলায় ফেলে কঠিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। তাই এখনও গার্লস স্কুল, গার্লস কলেজ, লোকাল ট্রেনে লেডিস কম্পার্টমেন্ট ইত্যাদি প্রভৃতির অস্তিত্ব রয়ে গেছে। তাই এখনও কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, বেটি পড়াও বেটি বাঁচাও প্রভৃতি সরকারি প্রকল্প। মানে বকলমে সরকারও মেনে নিচ্ছে ছেলে এবং মেয়ে যে সমান, সমাজে এখনও এই মত প্রতিষ্ঠিত নয়। স্কুলে পড়ান হয় ছেলের বিপরীতার্থক শব্দ মেয়ে, পুরুষের বিপরীতার্থক শব্দ নারী, স্বামীর বিপরীতার্থক শব্দ স্ত্রী। অর্থাৎ পুরুষ নামক প্রজাতিটিকে নারী নামক প্রজাতির বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওরা আমরা, প্রতিপক্ষ। অপরদিকে বেশিরভাগ পরিবারেই এখনও ছেলেটি প্রিভিলাজড ক্লাস। সে একটু বেশি আদর যত্ন পায়, একটু বেশি স্বাধীনতা পায়, একটু বেশি প্রশ্রয় পায়। বাড়িতে সে নিজেকে সুপিরিয়র ভাবতেই অভ্যস্ত। কিন্তু বাইরের জগতটা একটু হলেও পাল্টেছে। সেখানে পুরুষ মাত্রেই সুপিরিয়র নয়। ঝকঝকে স্মার্ট মেয়েরা উচ্চপদে চাকরি করছে, পড়াশোনায় তুখড়, স্বাধীন জীবনযাপন করছে। তারা সমাজের পিতৃতান্ত্রিক শাসন মেনে নিতে রাজি নয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এতোদিন যাদের ইনফিরিয়র ভেবে এসেছে তাদের আর পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখতে পারছে না। তখনই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধিরা প্রতিপক্ষের জন্য শাস্তি বিধান করছে, কখনও তা ধর্ষণ, কখনও নীতি পুলিশি, মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours