জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

মৃত্যুদন্ডের আদেশ শোনার পরেও তার মুখে প্রশান্ত হাসি। বিচারক ভাবলেন, আসামীর বয়স মাত্রই আঠেরো। সে হয়ত মৃত্যুদন্ডের অর্থ অনুধাবন করতে পারেনি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কি মৃত্যুদণ্ডের অর্থ বুঝতে পেরেছ?' ক্ষুদিরাম তার হাসি অবিচ্ছিন্ন রেখেই বললেন, 'আমি শ্রীমদ্ভগবদগীতা পড়েছি। আমার মৃত্যুভয় নেই।'

একার হাতে চারজন সৈনিককে বা রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে কাবু করতে পারতেন তিনি। বুড়িবালামের তীরে চিত্তব্রতদের সঙ্গে নিয়ে অসম লড়াইয়ে আত্মবলিদান দিতে বাঘাযতীনের পা টলেনি এতটুকুও।

টানা চৌষট্টি দিনের অনশন। এবং তারপর চিরশয়ানের দেশ। যতীন দাসের মৃত্যুর পরে তার আমৃত্যু লড়াইকে কুর্ণিশ জানিয়ে স্যালুট করেছিলেন বৃটিশ পুলিশের কর্তাও।

অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পরে জালালাবাদ পাহাড়ে শক্তিশালী বৃটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে মরণপণ সংগ্রাম। অবশেষে বিশ্বাসঘাতকের অভিসন্ধিতে গ্রেফতারি। কারান্তরালে নৃশংসতম অত্যাচার। শিলনোড়া দিয়ে ভেঙে দেওয়া হল উপর নিচের সব দাঁত। জীবন্ত অবস্থায় সাঁড়াশি দিয়ে উপড়ে ফেলা হল সমস্ত নখ। তারপর মাষ্টারদার অচৈতন্য দেহ ছুড়ে ফেলা হল নদীতে।

দীর্ঘ মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। কে বলবে তিনি বৃদ্ধা। আগুয়ান কিশোরীর মতন এগিয়ে চললেন - 'করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে'। সামনে থেকে ছুটে এল বুলেট। এলিয়ে পড়ল মাতঙ্গিনীর দেহ। তবুও উড্ডীন হাতের ঝান্ডা।

কুখ্যাত সিম্পসনকে হত্যা করে রাইটার্সে ধরা পড়লেন তারা। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল বাদলের। মাথায় গুলির আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হল মেডিকেলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বিনয়কে। গভীর রাত্রে ব্যান্ডেজ খুলে আঙ্গুল দিয়ে মাথার ঘিলু টেনে বের করে মৃত্যুবরণ করলেন বিনয়। ফাঁসি হল দীনেশের। ফাঁসির আগের মুহূর্তেও রসিকতা করলেন ডোমের সাথে। মৃত্যুর আগে লিখলেন, 'আমি অমৃতের সন্তান, তিনি সত্য, চির প্রেমে আমি তাহার সঙ্গে মিশিয়া থাকিতে চাই'।

সহপাঠীর কৃতকর্মের দায় নিয়ে কলেজ থেকে বিতাড়িত। আই সি এস - এর লোভনীয় চাকরি ছেড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মনিবেদন। আপোষ করে মূল স্রোতে থেকে গেলে হয়ত তিনিই হতেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের ভাবনায় প্রাণিত রবীন্দ্রনাথের 'দেশনায়ক' আদর্শে অবিচল থেকে বীরদর্পে সম্মুখসমরে হারাতে চাইলেন শত্রুকে। তার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হলেন তোজো থেকে হিটলার। তারপর আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়লেন ভারতবর্ষে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষবাহিনীর পরাজয়ের পরে হারিয়ে গেলেন অকস্মাৎ। নাকি হারিয়ে দেওয়া হল ইতিহাসকে 'গুমখুন' করে। দেশভাগের তীব্র যন্ত্রণা বুকে নিয়ে তারই আখ্যায়িত 'Father of the Nation' বললেন, 'আজ সুভাষ থাকলে দেশভাগ হতো না। দেশপ্রেমে ও আমাদের সবার উপরে'। তিনি সত্য উপলব্দ্ধি করলেন। তবে বড়ো বিলম্বে।

এছাড়াও মহাত্মা গান্ধী, মঙ্গল পান্ডে, মতিলাল, লালা লাজপত, ভগৎ, চন্দ্রশেখর, বাল গঙ্গাধর, রাসবিহারী, চিত্তরঞ্জন, অরবিন্দ, বারীন, ত্রৈলক্যনাথ, প্রফুল্ল, প্রীতিলতা থেকে নিবেদিতা এমন অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ; রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নজরুল, মুকুন্দদাসদের প্রেরণা ....। এভাবেই এক মধ্যরাত্রে এলো কাঙ্খিত স্বাধীনতা।

আর আজ ? কি অবস্থা সেই স্বাধীনতার ? সেই স্বাধীন দেশের ? সেই স্বাধীন দেশের জনগণের ?

আজ এক রত্নখচিত গণতন্ত্রের বাসিন্দা আমরা। তার যেমন জন তেমন জনপ্রতিনিধি। আইনসভাগুলিতে খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, শিশুপাচারের মতন জঘন্য অপরাধে অভিযুক্তের ভিড়। যা অভিযোগ তার আংশিক সত্যি হলেও চিত্র ভয়ানক।

দেশজুড়ে স্বার্থান্বেষী, লোভী, অসৎ জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে একদল অসৎ, লোভী, দুর্নীতিপরায়ণ, কুশিক্ষিত, স্বৈরাচারী গুন্ডা। যারা ব্যতিক্রম, হয় তারা নির্বাক, নিষ্ক্রিয় নয় তারা অক্ষম। দিকে দিকে স্বজনপোষণ, গুন্ডারাজ, কুশাসন, প্রোমোটাররাজ। একদিকে অবৈধ উপার্জন ও উৎকোচের ঢল আর অপরদিকে ক্ষুধার্তের অনাহার। শিক্ষা ও চিকিৎসার নামে ব্যাভিচারী ব্যবসা। মৃত্যু নিয়ে দলবাজী। আকাশছোয়া বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ। বেহাল অর্থনীতি। ক্রমাগত তৈরি হচ্ছে নবজাতকের অবাসযোগ্য এক মরুভূমি ভারতবর্ষ।

একদিন ইতিহাসের কী সব দুর্লঙ্ঘ্য সোপান পেরিয়ে আজ এখানে এসে পৌঁছেছি আমরা। কোথায় ছিলাম? কীভাবে ছিলাম? কোথায় এসেছি? কীভাবে আছি? বর্ষ বর্ষ পরে এক লোভজর্জর, ঘুণজীর্ণ, দীন ভারতবর্ষে। অতীতের পানে চাইলেই এক সুগভীর পীড়ন, এক অন্তর্ভেদী মর্মদহন। হে অনাদি অতীত, হে বহমান বর্তমান, তুমি কার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছ?

কোন অতীতে মহামতি অশোক বলেছিলেন, 'সব মুনিষে প্রজা মমা'। ধর্মাশোক পিছিয়ে পড়েছেন অনেক অনেক অনেকখানি। সময়, সভ্যতা, বোধ, বিচার, ইতিহাস - সবই এগিয়ে গেছে দূরের দিগন্তে।

ইতিহাস বুঝি এমনই হয়। সুন্দর ক্রমশ জন্ম দিয়ে যায় অসুন্দরের। আবার অসুন্দরের গর্ভেই সুন্দরের অঙ্কুর। ইতিহাসের এ এক অমোঘ পর্যটন।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours